Robbar

বিরল পথভোলা পাখিদের দেখা পাওয়া আনন্দের নাকি প্রমাদবার্তা?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 17, 2025 5:16 pm
  • Updated:October 17, 2025 8:05 pm  

নিয়ম থাকলেই যেমন ব্যতিক্রমও থাকে তেমনি পাখিদের রুটিন আসা-যাওয়ার চিরায়ত পথেরও ব্যত্যয় ঘটে। অজস্র পথ আর কাতারে কাতারে পাখির পরিযানের প্রশ্ন জড়িয়ে যেখানে সেখানে কালেভদ্রে কোনও একটি প্রজাতির এক বা একাধিক পাখি সাধারণ পথ পরিযান না করে এমন কোনও জায়গায় পৌঁছে যায়, যেখানে তার যাওয়ার কথা নয়। এই ভুল জায়গায় চলে যাওয়া কিন্তু ভবঘুরের (ভ্যাগাবন্ড) লক্ষণ নয়। পরিযান তাদের জীবনচক্রের অংশ; তাদের বাঁচা-মরা, বংশবৃদ্ধি সব নির্ভর করে সফল পরিযানের ওপর। ভবঘুরে হওয়া একটা ঐচ্ছিক প্রক্রিয়া। কিন্তু ভুল করে যদি কোনও পাখি ভুল জায়গায় পৌঁছে যায়, তার অস্তিত্ব বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন সেই পাখিটিকে ভ্যাগরান্ট পাখি বলে– বাংলায় বেপথো বা পথভোলা পাখি বলা যেতে পারে! বারুইপুরে দেখতে পাওয়া ওর্তোলান বান্টিং তেমনই এক পথভোলা পথিক। কেন?

সুজিতকুমার মণ্ডল

‘সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা/ আমায় চেন কি’– সত্যি চেনা যায়নি! বারুইপুরের জগদীশপুর ও টংতলা সংলগ্ন (সংশোধনাগার লাগোয়া এলাকা) ঘাসজমির অতি-পরিচিত পাখি দেখার জায়গায় বিশিষ্ট পক্ষীপ্রেমী অরুণাভ দত্ত যখন সাতসকালে কিছুটা একই রকম দেখতে দুটো পাখির ছবি তোলেন, তখন তিনি ভাবতেও পারেননি কী বিরল দর্শনের সাক্ষী হয়েছেন তিনি!

ওর্তোলান বান্টিং। ছবি: অরুণাভ দত্ত

ভোর না হতেই দক্ষিণ কলকাতা থেকে বারুইপুরে পাখি দেখতে ছুটে যাওয়া তাঁর বছরভরের অভ্যেস। অক্টোবরের প্রথম দিন ভোরের এই বিরল পাখিকে প্রথমে চেস্টনাট-ইয়ার্ড বান্টিং বলে মনে করা হয়েছিল। চেস্টনাট-ইয়ার্ড বান্টিং পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের নানা প্রান্তে শীতের পরিচিত পরিযায়ী পাখি। এরপর অক্টোবরের ২ ও ৩ তারিখে পাখিটিকে দেখার কোনও সংবাদ মেলেনি। নিম্নচাপের ভ্রুকুটির মধ্যে সেই সময় আবহাওয়াও ছিল প্রতিকূল। মাসের চার তারিখে পাখিটির আবার দেখা পান বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ সন্দীপ বিশ্বাস, চব্বিশ পরগনার ভূমিপুত্র পেশায় শিক্ষক ও অতি পরিচিত পক্ষিপ্রেমী কপিল বাগ-সহ আরও কয়েকজন। কপিল একাধারে যেমন বারুইপুর ও আশপাশের এলাকায় নিয়মিত পাখি দেখেন, তেমনই তিনি একজন কুশলী ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফারও। তাঁর চমৎকার ফোটোগুলিতেও পাখিটি ভ্রান্ত নামে চিহ্নিত হয়। এবারে বান্টিং গোত্রেরই এই পাখিটি ভুল করে চিহ্নিত হয় গ্রে-নেকড বান্টিং হিসেবে। গ্রে-নেকড বান্টিং রাজ্যের আরেক পরিচিত পরিযায়ী বান্টিং গোত্রের পাখি। পাখিপ্রেমীরা পুরুলিয়ায় মাঝেমধ্যেই এ পাখির দেখা পেয়ে থাকেন। তাকে বার দুয়েক সুন্দরবনেও দেখা গিয়েছে। তাছাড়া বারুইপুরে লিটল বান্টিং, ব্ল্যাক-হেডেড বান্টিং, ইয়েলো-ব্রেস্টেড বান্টিং-এর মতো বান্টিং গোত্রের দুর্লভ পরিযায়ীর দেখা মিলেছে বিগত মরশুমগুলোতে!

ওর্তোলান বান্টিং। ছবি: অরুণাভ দত্ত

ইতিমধ্যে ৪ তারিখের তোলা স্টিল ও ভিডিওর ছবি দেখে সন্দীপ বিশ্বাসের অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে অবিশ্বাস্য হলেও পাখিটি ওর্তোলান বান্টিং (Ortolan Bunting) এবং বিদেশের বিশিষ্ট পক্ষীবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি নিশ্চিত হয়ে সারা দেশের জন্য এই চাঞ্চল্যকর খবরটি পেশ করেন। বস্তুত সন্দীপ বিশ্বাসের অভিজ্ঞ দৃষ্টি ও অনুসন্ধিৎসার কারণেই পাখিটির প্রকৃত পরিচয় জানা যায়। তারপর যাকে বলে হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার! পরবর্তীতে মাসের ৬ তারিখে পাখিটি আবার দেখা যায় ও বহু পক্ষীপ্রেমী ও পাখি-ফোটোগ্রাফার পাখিটির ফোটো তুলতে সক্ষম হন!

২০১৪ সালে বাংলায় দেখা প্রথম ওর্তোলান বান্টিং। ছবি: জয়ন্ত মান্না

কিন্তু কেন এই চাঞ্চল্য? কী গুরুত্ব এই ওর্তোলান বান্টিংয়ের? পাখিটি বারুইপুরে দেখতে পাওয়া ও তার পরিচয় জানার পর্বটি যেমন নাটকীয় ও ঘটনাবহুল, মহাদেশের এই প্রান্তে পাখিটির দেখা পাওয়াও তেমনই আশ্চর্যের ও চমৎকৃত হওয়ার মতো ঘটনা! আসলে ওর্তোলান বান্টিং দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ পরিযায়ী পাখি নয়– এক ধরনের পথ ভুলে চলে আসা পাখি, পরিভাষায় যাকে বলে ‘ভ্যাগরান্ট’ পাখি বা পথভোলা পাখি! ভারতে কেরল, মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ এবং জম্মু ও কাশ্মীরে বিচ্ছিন্ন কয়েকবার দেখা গেলেও পূর্ব ভারতে তথা উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তে এর আগে একবারই মাত্র দেখা গেছে ওর্তোলান বান্টিং। সে-ও আবার পশ্চিমবঙ্গেই! ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর সুন্দরবনের দোবাঁকি ক্যাম্পে ওর্তোলান বান্টিং-এর ফোটো তোলেন স্বনামধন্য বিশিষ্ট পক্ষীবিশারদ জয়ন্ত মান্না। আর তার এক দশকেরও বেশি সময় পরে এবারের এই বারুইপুরে দেখা। যে কারণে বারুইপুরের পাখির হটস্পটে ভিড় জমিয়েছেন রাজ্যের তো বটেই এমনকী, দেশের অন্য প্রান্তের পক্ষিপ্রেমীরাও।

ওর্তোলান বান্টিং। ছবি: কপিল বাগ

ভ্যাগরান্ট পাখি ব্যাপারটা কী! কেন তাকে নিয়ে এত উৎসাহ পাখিপ্রেমীদের মধ্যে? আসলে পক্ষীকূলের স্বাভাবিক পরিযানের মতো এটাও একটা রুটিন পরিযান নয়। যুগ যুগ ধরে পাখিদের পরিযানের ঘটনা ঘটে আসছে। ঋতু বদল, তাপমাত্রার হেরফের, খাদ্যের জোগান, বংশবৃদ্ধির উপযুক্ত প্রতিবেশ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সব কারণে পাখিরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছোট-বড় নানা দলে বা দলে দলে পাড়ি জমায় ভূ-গোলকের উত্তর থেকে দক্ষিণ বা দক্ষিণ থেকে উত্তর কিংবা অনেক ক্ষেত্রে পুব থেকে পশ্চিম বা পশ্চিম থেকে পুবে। ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন উত্তর গোলার্ধের শীতল ও নাতিশীতোষ্ণ এলাকা থেকে বহু প্রজাতির পাখি আসে শীতকালে আর প্রজননের জন্য আবার বসন্ত-গ্রীষ্মের সময় ফিরে যায়। কিছু প্রজাতির পাখি আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আসে। কিছু আসে আরব সাগরের পশ্চিম কিংবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। উপমহাদেশের মধ্যেই দক্ষিণ থেকে উত্তরে এসে সময় কাটিয়ে যাওয়া প্রজাতির সংখ্যাও খুব একটা কম নয়। এ এক প্রাকৃতিক বিস্ময়! যুগ যুগ ধরে পাখিরা কীভাবে এই পরিযানের দুরূহ কাজ সম্পন্ন করে, কেমন করে পথ চিনে একই পথে তাদের গতায়ত চলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তার অনেকটা কার্যকারণ জানা গেলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও এখনও সবটা বুঝে ফেলা গিয়েছ, এমন দাবি করা যাবে না। পরিযায়ী পাখিদের সফল পথ পরিক্রমার দক্ষতার নেপথ্যে তাদের কোন কোন শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য, ভূ-চৌম্বকীয় মানচিত্র বা অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণ জড়িয়ে রয়েছে, তার সবটা এখনও জানা যায় না।

পেক্টোরাল স্যান্ডপাইপার। ছবি: সুজিতকুমার মণ্ডল

কিন্তু সব রুটিন কাজের যেমন হেরফের হয়, নিয়ম থাকলেই যেমন ব্যতিক্রমও থাকে তেমনি পাখিদের এই রুটিন আসা-যাওয়ার চিরায়ত পথেরও ব্যত্যয় ঘটে কখনও সখনও। অজস্র পথ আর কাতারে কাতারে পাখির পরিযানের প্রশ্ন জড়িয়ে যেখানে সেখানে কদাচিৎ, কালেভদ্রে এমনও ঘটে যে কোনও একটি প্রজাতির এক বা একাধিক পাখি সেই প্রজাতির বরাবরের সাধারণ পথ পরিযান না করে এমন কোনও জায়গায় পৌঁছে যায়, যেখানে সাধারণ ভাবে তার যাওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ ভুল জায়গায় চলে যাওয়া। এই ভুল জায়গায় চলে যাওয়া কিন্তু ভবঘুরের (ভ্যাগাবন্ড) লক্ষণ নয়। ভবঘুরে হওয়ার বিলাসিতা তাদের সাজে না। পরিযান তাদের জীবনচক্রের অংশ; তাদের বাঁচা-মরা, বংশবৃদ্ধি সব নির্ভর করে সফল পরিযানের ওপর। ভবঘুরে হওয়া একটা ঐচ্ছিক প্রক্রিয়া। কিন্তু ভুল করে বা বাধ্য হয়ে যদি কোনও পাখি ভুল জায়গায় পৌঁছে যায়, তার অস্তিত্ব বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন সেই পাখিটিকে ভ্যাগরান্ট পাখি বলে– বাংলায় ‘বেপথু’ বা ‘পথভোলা পাখি’ বলা যেতে পারে! বারুইপুরে দেখতে পাওয়া ওর্তোলান বান্টিং তেমনই এক পথভোলা পথিক। কেন? সে কথায় যাওয়ার আগে তেমনই আরেক পথভোলা পথিকের কথা জেনে নেওয়া যাক।

পেক্টোরাল স্যান্ডপাইপার। ছবি: সুজিতকুমার মণ্ডল

এ-ও সাম্প্রতিক, আর বাংলার অতিথি! এ বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে বয়সে তরুণ কিন্তু অভিজ্ঞ পক্ষীপ্রেমী পত্রালি পাল, শান্তনু ঘোষ, সৌম্যজিৎ তালুকদার ও অগ্নিভ দাশগুপ্তরা সদলবল ফ্রেজারগঞ্জে পাখি দেখতে গিয়ে সকালে ফ্রেজারগঞ্জ সৈকতের বেলাভূমির অনেকখানি ওপরের দিকে বৃষ্টির মিঠেপানি জমা একটা ঘাসজমিতে একটি পাখি দেখতে পান। প্রাথমিক বিস্ময় ও অবিশ্বাসের ভাব কাটিয়ে খুব দ্রুত তাঁরা নিশ্চিত করেন যে, সেটি একটি ভ্যাগরান্ট প্রজাতির পাখি– গোটা দেশে কয়েকবার মাত্র বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখা গেলেও বাংলায় (বাংলাদেশ-সহ) তাঁদের দেখাটাই প্রথম দেখা। এটি একটি বালুবাটান গোত্রের পাখি। এ পাখির নাম পেক্টোরাল স্যান্ডপাইপার (Pectoral Sandpiper)। এই প্রজাতির মোট সংখার প্রায় অর্ধেক তুন্দ্রা অঞ্চলে বংশবৃদ্ধি করে। এছাড়া উত্তর আমারিকার আলাস্কা ও কানাডায় এদের দেখা যায় প্রজনন ঋতুতে। শীতকালীন পরিযানে এরা দক্ষিণ আমেরিকা অবধি যায়। তুন্দ্রায় প্রজনন ঘটানো অংশটি শীতকালীন পরিযানে যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড অবধি। অর্থাৎ, দক্ষিণ এশিয়ায় এরা আসে না। অনুমান করা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে পূর্বদিকে যাওয়ার বদলে এই পাখিটি ভুল করে পশ্চিম দিকে অনেকটাই দূরে বঙ্গোপসাগর পিছনে ফেলে ভারতীয় ভূখণ্ডে এসে পড়েছে। ভুল করে না এসে পড়লে দক্ষিণ এশিয়ায় একজন পাখি দেখিয়ের চোখে এর ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই।

ওর্তোলান বান্টিং। ছবি: কপিল বাগ

এদিকে একইভাবে ইউরোপ এবং উত্তর ও উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় বংশবৃদ্ধি করা ওর্তোলান বান্টিংয়ের চিরাচরিত পরিযানের জায়গা আফ্রিকা। পেক্টোরাল স্যান্ড পাইপারের মতো এ-ও ‘লিস্ট কনসার্ন’ পাখি। এমনকী, ফ্রান্সে প্রচলিত খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় এই ছোট্ট পাখিটি জনপ্রিয়তার অনেক ওপরের দিকেই ছিল। মাত্র আড়াই দশকের মতো কিছুকাল হল আইন করে এই পাখি খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এহেন পাখিটির স্বাভাবিক নিয়মে বারুইপুর শুধু নয়, ভারতীয় উপমহাদেশেই আসার কথা নয়। কিন্তু সে-ও পথভোলা পথিক। পয়লা অক্টোবর অরুণাভ দত্ত এই প্রজাতির দু’টি পাখি দেখতে পান। কিন্তু পরবর্তী যে দু’দিন পাখিটি দেখা গিয়েছে, সেটা একটাই। পেক্টোরালের ক্ষেত্রেও প্রথম দিন যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের ধারণা তাঁরা একই প্রজাতির দু’টি পাখি দেখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দিন বাংলা তথা দেশের ভিন্ন প্রান্তের বহু পাখি দেখিয়ে পাখিটি দেখে থাকলেও কেউ একটি বই দু’টি পাখি দেখতে পাননি।

পেক্টোরাল স্যান্ডপাইপার। ছবি: সুজিতকুমার মণ্ডল

কিন্তু কেন হয় প্রাণঘাতী এমন ভুল? বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, ভ্যাগরান্ট পাখির নিজস্ব স্বাভাবিক পরিযান পথে প্রাণ নিয়ে ফেরার সম্ভবনা অনেক কম থাকে। প্রাণের মাশুল দিতে হতে পারে, দুঃসহ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হতে পারে এমন পরিস্থিতিতে কেন পড়ে ভ্যাগরান্ট পাখি! এ প্রশ্নের উত্তর অনেকটা পরীক্ষিত সত্য আর কিছুটা অনুমান তো বটেই। পক্ষীবিজ্ঞানীদের মতে, পাখির ভ্যাগরান্ট হওয়ার একটা আবশ্যিক কারণ হচ্ছে দিকভ্রান্তি। খারাপ আবহাওয়ার কারণে বা পাখির নিজের শারীরবৃত্তীয় সমস্যার (যেমন জিনগত ত্রুটি) কারণে পাখি বেপথে পাড়ি দিতে পারে। যেসব পরিযানে অনেকটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়, সেক্ষেত্রে এমন ভুল হতে পারে। পেলাজিক অর্থাৎ, গভীর সমুদ্রের পাখি অনেক সময় ঝড়ে দিকভ্রান্ত হয়ে বা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে নদী, মোহনা, খাঁড়ি বা বেলাভূমিতে চলে আসতে পারে। সাম্প্রতিক অতীতে নিম্নচাপজনিত ঘূর্ণিঝড়ের পর এমন কিছু পথভোলা পাখির যেমন দেখা মিলেছে গার্ডেনরিচের কাছে হুগলি নদীতে এমনকী, রূপনারায়ণের মোহনাতেও। পেকটোরাল স্যান্ডপাইপার তার পরিযানে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে, তাই তার ক্ষেত্রে কোনও প্রমাদ ঘটতে পারে। কিছু ভ্যাগরান্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে অনেক সময় প্রজনন ভূমি বা পরিযানের মধ্যবর্তী বিশ্রামের জায়গা থেকে অন্য প্রজাতির পাখির দলের সঙ্গে মিশে তাদের সঙ্গে পাড়ি দিতে গিয়ে কোনও কোনও পাখি এমন গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছচ্ছে, যেটা তার প্রজাতির স্বাভাবিক গন্তব্য নয়। কয়েক বছর আগে গজলডোবায় বার-হেডেড গুজের দলে মিশে থাকা বিন গুজ কিংবা অতীতে গজলডোবায় বা নিকট অতীতে বক্রেশ্বরে আসা গ্রেটার হোয়াইট-ফ্রন্টেড গুজ-এর ক্ষেত্রে এমনটা (ambigration) হয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তনও হয়তো একটা কারণ। পাখির পরিযানে তাপমাত্রার পরিবর্তন ও মান গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে তাপমানের যে খামখেয়ালিপনা আবহবিদেরা লক্ষ করছেন, তার জন্যও পরিযায়ী পাখিরা ভুল গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে!

যে-কথা বলে শুরু করেছিলাম, পাখি দেখিয়েদের উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য। কেন? ভ্যাগরান্ট পাখি তো আসলে একটা অবাঞ্ছিত প্রাকৃতিক প্রমাদের দুর্ঘটনামাত্র। আসলে সাধারণ পাখি দেখিয়েরা পক্ষিবিজ্ঞানী, জীববৈচিত্র বিশেষজ্ঞ কিংবা পরিবেশবিজ্ঞানী না হলেও তাঁদের নিজের নিজের পর্যবেক্ষণ ও ডেটা সংগ্রহের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক চর্চার সহযোগী ও অংশীদার হয়ে ওঠেন। কোনও জায়গার জীববৈচিত্রের ভারসাম্য বা আবহাওয়ার পরিবর্তন বা ভূতাত্ত্বিক বদলের অভিঘাত সরাসরি এসে পড়ে সেখানকার পাখি, প্রজাপতি, ফড়িংয়ের মতো আপাত তুচ্ছ জীবকূলের ওপর। বিজ্ঞানী না হয়েও সহজেই যেগুলোর পাঠ নেওয়া যায়। একই সঙ্গে সামান্য নিয়ম-নিষ্ঠা সহযোগে তাঁদের পর্যবেক্ষণের নথিবদ্ধকরণ বৈজ্ঞানিক চর্চায় প্রভূত সাহায্য করতে পারে। চর্চার তুলনামূলক ভাবে নতুন এই শাখাকে বলা হচ্ছে ‘সিটিজেনস সায়েন্স’– একজন পাখি বা প্রজাপতি বা পোকামাকড় দেখিয়ে আসলে এই সিটিজেন সায়েন্সের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ভ্যাগরান্ট প্রজাতির পর্যবেক্ষণ তাঁদের সামনে অনেক ভাবনা চিন্তা ও বিশ্লেষণের খোরাক, নতুন ও দূর দেশের প্রজাতি সম্পর্কে জানার সুযোগ এনে দেয়। ভাবতে ভালোই লাগে যে, পৃথিবী জুড়ে বহু সংখ্যক মানুষ এখন এইভাবে বিজ্ঞানের সেবা করে চলেছেন নিঃস্বার্থভাবে। বারান্তরে সিটিজেনস সায়েন্স নিয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।

অন্যদিকে পরিহাস ও পরিতাপের বিষয়ও রয়েছে। যে বারুইপুর বিশেষ পাখির উপস্থিতির জন্য দেশ-বিদেশের মনোযোগের কারণ হয়েছে সেই বারুইপুরে প্রায় একই সময়ে দুর্গাপুজোর বিসর্জনে বেআইনিভাবে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোয় তাবৎ জীববৈচিত্র বিশেষজ্ঞ ও পক্ষিপ্রেমীদের দুশ্চিন্তা ও ক্ষোভের কেন্দ্র হয়েছে! ইতিমধ্যে আইইউসিএন লাল তালিকার পরিমার্জিত সংস্করণে দেখা যাচ্ছে ‘লিস্ট কনসার্ন’ পাখি থেকে ‘নিয়ার থ্রেটেনড’ পাখি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে নীলকণ্ঠ। কারণ বিগত মাত্র কিছু বছরে ভারতে ব্যাপক হারে নীলকণ্ঠ পাখির সংখ্যা কমেছে। সময় থাকতে থাকতে সাধু সাবধান!