উত্তরবঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। কিন্তু তা মিডিয়াতে চর্চাতে আসল না। খবরের কাগজের এক কোণে ছোট একটা খবর হল। উত্তরবঙ্গের চা-বাগানে বন্যার জলের সঙ্গে ডলোমাইট এসে জমা হয়েছে। নাগরাকাটার ‘চ্যাংমারি টি এস্টেট’-এ, যা এ রাজ্যের সব থেকে বড় চা বাগান, তা ডলোমাইট দূষণে বিধ্বস্ত। ভুটান থেকে আসা নদীগুলোতে ডলোমাইটের দূষণ ক্রমশ বাড়ছে, সে-কথা বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এই বন্যা চোখে আঙুল দিয়ে সেই বিপন্নতা দেখিয়ে দিল।
একের পর এক উত্তরবঙ্গে বিপর্যয়। আর সেই বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে হিমালয়। যে হিমালয় না থাকলে এই ভারতবর্ষ কখনওই নির্মাণ হয় না। ভারতের জলবায়ু থেকে অর্থনীতি সব কিছুর নিয়ন্ত্রক এই হিমালয়। কেন হিমালয় বারবার বিপর্যস্ত হচ্ছে? তা আমাদের খুঁজে দেখার দরকার।
একদিকে কলকাতা শহরে যখন কার্নিভাল চলছে, উত্তরবঙ্গে তখন ধস, বৃষ্টিতে বিপন্ন পাহাড়। ডুয়ার্স-এ মৃত্যু হয়েছে অনেক মানুষের। সময় যত এগচ্ছে মৃত মানুষের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। হঠাৎ করে আসা বন্যা এই মৃত্যুমিছিলের কারণ। পুরো উত্তরবঙ্গ জুড়ে হাজারের বেশি মানুষ জলবন্দি। পাহাড়, ডুয়ার্সের কিছু এলাকায় মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়। আবহাওয়া দপ্তর এই বৃষ্টির কারণ হিসেবে জানিয়েছে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের ফলেই রাতভর এই রেকর্ড বৃষ্টি।
ক্ষয়ক্ষতির হিসেবও অনেক বড়। যদিও রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী উদ্ধারকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। জলদাপাড়া, গরুমারাতে ভেসে গেছে গণ্ডার, বাইসন, চিতাবাঘের মতো বন্যপ্রাণ। একটা গণ্ডারের মৃত্যুও হয়েছে। পাহাড়ে আটকে রয়েছেন অন্তত ৭০০ পর্যটক। উত্তরবঙ্গের নদীর এই ভয়াবহ চেহারা সেখানকার পুরনো দিনের মানুষরা আগে দেখেনি। হিমালয় বিধ্বস্ত। বৃষ্টিপাতের পর নদী গিলে খেয়েছে রাস্তাঘাট, সেতু, ঘরবাড়ি। প্রাণহানির খবর দিয়ে রাজ্য প্রশাসনের তরফে বৃষ্টিপাতের প্রাবল্যকে কাঠগোড়ায় তোলা হচ্ছে। তর্কের সাপেক্ষে সে-কথা মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু বৃষ্টিপাতের বিগত ১০০ বছরের ইতিহাস দেখলে উত্তরবঙ্গ যে এমন বৃষ্টি আগে দেখেনি, তা তো নয়। ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিও উত্তরবঙ্গে আগে, একাধিকবার হয়েছে। তাহলে তখন কেন এরকম বিপর্যয় নেমে আসেনি?
উন্নয়ন আর হিমালয়– দুটো কখনও সমার্থক হয়ে উঠতে পারে না। যদিও আমাদের দেশের চেষ্টা হয়ে দাঁড়িয়েছে হিমালয়-কেন্দ্রিক উন্নয়ন। যা হিমালয়ের পক্ষে একেবারে স্বাস্থ্যকর নয়। কারণ নবগঠিত হিমালয় আধুনিক উন্নয়নের ভার বইতে পারছে না। হিমালয়ের ভূমি গঠনের কাজ এখনও চলছে আর সেই কারণেই বারবার অস্থির হয়ে যায় সে। কাজেই হিমালয়ের বুকে ভূমিধস হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু একদিনে ৬১টির বেশি ভূমিধস, কার্যত অস্বাভাবিক।
হিমালয়ে উন্নয়নের নামে আমরা কী করলাম? তৈরি করলাম হিমালয় ভেঙে ভেঙে রাস্তা! যে রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে কাটা হল অরণ্য। যে অরণ্য প্রকৃতি নির্মাণ করেছিল কোটি কোটি বছর ধরে। মনে রাখা প্রয়োজন, প্রকৃতি কোনও কিছু অতিরিক্ত করে না। হিমালয়ের বুকে আগলে থাকা এই অরণ্য তার শিকড় দিয়ে আলগা শিলারাশিকে আগলে রাখত। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা পৃথিবীর অমূল্য সম্পদকে নষ্ট করলাম উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
পাহাড়ে উন্নয়নের নামে কী হল? নদীগুলোকে বাঁধ দিয়ে তৈরি হল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। পাহাড়ি সরু রাস্তাগুলোকে পর্যটকদের জন্য চওড়া বানানো হল। পর্যটক টানতে পাহাড়ের পেটে গর্ত করে রেলপথ পর্যন্ত হয়ে গেল! কোনওটাই আমাদের পক্ষে ভালো কিছু নিয়ে এল না। উত্তরাখণ্ডে একের পর এক বিপর্যয় শুরু হল ‘চারধাম প্রকল্প’ তৈরির পর থেকেই। জোর করে তৈরি করা তিস্তার ওপর বাঁধ সিকিমে ভেঙে গেল চোখের সামনে জলের তোড়ে।
হিমালয় থেকে নেমে আসে নদীগুলোর নিজস্ব এক চরিত্র রয়েছে। এই নদীগুলোতে একটু বৃষ্টি হলেই ফুলে ফেঁপে ওঠে। আর বৃষ্টি চলে গেলে তির তির করে বয়ে চলা নদীগুলোর স্বভাব। বর্ষা চলে গেলেই নদীগর্ভ থেকে বালি, পাথর তোলার কাজ। একটা পুরনো স্মৃতি আপনাদের একটু মনে করিয়ে দিতে চাই। এমনই এক দুর্গাপুজোয় বিসর্জনের সময় মাল নদীতে কয়েক বছর আগে বালি, কাঁকড় তোলা শুরু হয়। আর এই কাজে জুড়ে যায় দুর্নীতি। নদীর গতিপথ পাল্টে ফেলা হয় শুধু বালি ও পাথর সংগ্রহের জন্য। সঙ্কোশ, মেচি, তিস্তা, তোর্সা– আজ এইরকম ভাবেই বিপন্ন। সংবাদপত্রে বহুবার খবর হয়। খবরের পর প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন তা বন্ধ থাকে। প্রশাসনের নজর সরে গেলে ফের শুরু হয়ে যায় রমরমিয়ে বালি তোলা। আইন আছে। কিন্তু সেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই রমরমিয়ে চলে এবং চলছে এই কাজ।
এবারে উত্তরবঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। কিন্তু তা মিডিয়াতে চর্চাতে আসল না। খবরের কাগজের এক কোণে ছোট একটা খবর হল। উত্তরবঙ্গের চা-বাগানে বন্যার জলের সঙ্গে ডলোমাইট এসে জমা হয়েছে। নাগরাকাটার ‘চ্যাংমারি টি এস্টেট’-এ, যা এ রাজ্যের সবথেকে বড় চা বাগান, তা ডলোমাইট দূষণে বিধ্বস্ত। ভুটান থেকে আসা নদীগুলোতে ডলোমাইটের দূষণ ক্রমশ বাড়ছে, সে-কথা বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এই বন্যা চোখে আঙুল দিয়ে সেই বিপন্নতা দেখিয়ে দিল। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, প্রতিবেশী দেশে পাহাড় ধ্বংস অবলীলাক্রমে চলছে। কাজেই বিপদ আরও ঘনিয়ে আসছে।
রাজ্য প্রশাসনের যুক্তির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
ভুটানের নদীর ওপরে থাকা বাঁধের জল উপচে ভাসিয়ে দিয়েছে উত্তরবঙ্গ। রাজ্য প্রশাসনকে ভুটানের তরফ থেকে অনেক পরে সতর্ক করা হয়েছে। সঙ্গতভাবেই প্রশাসনের এই যুক্তিকে আমরা মেনে নিলাম। যদিও ভুটান প্রশাসন অনেকটা আগেই সতর্কবার্তা রাজ্য প্রশাসনকে পাঠিয়েছিল। ভুটান প্রশাসনের সতর্কবার্তা সমাজমাধ্যমে ঘোরাঘুরি করছে, তা দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়, জানিয়েছেন পরিবেশকর্মীরাই। প্রশ্নটা এখানে নয় ভুটান প্রশাসন কেন দেরি করে রাজ্যকে জানাল, প্রশ্নটা হল রাজ্য প্রশাসনের নিজস্ব সেট-আপ তো ছিলই ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’-এর। তাহলে সেই সিস্টেম ঠিক করে কাজ করল না কেন?
আসলে আমাদের দেশে হিমালয়ের কতটা বৃষ্টি হচ্ছে, হিমালয়ের বরফ কতটা গলছে, তার কতটুকু অংশ নদীগুলোকে পুষ্ট করছে, এমন ছোট ছোট জটিল ও নির্ভুল তথ্য রাজ্যের হাতে নেই। সেই তথ্য সংগ্রহ করার পরিকাঠামো রাজ্যে এখনও তৈরি করে উঠতে পারেনি। কাজেই অসম্পূর্ণ ভাবেই আমাদের উত্তরবঙ্গের নদীগুলোকে নিয়ে চর্চা করতে হয়।
এখনও পর্যন্ত আমাদের ‘হিমালয়ান পলিসি’ বা হিমালয় নীতি ঠিকঠাক তৈরি হয়নি। উত্তরবঙ্গের নদীগুলোর নদীখাত পলিতে বোঝাই। প্লাবনভূমি আর নদীখাত– দুটোকেই আলাদা করা যায় না। কাজেই হিমালয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উত্তরবঙ্গের নদীগুলোর জন্য নিজস্ব নদী-নীতির প্রয়োজন। যেহেতু উত্তরবঙ্গের ৭০টি নদী ভুটান থেকে এই রাজ্যে প্রবেশ করেছে, কাজেই এই ‘ট্রান্সবাউন্ডারি’ নদীগুলোর ক্ষেত্রে নদী-নীতি তৈরির পূর্বে ‘যৌথ নদী কমিশন’ গঠন করা প্রয়োজন। সে-ক্ষেত্রে পরিবেশকর্মীদের পরামর্শ যেন অবশ্যই গ্রহণ করা হয়।
………………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন সুপ্রতিম কর্মকার-এর অন্যান্য লেখা
………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved