Robbar

প্রচ্ছদে ধূমপানের ছবি কি অরুন্ধতীর নীতিগত অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলে?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 9, 2025 8:53 pm
  • Updated:December 10, 2025 3:07 pm  

প্রচ্ছদে এই ছবির ব্যবহারে দেশের কোনও আইন লঙ্ঘন করা হয়নি। লেখক একজন মহিলা এবং তিনি নিজের ধূমপানরত ছবি প্রচ্ছদে ব্যবহার করেছেন, অতএব বিষয়টির ওপরে নীতিপুলিশি চালানোই অভিযোগকারীর উদ্দেশ্য ছিল না কি? বিশেষ করে তিনি যখন এর থেকে ‘কিশোরীরা কী শিক্ষা পাবে’ এই প্রশ্ন তুলেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অরুন্ধতী রায়ের রাজনৈতিক অবস্থান বা তাঁর ‘আর্বান নকশাল’ তকমাও এর জন্য দায়ী হতে পারে।

স্বাগতা দাশগুপ্ত

শিল্পীর স্বাধীনতা বনাম সমাজের নিয়মনীতি– এই বিরোধ বোধ করি মানবসভ্যতার শুরু থেকেই শুরু হয়েছে। আশা করছি মানবসভ্যতা যতদিন থাকবে ততদিন তা বিদ্যমান থাকবে। যেমন জারি থাকবে মানবসভ্যতার আরও অজস্র বিরোধ।

শিল্পীর স্বাধীনতা প্রয়োজন এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যুগে যুগে শিল্পীর জীবনের ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। সমাজের বাঁধা নিয়ম সে অনেকক্ষেত্রেই মানে না। শিল্পী চলে নিজের নিয়মে। এই স্বাধীনতা একেক শিল্পীর জন্য একেক রকমের। তার ইনক্লিনেশনের ওপর ভিত্তি করে– কারওর জন্য প্রকৃতি, কারওর জন্য নেশা, কারওর কাম, কারওর প্রেম, কারওর ভ্রমণ, কারওর জুয়া, কারওর একা থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। যা থেকে সে প্রেরণা পায়। যা তার কাজে রসদ জোগায়।

 অরুন্ধতী রায়

এই ‘শৈল্পিক প্রয়োজন’ শিল্পের ইতিহাসে বিশেষ জায়গা অধিকার করে আছে। কোনও এক বা একাধিক প্রেরণাদায়ক উপাদান বেশি বা অতিরিক্ত পরিমাণে দরকার হতে পারে শিল্পীর, তার সৃষ্টিশীলতা বজায় রাখার জন্য। আর এই বেশি বা অতিরিক্ত পরিমাণের নির্দিষ্ট কোনও সীমারেখাও প্রায় নেই বললেই চলে। অন্যদিকে সমাজ তৈরি হয়েছে কিছু নিয়মের ওপরে দাঁড়িয়ে। উড়নচণ্ডী জীবন থেকে মানুষ যখন একটা থিতু জীবনের মধ্যে আসে তার ভিত্তি হয় কিছু নিয়মকানুন, বিধিনিষেধ। তা নইলে এই জীবনটা সম্ভব হত না। সবাই মিলে দল বেঁধে মোটের ওপর শান্তিপূর্ণভাবে থাকছি মানেই কিছু নিয়ম সবারই মেনে চলা দরকার, যাতে সবাই মোটের ওপর ভালোভাবে টিকে যেতে পারি। যেমন আমি যদি গভীর রাতে খুব চেঁচামেচি জুড়ে দিই, তাহলে আমার বাড়ি এবং পাড়ার মানুষজনের ঘুমের ব্যাঘাত হবে। অতএব এটা চলতে পারে না। এই প্রয়োজনীয় নিয়ম বা উচিত-অনুচিতের বাইরেও আছে আরও অতিরিক্ত কিছু নিয়মাবলি। যেগুলো মেনে চলা মানুষের জীবনটাকে চালানোর জন্য একান্ত জরুরি নয়, কিন্তু এক ধরনের নীতিবাদের দিক থেকে সেগুলো সমাজে চালু আছে। এগুলোকে নীতিপুলিশির আওতায় ফেলা যায়। যেমন– ছেলেরা সিগারেট খেলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু মেয়েরা খেলে তা যত না স্বাস্থ্যের তার চেয়ে বেশি সম্মানের জন্য ক্ষতিকর। সন্তান উৎপাদন না করলে একটি মেয়ের জীবন ‘পূর্ণতা’ পায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। এই নিয়মগুলো না মানলেও দিব্যি বেঁচে-টিকে (আনন্দেও) থাকা যায়। সিঁদুর না পরেও একজন হিন্দু বিবাহিত মহিলা তাঁর বৈবাহিক জীবন সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারেন।

স্বভাবতই এই দু’ পক্ষের বিরোধ ঘটে। এই বিরোধ মোটামুটিভাবে দুটো স্তরের। শিল্পীর ব্যাপক স্বাধীন কাজকর্ম অনেকসময় আশেপাশের সুষ্ঠু জীবনের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। শিল্পের চোখ দিয়ে এই সমস্যাকে কিছুটা নরমভাবে দেখা গেলেও সমাজে তা খাটে না। আরেকটা স্তর হল শিল্পীর কাজকর্ম সে-অর্থে আশেপাশের জীবনে তেমন ক্ষতি করছে না, কিন্তু সেইসব কাজ সামাজিক নীতিপুলিশের অনুমোদিত নয়। ক্ষেত্রবিশেষে এই দুই স্তরের বিভাজনরেখা খুব স্পষ্ট না হয়ে, বিভাজন বেশ সূক্ষ্ম হতে পারে। আমাদের বর্তমান আলোচনার বিরোধটি এই দ্বিতীয় স্তরের।

অরুন্ধতী রায়ের সাম্প্রতিক বই ‘মাদার মেরি কাম্‌স টু মি’-র প্রচ্ছদে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের একটি পুরনো ছবি, যেখানে তিনি ধূমপান করছেন। এ-বিষয়ে বইয়ের প্রকাশকের তরফ থেকে একটি সতর্কীকরণ দেওয়া আছে যে, এই ছবি কোনওভাবেই ধূমপানের প্রচারক নয়। এক ব্যক্তি (পেশায় উকিল) এই প্রচ্ছদের বিরোধিতা করে কেরল হাইকোর্টে একটি পিটিশন জমা করেন এই মর্মে যে, ধূমপানরত লেখকের ছবি ধূমপানকে সৃষ্টিশীলতার অভিব্যক্তি হিসেবে গৌরবান্বিত করছে। অভিযোগকারী বলেন যে, বইটির বিষয়বস্তুকে তিনি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন না। কিন্তু বইটি যেহেতু সবার কাছেই লভ্য, সেক্ষেত্রে এই ছবি কি যুবসমাজ বিশেষত কিশোরীদের কাছে এই বার্তা পাঠাচ্ছে না যে, ধূমপান ব্যাপারটা বেশ কেতাদুরস্ত? তিনি দাবি করেন– এই প্রচ্ছদ COTPA (Cigeratte and Other Tobacco Products Act) বিরোধী এবং লেখক ও প্রকাশক যেন এই বইয়ের প্রচার আর বিক্রি থেকে বিরত থাকেন। প্রকাশক হাইকোর্টে দেখান যে, বিধিসম্মত সতর্কীকরণ বইতে আছে; অতএব এই অভিযোগ বিভ্রান্তিমূলক। কেরল হাইকোর্ট দেখে, অ্যানেক্সারে আছে শুধুমাত্র বইয়ের প্রচ্ছদের একটি ছবি এবং COTPA-র একটি প্রতিলিপি অর্থাৎ এই আবেদন যথেষ্ট জোরালো নয়। অভিযোগটি ধোপে টেকে না, হাইকোর্ট তা খারিজ করে দেয়। এও বলে যে, অভিযোগকারী আত্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এবং অরুন্ধতী রায়কে কলঙ্কিত করার উদ্দেশ্যে এই অভিযোগটি করেছেন। অভিযোগকারী এতে ক্ষান্ত হন না। তিনি আবার সুপ্রিমকোর্টে আবেদন জানান। সুপ্রিমকোর্ট কোনও রকমের আইন অমান্য করা হয়নি জানিয়ে আবেদনটি খারিজ করে।

অরুন্ধতী রায়, কার্লো বলদ্রিনির তোলা ছবি

বলাই বাহুল্য, প্রচ্ছদে এই ছবির ব্যবহারে দেশের কোনও আইন লঙ্ঘন করা হয়নি। লেখক একজন মহিলা এবং তিনি স্বেচ্ছায় নিজের ধূমপানরত ছবি প্রচ্ছদে ব্যবহার করেছেন, অতএব বিষয়টির ওপরে পুরুষতান্ত্রিক নীতিপুলিশি চালানোই অভিযোগকারীর উদ্দেশ্য ছিল না কি? বিশেষ করে তিনি যখন এর থেকে ‘কিশোরীরা কী শিক্ষা পাবে’ এই ‘নৈতিক’ প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে তিনি নিজে যখন একজন কর্মরত আইনজীবী, এই অভিযোগটির যে ‘আইনি’ যৌক্তিকতা নেই– সে বিষয়ে ত্নি ভালোভাবেই অবগত বলে ধরে নেওয়া যায়। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অরুন্ধতী রায়ের রাজনৈতিক অবস্থান বা তাঁর ‘আর্বান নকশাল’ তকমাও এর জন্য দায়ী হতে পারে। এই অভিযোগ অনুযায়ী তাহলে দেশের বিখ্যাত মহিলাদের ছোট পোশাকের ছবি দেখেও কিশোরীরা ‘ভুল শিক্ষা’ পেতে পারেন। যদিও ধূমপানের সঙ্গে স্বাস্থ্যের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে, কিন্তু এই অভিযোগে লেখকের মহিলা-পরিচয় রীতিমতো কাজ করেছে বলেই মনে হয়। এই অভিযোগকারী আমাদের সমাজের নীতিপুলিশদের একজন প্রতিনিধি মাত্র। তাঁর মতো অনেকেই আশেপাশে বিদ্যমান।

নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে অরুন্ধতী রায়

একজন লেখক তাঁর দেশের আইন অমান্য না-করে নিজের ইচ্ছেমতো একটি ছবি তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহার করেছেন। সেজন্য উপযুক্ত সতর্কীকরণ তাঁর বইতে আছে। এখানে যুক্তি অনুযায়ী আপত্তিকর কিছু দেখা যাচ্ছে না। শিল্পীর স্বাধীনতার দিক থেকে তো নয়ই। তবুও একটা প্রশ্ন মাথায় আসছে। শিল্পী/লেখক ছাড়াও সমাজে অরুন্ধতী রায়ের একটি পরিচয় আছে। তিনি একজন সমাজকর্মী। মানবাধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন। ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলনে শামিল হয়েছেন মেধা পাটেকরের সঙ্গে। তিনি যুদ্ধবিরোধী, অস্ত্রবিরোধী। এ-বিষয়ে বারবার সরকারের নীতির সমালোচনা করেছেন। মাওবাদীদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল। তাঁদের তিনি ‘দেশপ্রেমী’ বলে মনে করেন। আজ ভারতে মাওবাদীদের কার্যকলাপ প্রভূতভাবে পরিবেশবাদের পক্ষে। বনসংরক্ষণের পক্ষে, পরিবেশ রক্ষার্থে এস্টাব্লিশমেন্টকে আটকাতে তাঁরা লড়ছেন। এইরকম একটি সামাজিক (তথা রাজনৈতিক) অবস্থান নিয়ে নিজের ধূমপানরত ছবি নিজের বইয়ের প্রচ্ছদে দেওয়া কি কোনওভাবে অরুন্ধতী রায়ের অবস্থানের বিরুদ্ধতা করে? এই প্রশ্নটি তুলে আমি কি নীতিপুলিশি করছি? এর বিচার পাঠকের হাতেই থাক।