সম্প্রতি বিহার সরকারের পর্যটন দপ্তর সর্বসাধারণের জন্য একটি পোর্টাল খুলেছে। ঘরে বসে পিণ্ড দান করতে চান? ব্লিংকইটে আইসক্রিম অর্ডার করতে করতে পেতে চান পুণ্যের হিম এবং ড্রিম? রইল ই-পিণ্ডদানের পোর্টাল। ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং, দু’-দিন উপোস– এত ঝক্কি পেরিয়ে পুণ্যলাভের যে পথে লম্বা লাইন পড়ে রোজ! অথবা পরলোক গমনের যে পথে মৃত আত্মাকুল লাইনচ্যুত হয়ে এ-ওর ঘাড় মটকায়! সেই মহৎ পথ এখন– অনলাইনে!
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
এমনই এক বর্ষাকালের শেষ ইনিংসে, নিউ দিল্লি স্টেশনে নেমেছি, একেবারে একা। সঙ্গে ল্যাগব্যাগে হিন্দি। তাই নিয়েই ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করছি আর নাগাড়ে খাচ্ছি ‘রাজমা-চাউল’, ‘ছোলে-ভাটুরে’… ব্যস! দিন পনেরো পরেই পেট ছেড়ে দিল বাঙালির। সে ছড়িয়ে লাট! মনটা তাই খারাপ। হস্টেলের ছাদে এসে বসেছিলাম। আকাশে একটা কোজাগরী পূর্ণিমার নধর চাঁদ। আমারই এক সহপাঠী, বিহারের কোনও মফসসলের ছেলে, দীর্ঘকালের বিশ্বাস থেকেই যেন বলল, শুনলাম তোর পেটখারাপ? খানিকক্ষণ জামা খুলে ছাদেই শুয়ে থাক ভাই। চাঁদের থেকে যে হিম পড়বে আজ, পেটের যাবতীয় ব্যামো কিন্তু সেরে যাবে ওতেই। আজকের পূর্ণিমা ভীষণ পুণ্য। শোনামাত্র পেট গুড়গুড়িয়ে ওঠে সাংঘাতিক। তখন পয়ঃপ্রণালী ছাড়া এ-জীবনে পয়মন্ত বলতে যা-কিছু, সব ডিপফেক।
মনে পড়ে, ছোটবেলায় মা শুনিয়েছিল, আদিমকালের চাঁদিম হিমের ছড়া। যখন টিনেজ শেষ হচ্ছে, সেই ধারণাই কয়েক গুণ পেকেছে। তখন পড়ি: ‘চাঁদ খুব বড়লোকের মেয়ে। ওকে একদিন একা পাবই।’ জেনেছি চাঁদের ব্যাপ্তি এতখানি। মস্তিষ্কের প্রতি কুঠুরি থেকেই অমোঘ এক নোটিফিকেশন আসে। ইদানীং বারবার আসে। বলে, চেয়ে দেখো হে! কেমন বালখিল্য আধুনিকতার ভেতরে বেঁচে আছ! অবাক-বালকের মতো চেয়ে দেখতে দেখতে আমার হাসি পায় দারুণ আর মনে মনে জন্ম নেয় এক উত্তর আধুনিক দ্বন্দ্ব। ঘোর সংকটকালে কার শরণাপন্ন হবে তুমি গুরু? চ্যাটজিপিটি না বিপত্তারিণী?
খিল্লি করছি মশাই? কক্ষণও না। কারণ ভাবাবেগ। হিসুর বেগের থেকেও গুরুতর! কিঞ্চিৎ ছোঁয়া দিলেই ফেটে চৌচির। তবু আপনি বলুন, না হেসে থাকা যায়? লেখক, গীতিকার এবং কমেডিয়ান বরুণ গ্রোভার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দ্য ওয়ার্স্ট টাইম ফর কমেডি ইজ দ্য বেস্ট টাইম ফর কমেডি।’ সম্প্রতি বিহার সরকারের পর্যটন দপ্তর সর্বসাধারণের জন্য একটি পোর্টাল খুলেছে। ঘরে বসে পিণ্ড দান করতে চান? ব্লিংকইটে আইসক্রিম অর্ডার করতে করতে পেতে চান পুণ্যের হিম এবং ড্রিম? রইল ই-পিণ্ডদানের পোর্টাল। ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং, দু’-দিন উপোস– এত ঝক্কি পেরিয়ে পুণ্যলাভের যে পথে লম্বা লাইন পড়ে রোজ! অথবা পরলোক গমনের যে পথে মৃত আত্মাকুল লাইনচ্যুত হয়ে এ-ওর ঘাড় মটকায়! সেই মহৎ পথ এখন– অনলাইনে! নাম রেজিস্টার করুন। টাকা দিন। আপনার হয়ে গয়ার কোনও পুরোহিত পিণ্ডদান করবেন। সরকার দায়িত্ব নিয়ে ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়ে দেবে আপনার ইমেলে।
ইহজগতের যাবতীয় পাপ ধুয়ে ফেলে অনলাইনে, ফুরফুরে মনে স্বর্গের দুয়োরে পা রাখার ফুরসত পেতেই, গয়ার একদল পাণ্ডা বলছে, পাপা নেহি মানেঙ্গে! অতএব এহেন পাপাচার এক্ষুনি বন্ধ করা হোক। পিণ্ডদান ভার্চুয়ালি? এ কোন অ-সনাতনী ফাজলামি হচ্ছে? ভাবাবেগ আসলে ইয়ের বেগের থেকেও… বিহার সরকার ভেবেছিল, অনলাইনে অঞ্জলি যদি সম্ভব, তাহলে পিণ্ডদানেও ক্ষতি কী! রাজ্যে দিনকয়েক পরেই পিতৃপক্ষ মেলা। নভেম্বরে বিধানসভা নির্বাচন। জনগণের কাছে সুলভে মোক্ষলাভের একটা সরকারি পথ বাতলে দিলে ভোট-ব্যাংক থাকতে পারে অটুট! এত অমলিন হাস্যরস আমার দেশের অলি-গলিতে।
গতবছরের কথা। সমগ্র ভারতে তখন ভাইরাল কুম্ভমেলা। স্ট্যাম্পিড হয়েছে। দূরপাল্লার ট্রেন ভাঙচুর হয়েছে। হোয়্যাটসঅ্যাপ থেকে জানতে পারি, নাসার স্যাটেলাইটেও সে-মেলার ছবি উঠেছে! এ-সবই পুণ্যের ফল। অথচ এক আশ্চর্য পোস্টারে স্ক্রলিং আটকেছিল আমার। পুণ্যস্নানের সুযোগ মিস করবেন না। আপনার ছবি ইমেল করুন আমাদের। আমরা আপনার ছবিকে স্নান করিয়ে দেব। আমরা আপনার আত্মাশুদ্ধি গুরুভার বহন করব। এই আমরা কারা? সনাতন? মস্তিষ্ক হবে শান্ত। জীবনে আসবে ডিভাইন সুখ। মাত্র ৫০০ টাকা। সুখের চিন্তা ছেড়ে দেখি, কী ডিভাইন কমেডি হয়েছে ভাই!
ধর্মের সঙ্গে ধান্দা জুড়তে জুড়তে যে রাজনীতির নির্মাণ হয়েছে, তা মূলত কমেডি। এই তো জুলাই মাসে, মধ্যপ্রদেশের গণপূর্ত বিভাগের মন্ত্রী রাকেশ সিং বললেন, যতদিন দেশে রাস্তা থাকবে, গর্তও থাকবে ততদিন। সরকারের কী করণীয়? বিহার সরকার তাই ই-পিণ্ডদানের পোর্টাল চালু করেছে। গয়ার পুরোহিত-সমাজ রেগে কাঁই। সম্ভবত আপনিও। অথচ আপনার এতকালের উপোস ও শনি-মঙ্গলের ব্রত– কাউকেই জাস্ট পাত্তা না দিয়ে ব্যবসায়িক ধান্দা করতে চাইছে যখন একটা সরকার, তখন বুঝতে হয়, এ-দুনিয়ায় বেচাই আসলে মোক্ষ। একুশ শতকে, পুঁজি বিনে পুজো অথবা পিণ্ডদান? ব্যাকডেটেড!
এই আধুনিকতাই আমাদের কাম্য। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাই পাই, রান্নাঘরে মিক্সার গ্রাইন্ডার এবং শিলনোড়া– উভয়ের সহাবস্থান যেন আমাদের আধুনিকতার স্পষ্টছাপ। আবার যে হাতে বিপত্তারিণীর লাল সুতো, সে হাতে স্মার্ট ওয়াচ। গলায় মাদুলির সঙ্গে ব্লুটুথ হেডফোনও ঝুলতে থাকে চমৎকার! হায়দরাবাদের ‘করাচি বেকারি’ বন্ধ করো– স্লোগান দেয় একদল হতবুদ্ধি বেকার। রিয়েলিটিতে জন্ম নেয় মিম। করাচি বেকারির প্রধান বলেন, আমরা হিন্দু। করাচি বেকারির বিস্কুট হায়দরাবাদের গর্ব। এখন একটা নামের জন্য দোকান তুলে দেব?
……………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
……………………………
আচ্ছা, ই-পিণ্ডদানে মুক্তি পেল যে আত্মারা, তারা কি অনলাইনে থাকবে অনন্তকাল? নামের পাশে জ্বলবে সবুজ আলো? ইদানীং একটা নোটিফিকেশন আসে। চেয়ে দেখো হে… অবাক-বালকের মতো চেয়ে দেখতে দেখতে আমার হাসি পায় প্রবল। ইট ইজ দ্য বেস্ট টাইম ফর কমেডি!
তবুও কেন কুণাল কামরার শো ক্যান্সেল হয় বলুন? কতশত কমেডিয়ানের নামে এফআইআর? অথচ কমেডি আর শৃঙ্খল ছাড়া তো আমাদের হারানোর কিছু নেই আর। এই আধুনিক হলেন তবে? এমন আজগুবি আধুনিকতা নিয়ে কী করবেন? যেটুকু বালখিল্য, বিদেয় দেবেন এইবেলা? নাকি ই-পিণ্ডদানের পোর্টালে নাম রেজিস্টার করবেন?
……………………
পড়ুন রোববার.ইন-এ রোদ্দুর মিত্র-র লেখা
……………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved