Robbar

বাংলাদেশের উচ্ছৃঙ্খল অবস্থা দুই বাংলার সংখ্যালঘুকে বিপন্ন করে তুলছে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 24, 2025 8:17 pm
  • Updated:December 24, 2025 8:18 pm  

একদিকে স্বাধীন গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের ওপর উন্মত্ত আক্রমণ, অন্যদিকে বাঙালির সুস্থ সংস্কৃতি সাধনার ওপর এসে চড়াও হওয়া। গানের সংস্কৃতি, নাটকের সংস্কৃতি, চিত্রকলার সংস্কৃতি। এমনকী, শিক্ষালয়ের সংস্কৃতিও এদের হাতে পর্যুদস্ত হচ্ছে, কারণ বহু প্রবীণ শিক্ষক ও শিক্ষিকা এদের হাতে হেনস্তা হয়েছেন। শিক্ষা-সংস্কৃতির যারা চর্চা করছে তাদের সকলের মধ্যে একটা উদ্বেগ ও নিরাপত্তার অভাব এরা চারিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে।

পবিত্র সরকার

ইনকিলাব মঞ্চের নেতা ওসমান হাদিকে কে গুলি করেছিল, তা এখনও স্পষ্ট করে কেউ জানে না। সভ্য পৃথিবীর নিয়মে একজন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং সভ্য দেশে সেই অপরাধীকে ধরে তার উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া রাষ্ট্রের, অর্থাৎ প্রশাসন ও পুলিশবাহিনীর কাজ। বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসন আর তার পুলিশবাহিনী সেই কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। হাদির ভক্ত ও অনুগামীদের ক্ষোভ রাষ্ট্রের সেই অক্ষমতার দিকে ধাবিত হওয়ার কথা ছিল, কতটা হয়েছে আমরা জানি না। হাদির মৃত্যু হয়েছে, সেটা এক গভীর দুঃখজনক ঘটনা।

ওসমান হাদি

যে রাষ্ট্রে পুলিশবাহিনী, সামরিক সংগঠন এবং বিচারবিভাগ মোটামুটি সক্রিয়, সেখানে এ ধরনের হত্যা নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তবে, প্রশাসন বা বিচারব্যবস্থাকে নানা ধরনের হুমকি দিয়ে, উচ্ছৃঙ্খল জনতা তাদের কোনও সময় দেয়নি, নিজেরাই প্রতিবিধানের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশে এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া প্ররোচনা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করেনি। জুলাই বিপ্লবীদের কেউ কেউ অবলীলাক্রমে বলেছেন, এই হত্যা ভারতের ষড়যন্ত্র, আবার কেউ বলেছেন হত্যাকারীরা ভারতে পালিয়ে গিয়েছে! এবং ভারতের হাইকমিশন অফিসের সামনে বিক্ষোভ ইত্যাদি ঘটেছে, আবার ভারতের উত্তর-পুবের ‘সাত বোন’কে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে, এই ধরনের ছেলেমানুষি হুমকিও শোনা গিয়েছে।

জুলাই বিপ্লব। বাংলাদেশ

সেই মৃত্যুর শোকে উন্মত্ত হয়ে জনতা, তার মধ্যে তরুণের সংখ্যাই বেশি, তারা কী করেছে– তা এখন সারা পৃথিবীর কাছে প্রকাশ্যে। গভীর রাতে রাজপথে বেরিয়ে তারা দু’টি প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় বাংলা (প্রথম আলো ) এবং ইংরেজি (The Daily Star) সংবাদপত্রের অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। বহু মানুষের জীবনকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে তারা, সুখের বিষয় কোনও মৃত্যু ঘটেনি। এ হল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর স্বৈরাচারী আক্রমণ, যা বাংলাদেশে সম্প্রতি জনতা বা জনতার বিশেষ একটা অংশের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার চেয়েও উদ্বেগের কথা যে, হাদির মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ এই জনতা গভীর রাত্রে ‘ছায়ানট’ নামে বাংলাদেশে সংগীত ও অন্যান্য শিক্ষার অনন্য ও বিশ্ববন্দিত প্রতিষ্ঠানটির দরজা ভেঙেছে। ভেঙেছে তার বাদ্যযন্ত্র এবং কিছু সম্পদ লুটপাট করেছে। তার পরেও প্রগতিশীল সংস্কৃতি প্রচারের আর একটি প্রতিষ্ঠান উদীচীর কার্যালয়ও আক্রমণ করেছে। উদীচী ভারতীয় গণনাট্য সংঘের মতো একটি সংস্থা। তার ওপর এর আগেও মৌলবাদীদের আক্রমণ ঘটেছে। যেমন ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরের টাউন হল মাঠে তাদের সম্মেলনে হরকত-উল-জিহাদ বলে একটি মৌলবাদী দল, বোমা মেরে ১০ জনকে হত্যা করেছিল, আহত করেছিল প্রায় ১৫০ জনকে। ২০০১-এ রমনার বিখ্যাত অশ্বত্থ মূলে ছায়ানটের বিখ্যাত পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানেও বোমা পড়েছিল, তাতে ১০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। একদিকে স্বাধীন গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের ওপর উন্মত্ত আক্রমণ, অন্যদিকে বাঙালির সুস্থ সংস্কৃতি সাধনার ওপর এসে চড়াও হওয়া। গানের সংস্কৃতি, নাটকের সংস্কৃতি, চিত্রকলার সংস্কৃতি। এমনকী, শিক্ষালয়ের সংস্কৃতিও এদের হাতে পর্যুদস্ত হচ্ছে, কারণ বহু প্রবীণ শিক্ষক ও শিক্ষিকা এদের হাতে হেনস্তা হয়েছেন। শিক্ষা-সংস্কৃতির যারা চর্চা করছে তাদের সকলের মধ্যে একটা উদ্বেগ ও নিরাপত্তার অভাব এরা চারিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে।

প্রথম আলোর দফতরে ভাঙচুর। বাংলাদেশ

ইসলাম নামটির মধ্যে ‘সালাম’ (হিব্রুতে ‘শালোম’) কথাটি লুকিয়ে আছে। তার অর্থ যে ‘শান্তি’, তা আমরা অনেকেই জানি না। যেখানে সৌজন্যমূলক সম্ভাষণ হল, ‘আস্সালাম অলায়কুম’ বা আপনার শান্তি হোক, সেখানে একদল লোক এই ধর্মকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে, তা তারা ভাবে না। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলাতে দীপুচন্দ্র দাস বলে এক পোশাকের কারখানার শ্রমিককে ‘নবীর নামে কটূক্তি করার জন্য’ পিটিয়ে হত্যা করে, তাঁর দেহ গাছের ডালে ঝুলিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই ঘটনা হাদির মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় ঘটেছে কি না, জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের এই অন্ধ ও পরিণামচিন্তাহীন জনতার শাসনের (এবং রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের) যে কয়টি লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা এইরকম–

১. বাংলাদেশের সমস্ত অপঘাতের জন্য ভারতকে দায়ী করা। সেই সঙ্গে ’৭১-এ পাকিস্তানের সমস্ত অপরাধ ঢাকার প্রয়াস। এমনকী, ’৭১-এর বীভৎস বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকে কোনও কোনও জিহাদি নেতা হাস্যকরভাবে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করছে। আর সেই সঙ্গে নানা বালখিল্যসুলভ হুমকিও দেওয়া হচ্ছে ভারতকে– তার মধ্যে সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘সাত বোন’কে ভারত থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করে দেওয়ার হুমকি। যা শুনলে ঢাকার প্রাগৈতিহাসিক ঘোড়াদেরও হাসি পাওয়ার কথা।

২. বিরোধীদের ওপর আক্রমণ। যেমন, আওয়ামী লীগকে সর্বত্র শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা। ৩২ নম্বর ধানমণ্ডি এমনিতেই মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার ওপর আক্রমণ থামার লক্ষণ নেই। ’৭১ ও শেখ মুজিবের বা তাঁর বংশধরদের নাম বা চিহ্ন কোথাও থাকলে, তা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হলের নাম পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী-পন্থী বলে কথিত ব্যক্তিদের ডিনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ারও দাবি তোলা হয়েছে। উপাচার্যরা তো আগেই গিয়েছেন, শিক্ষকরাও এদের হিংস্রতা থেকে রেহাই পাননি।

৩. শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিকেও এখন এই জঙ্গি-জিহাদিদের কেউ কেউ শত্রু বা সম্ভাব্য শত্রু মনে করছে, তাই বিএনপির নেতাদের বাড়িতেও আগুন লাগানো হচ্ছে, শিশুদেরও পরিত্রাণ নেই। এদের শত্রুর বৃত্ত ক্রমশ বাড়তেই থাকবে বলে মনে হয়। সেটা এক হিসেবে আশার কথা।

৪. হিন্দু-বৌদ্ধ সংখ্যালঘুরা এদের আর-একটি লক্ষ্য। ফলে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণও বাড়বে, হত্যা, লুটপাট, নারীধর্ষণ– যা আগেও চলেছে, এখন হয়তো আরও হিংস্রভাবে চলবে। এক্ষেত্রে ভারতীয় জনমত বা আন্তর্জাতিক মতামতের প্রতি জিহাদি জনতা উদাসীন থাকবে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রকর্তারাও নিরুপায় ভাব দেখাবে।

৫. সংগীত, নাটক, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ইত্যাদি যাঁরা করে চলেছেন, তাঁদের ওপরও আক্রমণ বাড়বে। যারা আক্রমণ করবে তারা ‘সাম্প্রদায়িক’ নয়, তারা জিহাদি। ফলে নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষকেও এরা রেহাই দেয় না।

এদের হঠকারিতা আর মূর্খতার একটা দিক হল, এরা বোঝে না যে, এদের এই ভয়ংকর সব কাজ আর সেই সঙ্গে নির্বোধ উচ্চারণগুলি ভারতের যাঁরা শান্তিপ্রিয় মুসলমান নাগরিক, তাদের বিপন্নতার বোধ আরও বাড়িয়ে তুলবে। এরই মধ্যে যেমন বিজেপি আর আরএসএস-এর পক্ষ থেকে ‘ব্যবস্থা নেওয়া’র দাবি উঠেছে। এই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উগ্র হিন্দুরা রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর না-ও করতে পারে, পথেঘাটে নিরীহ মুসলমান নাগরিক এর শিকার হতে পারেন। এ দেশে জঙ্গি হিন্দুত্বের একটা প্রধান লক্ষ্যই তো সংখ্যালঘুরা, তার পরে সম্ভবত দলিত সম্প্রদায়।

এরা অন্যান্য মুসলমান রাষ্ট্রে, যেমন সৌদি আরব, মিশর, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদিতে গানের সংস্কৃতি কেমন সমাদৃত, তাও জানে না। এমনকী, এই সেদিনও বাংলাদেশে হিন্দি সিরিয়ালের যে জনপ্রিয়তা আমি দেখেছি, দেখেছি হিন্দি গানের সমাদর, তা এদের হাতে লুপ্ত হতেই পারে। কিন্তু ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে মুসলমান সম্রাট ও সভা-গায়ক শিল্পীদের অবিস্মরণীয় দানের কথা কি এরা জানে? বড়ে ওস্তাদ ফৈয়াজ খান, আবদুল করিম খান, বড়ে গুলাম আলী, আমীর খানদের কথা? মুঘল চিত্রকলার কথাও বোধ হয় এরা জানে না। এই সংগীত ও চিত্রকলা, তাজমহলের মতো স্থাপত্য হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-শিখের মিলিত ভারতের গৌরবের উত্তরাধিকার। অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমান অধিবাসীরা রামায়ণ-মহাভারতের গল্প নিয়ে এখনও নাটক আর নৃত্যকলার চর্চা করে চলেছে। তা-ও পৃথিবীর উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক সম্পদ। জানি না, প্রতিচ্ছবি বলে চলচ্চিত্রকলাকেও এরা ধ্বংস করতে চাইবে কি না!

একটা আশার কথা এই যে, বাংলাদেশে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ থেমে নেই।  ‘প্রথম আলো’ আর ‘The Daily Star’ একদিন বন্ধ থাকার পরেই বেরিয়েছে, সেটাই একটা প্রতিবাদ। ভয় পায়নি। ‘ছায়ানট’-এ আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ হয়েছে– ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় সেই প্রতিবাদ ছড়িয়ে গিয়েছে। ঢাকাতেও মানুষ নির্বাক হয়ে ঘরে বসে থাকেনি। ‘ছায়ানট’ তার নিজের ভাষা, গানের ভাষাতেও প্রতিবাদ করেছে। যারা আজকের বাংলাদেশকে এই হিংসা আর মূঢ়তার অন্ধকারে নিয়ে যেতে চাইছে, তারা ‘মৌলবাদী’ বা সাম্প্রদায়িক শুধু নয়, তারা জেহাদি এবং কোনও ধর্মের জেহাদিদের দ্বারাই কোনও সদর্থক কাজ হতে পারে না।

এ-সব যখন মনে আসে, তখন এমন ভাবতে ইচ্ছা হয় যে, ইতিহাস কখনও থেমে থাকে না। তার পাতা ওলটায়, পালাবদল ঘটে।

………………………

রোববার.ইন-এ পড়ুন পবিত্র সরকার-এর অন্যান্য লেখা

………………………