Robbar

এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 14, 2025 6:04 pm
  • Updated:September 15, 2025 4:50 pm  

৩৭টি মিশন। দীর্ঘ ১৮ বছরের অবরোধ। সাত দশকের নির্মম অবৈধ দখলদারি। বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী দেশগুলোর মদতপুষ্ট এক গণহত্যাকারী রাষ্ট্র বনাম বিশ্বজুড়ে লাখো লাখো মুক্তিকামী মানুষ। হাজার ঝঞ্ঝা পেরিয়েও তাই এই মিশন বন্ধ হয় না। যেমন সমস্ত শক্তি দিয়ে হাসপাতাল-বাড়ি-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-বিমানবন্দর-অলিভবন গুঁড়িয়ে দিয়েও ফিলিস্তিনকে শেষ করে দেওয়া যায়নি। তেমনই ফিলিস্তিনের মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে বারবার নিজেদের জীবন বাজি ধরেছেন বিভিন্ন প্রান্তের মেহনতি মানুষ। যে পতাকাকে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল ইজরায়েল, যে ইতিহাস মুছে দিতে চায় জায়নবাদ, যে মানবিক সম্পর্কগুলিকে নিঃশেষ করে ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করতে তৎপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা– সেই পতাকা, সেই ইতিহাস, সেই বিপ্লবী সংহতি বুকে নিয়েই এবার আবার শুরু হয়েছে নতুন মিশন: ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’।

ঝিলম রায়

৪৫টি দেশ। ১০০০ মানুষ। ৫০টি জাহাজ। ৩০০০ কিলোমিটার।

জাহাজ বোঝাই শুকনো খাবার, বেবি ফর্মুলা, ওষুধ, আর এক সমুদ্দুর প্রত্যয়।

সমুদ্রের ওপারে ৪,০০,০০০ ভুখা মানুষ, লাখো লাখো নাছোড়বান্দা লড়াকু প্রাণ, আর সাত দশকের অদম্য মুক্তির জেদ।

ভুমধ্যসাগরের এপার-ওপারের এই ৩০০০ কিলোমিটারের দূরত্ব পার করতেই এক দশক ধরে একের পর এক অভিযান চলেছে। ফ্রিডম ফ্লোটিলা অভিযান। লক্ষ্য প্রায় তিন দশক ধরে চলা ইজরায়েলের গাজা অবরোধ ভেঙে ফিলিস্তিনের মানুষের কাছে পৌঁছনো। খাবার নিয়ে, জরুরি ওষুধ নিয়ে। এবং সর্বোপরি, ফিলিস্তিনের মানুষদের সংগ্রামী সাহসকে কুর্নিশ জানানোর সংহতির বার্তা নিয়ে। আপাতভাবে খুবই সামান্য, খুবই সাধারণ এই লক্ষ্য হলেও এই সামান্য মানবিক অভিযানই প্রায় অসাধ্য হয়ে থেকেছে। সেই ২০০৮ থেকে একের পর এক জাহাজ গাজার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেও ২০১০-এর পর থেকে আজ অবধি গাজার তীর পর্যন্ত কেউই পৌঁছতে পারেনি। কখনও ড্রোন আক্রমণে সেই জাহাজ ধ্বংস করা হয়েছে, কখনও সেই জাহাজ মাঝপথে থামিয়ে জাহাজভর্তি মানুষকে খুন করা হয়েছে, অপহরণ করা হয়েছে। তবু অভিযান থামেনি। থামেনি গাজার মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি। প্রতিটা ব্যর্থ মিশন নতুন করে সাহস জুগিয়েছে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর। আবারও বিষম ঝড়ের বায়ে মারের সাগর পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বুক ভরা আশা নিয়ে তীরে অপেক্ষারত গাজার মানুষদের তাঁরা বলেছেন, ‘আমরা আবার ফিরব, ফিরবই। আরও দৃঢ়ভাবে। আরও শক্তি নিয়ে। আরও আরও স্বপ্ন নিয়ে। এই অবৈধ অবরোধ ভেঙে মানুষের ব্যারিকেড গড়ে তুলব। ফিলিস্তিন একদিন মুক্ত হবেই।’

ইজরায়েলের এই অবৈধ অবরোধের ইতিহাস খুঁজতে গেলে চলে যেতে হয় প্রায় ১৯৯১ সালে, যখন ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে দমন করতে প্রথম গাজা থেকে সমস্ত রকম জিনিস এবং মানুষের যাওয়া-আসার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায় জায়নবাদী রাষ্ট্র। এই অবরোধ তখন অস্থায়ী হলেও খুব শিগগিরই তা ইজরায়েলের দখলদারির স্থায়ী নীতিতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে কখনও সেই অবরোধ সাময়িকভাবে তুলতে বাধ্য হলেও, আবার মুক্তি সংগ্রাম তীব্র হলে ইজরায়েল সেই অবরোধ আরও কঠোর করেছে। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ৩৪২ দিন পূর্ণ অবরোধ চলেছে। গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংকের সঙ্গে বিশ্বের সমস্ত সম্পর্ক একটু একটু করে ছিন্ন করেছে ইজরায়েল। ৩৪২ দিন পরে সেই অবরোধ সাময়িকভাবে উঠলেও সেই পর্যায়েও ফিলিস্তিন থেকে যে কোনও পণ্য কিংবা মানুষের আসা-যাওয়াকে ইজরায়েল নিয়ন্ত্রণ করেছে। যে কোনও যাতায়াত ইজরায়েলের সিকিউরিটি চেকপোস্ট পেরিয়ে হয়েছে, ইজরায়েলের অনুমতি নিয়ে হয়েছে। এবং এই অবরোধের, এই নিয়ন্ত্রণের দ্বারা তিলে তিলে তারা ফিলিস্তিনের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। ২০০১-এ ধ্বংস করেছে ফিলিস্তিনের ইয়াসর আরাফাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও। ২০০৭-এ বন্ধ করা হয় রাফা বর্ডার। জল, স্থল, আকাশপথে সমস্ত রকম বাণিজ্যক রাস্তা বন্ধ করে, ফিলিস্তিনের মানুষের যাতায়াতের সমস্ত পথ বন্ধ করে, গাজাকে বিশ্বের সব থেকে বড় কারাগারে পরিণত করেছে ইজরায়েল। বারবার এই অবরোধ দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে ফিলিস্তিনের মানুষদের। তবু ফিলিস্তিনি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহত থেকেছে, যেমন অব্যাহত থেকেছে ইজরায়েলের গণহত্যা, নিরন্তর নৃশংস আক্রমণ। এবং একইভাবে ২০০৮ থেকেই অব্যাহত থেকেছে ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’-র অভিযান। 

২০০৬ সালে ইজরায়েলের লেবানন আক্রমণ জন্ম দেয় ‘ফ্রি গাজা’ মুভমেন্টের। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বেই ২০০৮-এ প্রথম জাহাজ পাড়ি দেয় গাজার উদ্দেশ্যে। ইজরায়েলের অবরোধ ভেঙে সেই দুই জাহাজ গাজায় পৌঁছলেও ২০১০ থেকে আর কোনও জাহাজ পৌঁছে উঠতে পারেনি। ২০১০-এ তুর্কি মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওদের একটি জাহাজ মাভি মারমারা প্রায় ৬০০ ত্রাণকর্মী এবং ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গাজার পথে রওনা হলে গাজা থেকে মাত্র ৭৫ মাইল দূরে সেই জাহাজের উপর আক্রমণ করে ইজরায়েলি সেনা। গভীর রাতে জাহাজে এলোপাথারি গুলি চালিয়ে ১০ জনকে খুন করে তারা। ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারে সেই জাহাজ গায়ের জোরে থামিয়ে সেখানকার যাত্রীদের দিকে গুলি চালায়। নিজেদের বাঁচাতে তখন মরিয়া হয়ে কেউ তুলে নেয় জলের বোতল, কেউ চেয়ার। ত্রাণকর্মীদের বয়ানে ইজরায়েলি সেনা তাঁদের খুন করতেই জাহাজ আক্রমণ করে। হেলিকপ্টারে আরও সেনা সেই জাহাজে নেমে এসে জাহাজের দখল নেয়। ভোররাত থেকে পরের দিন সন্ধে অবধি সেই জাহাজে তাণ্ডব চালায়। জখম মানুষদের কিল, চড়, লাথি মেরে নিপীড়ন চালাতে থাকে। জাহাজে থাকা ডাক্তারদের জখম মানুষদের চিকিৎসা করতে আটকায়। আহত মানুষদের সাহায্য করার অপরাধে গুলি করে জখম করে ডাক্তারদেরও। এরপর সেই জাহাজবন্দি মানুষদের তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আসডডে নিয়ে গিয়ে ডিপোর্টেশনের কাগজে সই করতে চাপ দেওয়া হয়। কাগজে সই করতে নারাজ যাত্রীদের জেলে আটক করে সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাঁদের উপর নির্মম অত্যাচার করতে থাকে। পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক স্তরে এই নিয়ে আলোড়ন শুরু হলে, দীর্ঘ অত্যাচারের পর জীবিত যাত্রীদের তুর্কিতে ফেরত পাঠালেও তাঁদের ফোন, ল্যাপটপ, ক্রেডিট কার্ড ফেরত দিতে অস্বীকার করে ইজরায়েলি সেনা। 

তুর্কি মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওদের জাহাজ মাভি মারমারা

তবু পরের বছর, ২০১১-তে আবারও সমুদ্র পাড়ি দেয় ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’। ১০টি জাহাজ নিয়ে বিভিন্ন দেশের ৩০০ মুক্তিকামী মানুষের তাতে যাওয়ার কথা থাকলেও, ইজরায়েলের চোখরাঙানিতে জাহাজপথের নানা দেশের সরকার সেই জাহাজ রুখতে তৎপর হয়ে ওঠে। মাত্র একটি জাহাজ ১৭ জন যাত্রী এবং ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গাজার উদ্দেশ্যে ছুটলেও, গাজায় পৌঁছনোর আগেই ইজরায়েলি নৌ-বাহিনী সেই জাহাজ হাইজ্যাক করে। আবারও সেই ১৭ জন আন্দোলনকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ চলে এবং আবারও তাঁদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানো হয়। 

২০১৫ সালে ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা ৩’ আবারও সাগর পাড়ি দিলে তারও একই পরিণতি হয়। গাজা থেকে ১০০ মাইল দূরে সেই জাহাজ আটকে আবারও তাঁর যাত্রীদের ৬ দিন আটক রাখে ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স। তারপরেও, ২০১৬-এ ফিলিস্তিনের প্রতিরোধী মেয়েদের সংহতিতে রওনা হয় দুই জাহাজভর্তি নাছোড়বান্দা কিছু মেয়েদের দল। ‘আমাল’ (আশা) ও ‘জায়তুনা’ (অলিভ)– দুই জাহাজভর্তি মেয়েদের এই মিশনের নেতৃত্ব দেন এক ইজরায়েলি মেয়ে, জোহার চেম্বারলেইন রেগেভ। ইজরায়েলে জন্ম হলেও জায়নবাদী বর্ণবাদ এবং জাতিবিদ্বেষের প্রতিবাদে জোহার ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে স্পেনের বাসিন্দা এবং ফ্রিডম ফ্লোটিলা ক্যাম্পেইনের নিরলস কর্মী। সেই জাহাজে জোহারের সহযাত্রী হন আয়ারল্যান্ডের নোবেলজয়ী মাইরিড ম্যাগুইর, নিউজিল্যান্ডের সাংসদ মারামা ডেভিডসন, তুর্কির ক্রীড়াবিদ এবং কোচ সিগডেম টপ কুওগলু। ২০১০-এ মাভি মারমারায় ইজরায়েলি সেনার হাতে খুন হওয়া ১০ জনের মধ্যে ছিলেন সিগডেমের স্বামীও। ২০১৬-র ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে সাগর পাড়ি দেওয়া এই মেয়েদের জাহাজকে দু’ সপ্তাহের মধ্যেই ইজরায়েল আটক করে এবং তাতে সওয়ার মেয়েদের গ্রেপ্তার করে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফেরত পাঠায়। 

২০১৭-তে গাজার মৎসজীবীদের সংহতিতে রওনা হওয়া আরেকটি মিশনকে ইজরায়েলের ড্রোন আক্রমণ করে। তবু ২০১৮ সালে আবারও ‘জাস্ট ফিউচর ফর প্যালেস্টাইন’-এর নেতৃত্বে আবারও ২টি জাহাজ রওনা হয় এবং আবারও তাকে আটকে সেখানকার যাত্রীদের উপর নিপীড়ন চলে। নরওয়ের একটি ফিশিং বোট এই মিশনে যোগ দিলে সেই জাহাজে থাকা ২২ জনকেও গ্রেপ্তার করে ইজরায়েলি সেনা। 

ফিলিস্তিনের কার্টুনশিল্পী নাজি আল-আলির ‘হান্ডালা’

২০২৩ ও ২০২৪-এ ফিলিস্তিনের আক্রান্ত শিশুদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং দালাল মিডিয়ার মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সত্য তুলে ধরতে ইউরোপের বিভিন্ন বন্দরে ঘুরতে বেরয় জাহাজ ‘হান্ডালা’। ১৯৬৯-এ ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক কার্টুনশিল্পী নাজি আল-আলির কলমের আঁচড়ে প্রাণ পাওয়া সেই ছেঁড়া জামা পরা ১০ বছরের বাচ্চাটা– যে মুখ ফিরিয়ে পেছনে হাত দিয়ে পৃথিবীকে জানান দেয়, নিজের দেশে না ফেরা অবধি সে কিছুতেই বড় হবে না। নাজি আল-আলির কথায়, হান্ডালার বয়স ১০। ঠিক যে বয়সে স্রষ্টা নিজে দেশছাড়া হয়েছিলেন ১৯৪৮-এর নাকবায়। সেই থেকে হান্ডালা ১০ বছরেই আটকে এবং শুধুমাত্র দেশে ফিরতে পারলেই সে আবার বড় হওয়া শুরু করবে। সেই থেকে দেশের মাটি ছাড়া বাড়তে না চাওয়া বাচ্চাটা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে থেকেছে। প্রতীক হয়ে থেকেছে সমস্ত বে-ঘর হওয়া ফিলিস্তিনি মানুষের ঘরে ফেরার স্বপ্নের, ঘরে ফেরার হকের। একই সঙ্গে প্রতীক হয়ে থেকেছে সাম্রাজ্যবাদীদের পেশ করা নানা আপসকামী সমাধানকে নাকচ করার ফিলিস্তিনি প্রতিস্পর্ধার। ফিলিস্তিনের দেওয়ালে দেওয়ালে, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নিরলস সৈনিক ‘Boycott Divestment Sanction’ (BDS)-এর ম্যাসকট হিসেবে হান্ডালার জনপ্রিয়তা এতই বেড়েছিল যে ১৯৮৭-এ নাজি আল-আলিকে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীকে আজও ধরা না গেলেও সন্দেহের তীর ইজরায়েলের ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘মোসাদ’-এর দিকেই। তবে নাজি আল-আলি নিহত হলেও হান্ডালা আজও বেঁচে আছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধে। তাই হান্ডালার সেই প্রতিরোধ বুকে নিয়েই ফ্রিডম ফ্লোটিলার মিশন চলেছিল ইউরোপের বন্দরে বন্দরে, ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে। 

২০২৫-এর মে মাসে ইজরালের ফিলিস্তিনে গণহত্যা আরও নৃশংস রূপ নিলে আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে ‘কনসায়েন্স’ সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু সফর শুরুর আগেই মাল্টার তীরের ঠিক ১৪ মাইল দূরে পর পর দু’টি ড্রোন আক্রমণ চালিয়ে সেই জাহাজ পুড়িয়ে দেয় ইজরায়েল। জাহাজে থাকা সংগঠকরা বাধ্য হয় জলে নেমে সেই জাহাজ ছাড়তে। সেই আক্রমণে আহত হন ৪ জন। 

ইতিমধ্যে অবশ্য ইজরায়েলের নিরন্তর আক্রমণে ফিলিস্তিন প্রায় ধ্বংসস্তূপ। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ইজরায়েলি ড্রোন ধ্বংস করছে সেখানকার হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অলিভ বন, ঘরবাড়ি, দোকান। খুন করছে শিশুদের। খুঁজে খুঁজে খুন করছে সাংবাদিকদের। ফিলিস্তিনে এখন আর একটিও বিশ্ববিদ্যালয় অবশিষ্ট নেই। ৯৭% শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন ধ্বংসস্তূপ। শুধু মাত্র একটি হাসপাতাল এখনও টিমটিম করে দাঁড়িয়ে আছে। ইউনিসেফের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২৩-এর অক্টোবর থেকে আজ অবধি ইজরায়েল ফিলিস্তিনের ৫০,০০০ শিশুকে হত্যা করেছে। উপস্থিত সাক্ষী এবং ডাক্তারদের বয়ান অনুযায়ী এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইজরায়েলি স্নাইপার সচেতনভাবে কাছ থেকে টার্গেট করেই এই খুনগুলো করেছে। ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে ২৭৩ জনের বেশি সাংবাদিককে। ইজরায়েলি রাষ্ট্র, বারবার আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফিলিস্তিনের মানুষদের ‘human animal’ দাগিয়ে ঘোষণা করেছে ফিলিস্তিনকে নির্মূল করা অবধি তাদের এই গণহত্যা চলবে। যতবার যুদ্ধবিরতির ডাক উঠেছে ততবার চুক্তিভঙ্গ করেছে ইজরায়েল। এমনকী গাজায় অনাহারে থাকা মানুষদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ‘গাজা হিউম্যানিটিরিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামক ইজরায়েলের একটি সংগঠন ত্রাণ দেওয়ার নামে সেখানকার ক্ষুধার্ত মানুষদের ইজরায়েলের স্নাইপারদের সামনে দাঁড় করাচ্ছে। ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের উপর গুলি চালাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। প্রতিদিন বিশ্ববাসীর ঘুম ভাঙছে লাইভ টেলিকাস্ট হওয়া গণহত্যার ছবি দেখে; বাবা-মায়ের সন্তানের শব জড়িয়ে হাহাকারের ছবি দেখে; ধ্বংসস্তূপে সব হারিয়ে বসে থাকা মানুষের ছবি দেখে; ক্ষুধার্ত শিশুদের ঘাস খেতে দেখার নির্মম দৃশ্যে; এবং একইসঙ্গে ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স, এমনকী ইজরায়েলি সাধারণ মানুষের ফিলিস্তিনের ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে, লাশের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করার হাড়হিম করা সব লাইভ স্ট্রিমে। আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালতে ইজরায়েলের দীর্ঘ যুদ্ধপরাধের শুনানি চলাকালীন নেতানিয়াহুর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও এই আক্রমণ, এই গণহত্যা চলতে থেকেছে। উল্টে, ফিলিস্তিনের সংহতিতে থাকা ইরান, লেবানন-সহ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও ইজরায়েল হামলা শানিয়েছে। তবু বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ অব্যাহত থেকেছে। পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাস, জেল রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্ত হুমকি উপেক্ষা করেই ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে ব্যারিকেড গড়েছে মানুষ। বয়কট করেছে ইজরায়েলের এই গণহত্যার পৃষ্ঠেপোষক সমস্ত কোম্পানিকেও। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা গড়ে তুলেছে ব্যারিকেড। প্রতিবাদে মুখর হয়েছে তেল আভিভের মানুষও। ইজরায়েলি যুব সমাজের একাংশ প্রতিবাদে সেনায় নিয়োগ হওয়ার বাধ্যতামূলক আইন অমান্য করছে। 

ইজরায়েলের নিরন্তর আক্রমণে ফিলিস্তিন প্রায় ধ্বংসস্তূপ

সেই বিশ্বজুড়ে চলা প্রতিরোধের আগুনেই মে মাসে বিবেকে আগুন জ্বালালে, জুন মাসেই আবারও প্রস্তুত হয় ফ্রিডম ফ্লোটিলার জাহাজ, ‘ম্যাডলিন’। গাজার প্রথম জেলেনির নামে। ইজরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিদিনের সংগ্রামকে কুর্নিশ জানাতে সেই সংগ্রাম, সেই প্রতিরোধী স্পর্ধা বুকে নিয়ে গাজার উদ্দেশে ছোটে ম্যাডলিন। ম্যাডলিনে সওয়ার হন সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। ব্রাজিলের আন্দোলনকর্মী থিয়াগো আভিলা। ফ্রান্সের সংসদ সদস্য, ১৯৪৮-এ ইজরায়েলের নাকবা গণহত্যায় ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হয়ে সিরিয়ার এক উদ্বাস্তু ক্যাম্পে জন্মানো রিমা হাসান। ছিলেন আল জাজিরার সাংবাদিক ওমার ফাইয়াদ। তুর্কি-জার্মানির মানবাধিকার কর্মী ইয়াসমিন আকার-সহ আরও অনেকে। উদ্দেশ্য ১৮ বছরের এই অবৈধ অবরোধ ভেঙে মানুষের করিডর তৈরি করা, গাজার ভুখা মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছনো এবং সর্বোপরি, বিশ্বজুড়ে সমস্ত সরকারের ও বড় বড় কর্পোরেটদের এই গণহত্যায় ইজরায়েলের মদত দেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সাত দিনের মধ্যেই গাজা থেকে মাত্র ১৮৫ কিলোমিটার দূরত্বে ইজরায়েল সেই জাহাজ আক্রমণ করে সেই জাহাজে থাকা সমস্ত মানুষকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের ফোন সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ ছিন্ন করে, তাঁদের অপহরণ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত গিভন জেলে আটক করে। সেই জেলে আটক বন্দিদের দিনের পর দিন অত্যাচার করা হয়। জেলের দেওয়ালে ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ লেখার অপরাধে রিমাকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে পাঠানো হয়। একইভাবে ইজরায়েলের কোর্টে বন্দিদের হাজির করলে সেই কোর্টের সামনে ইজরায়েলের সমস্ত অপরাধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য সলিটারি কনফাইনমেন্টে পাঠানো হয় থিয়াগো আভিলাকেও। প্রতিবাদে তিনি নির্জলা অনশন শুরু করেন। ম্যাডলিনের সাথীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদে মুখর হয়ে গোটা বিশ্ব। নিজের নিজের দেশের সরকার মুখ ফিরিয়ে নিলেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামে। সেই প্রতিবাদের চাপে সেই ফ্লোটিলার সমস্ত যাত্রীদের একে একে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয় ইজরায়েল। 

জলপথের ৩৬টি মিশন ব্যর্থ হলে, এ বছরের জুন মাসেই কাইরো থেকে রাফা বর্ডার খোলার তাগিদে ৩২টি দেশের মানুষ ইজিপ্টে জড়ো হয় মিছিল করে গাজা পৌঁছনোর চেষ্টায়। বাস ভর্তি মানুষ আসে আলজিরিয়া, টিউনিসিয়া, তুর্কি, আয়ারল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, কিউবা, নিকারাগুয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপিনস-সহ নানা দেশ থেকে। সেই সমস্ত দেশ যাঁদের মাটি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে রক্তস্নাত। যাঁরা নিজেদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। সেই মিশনে সামিল হন ফ্রিডম ফ্লোটিলার প্রতিনিধিরাও। এই বিপুল জনসমুদ্র কোনওমতে কাইরো পৌঁছলেও ইজরায়েলের চোখরাঙানিতে সমর্পণ করে ইজিপ্ট সরকার সেই মিশন আটকে দেয়। 

ম্যাডলিন জাহাজে গ্রেটা থুনবার্গ

‘ম্যাডলিন’ ব্যর্থ হলেও জুলাইতেই আবার রওনা হয় ‘হান্ডালা’। এই মিশনে অংশগ্রহণ করেন আমাজনের লেবার ইউনিয়নের সংগঠক ক্রিস স্মলস-সহ বিভিন্ন দেশের ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠক, সাংবাদিক, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা। এই জাহাজ বন্দর ছাড়ার আগেই দু’বার এই মিশন বানচাল করার চেষ্টা চলে। তবু নাছোড় মানুষের দল জাহাজ নিয়ে সাগর পাড়ি দেয়। গাজার কাছাকাছি আসতেই আবারও তাঁদের আটক করা হয়। কুখ্যাত গিভন জেলে তাঁদের উপর অত্যাচার চলে। তাঁদের উকিলের কথায়, ক্রিসকে আলাদা করে চিহ্নিত করে অত্যাচার করা হয়। আবারও বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয় হান্ডালার যাত্রীদের মুক্তির দাবিতে। আবারও তাঁদের প্রত্যেককে নিজে দেশে পাঠানো হয়।

৩৭টি মিশন। দীর্ঘ ১৮ বছরের অবরোধ। সাত দশকের নির্মম অবৈধ দখলদারি। বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী দেশগুলোর মদতপুষ্ট এক গণহত্যাকারী রাষ্ট্র বনাম বিশ্বজুড়ে লাখো লাখো মুক্তিকামী মানুষ। হাজার ঝঞ্ঝা পেরিয়েও তাই এই মিশন বন্ধ হয় না। যেমন সমস্ত শক্তি দিয়ে হাসপাতাল-বাড়ি-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-বিমানবন্দর-অলিভ বন গুঁড়িয়ে দিয়েও ফিলিস্তিনকে শেষ করে দেওয়া যায়নি।

তেমনই ফিলিস্তিনের মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে বারবার নিজেদের জীবন বাজি ধরেছেন বিভিন্ন প্রান্তের মেহনতি মানুষ। যে পতাকাকে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল ইজরায়েল, যে ইতিহাস মুছে দিতে চায় জায়নবাদ, যে মানবিক সম্পর্কগুলিকে নিঃশেষ করে ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করতে তৎপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা– সেই পতাকা, সেই ইতিহাস, সেই বিপ্লবী সংহতি বুকে নিয়েই এবার আবার শুরু হয়েছে নতুন মিশন: ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’। ‘গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা’, ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন’, ‘মাঘরেব সুমুদ ফ্লোটিলা’ ও ‘সুমুদ নুসানতারা’। ফিলিস্তিনের সংহতিতে কাজ করে যাওয়া এই চারটি বড় মঞ্চ এবং অসংখ্য ছোট সংগঠন ও ব্যক্তি মানুষ একসঙ্গে এসে আবারও প্রস্তুতি নেয় এই অবরোধ ভেঙে মানুষের ব্যারিকেড গড়ে তোলার। আর একটা-দুটো নয়, বিশ্বের ৪৫টি দেশের প্রায় ১০০০ মানুষ, ৫০-এর উপর জাহাজ হাঁকিয়ে রওনা দিয়েছে গাজার উদ্দেশ্যে। ম্যাডলিনের যাত্রী গ্রেটা থুনবার্গ, থিয়াগো আভিলা, ইয়াসমিন আকার প্রত্যেকেই আবার সামিল হয়েছেন এই জাহাজে। সামিল হয়েছেন হান্ডালায় অংশগ্রহণকারী তিন আন্দোলনকর্মী। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া লড়াইয়ের ঐতিহ্য নিয়ে সামিল হয়েছেন নেলসন মান্ডেলার নাতি, মান্ডলা মান্ডেলা। শতাব্দীপ্রাচীন প্রতিরোধের ইতিহাস বুকে নিয়ে সামিল হচ্ছেন ফার্স্ট নেশনের দুই আদিবাসী মেয়ে– ড. সুজেন শুশ, মকওয়াসিন অগ্নিউ। সেই সমস্ত প্রাচীন মানুষদের বুকের আগুন নিয়ে যাঁদের ভিটেমাটি লাশের উপর দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিমা সভ্যতা। একইসঙ্গে বহু প্রজন্মের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের স্পর্ধা বুকে নিয়ে সামিল হয়েছেন আয়ারল্যান্ড, আলজিরিয়া, টিউনিসিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিপিনসের বহু মানুষ। 

জেনোয়ার বন্দরে এই ঐতিহাসিক জাহাজের যাত্রা শুরুতে প্রায় লক্ষ মানুষের মিছিল হয়। সেখানে ডক শ্রমিকদের ইউনিয়ন থেকে জানানো হয় এই ফ্লোটিলার সঙ্গে ২০ মিনিটও সম্পর্ক ছিন্ন হলে সমগ্র ইউরোপ স্তব্ধ করে দেবেন তাঁরা। বার্তা দেন অন্যান্য শ্রমিক ইউনিয়নকেও ফ্লোটিলার সংহতিতে এই বন্ধে সামিল হতে। তবে জেনোয়ার ডক শ্রমিকদের এই পদক্ষেপ প্রথম নয়। ২০১৯-এ ইজরায়েলের ইয়েমেন হামলার সময় থেকেই তাঁরা ইজরায়েলের উদ্দেশ্যে যাওয়া অস্ত্রবাহী জাহাজে মাল তুলতে অস্বীকার করে আসছেন। তাঁদের সঙ্গে গ্রিস, ফ্রান্স, মরোক্কোর শ্রমিকরাও ইজরায়েলের মদতে রওনা হওয়া সমস্ত অস্ত্রবাহী জাহাজ রুখে দেন। আমেরিকা থেকে ইজরায়েলগামী সমস্ত অস্ত্রবাহী জাহাজের জন্য ইউরোপের বন্দরগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেই বন্দরের শ্রমিকরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জানাচ্ছেন– যদি এই ফ্লোটিলা গাজায় না পৌঁছয়, এবং এখানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে অক্ষত না ফিরে আসেন– তাঁরা এই বন্দর থেকে একটি পেরেকও ইজরায়েল পৌঁছতে দেবেন না। জেনোয়ার শ্রমিকদের দেখাদেখি একই প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন ভেনিসের শ্রমিকরাও। বিশাল মিছিল হয়েছে বার্সেলোনায়। স্পেনের বন্দর থেকে ২২টি জাহাজ চলছে। টিউনিশিয়া থেকে তাঁর সঙ্গে যোগ দেবে আরও আরও জাহাজ। এরপর সিসিলি থেকে জুড়বেন আরও আরও মানুষ। ভুমধ্যসাগরে প্রায় ৫০টিরও বেশি জাহাজের একসঙ্গে মিলিত হয়ে গাজার পথে চলার কথা।

আরবি ভাষায় ‘সুমুদ’ কথাটার অর্থ প্রতিরোধ

বার্সালোনা থেকে টিউনিসিয়া যাওয়ার পথেই অবশ্য দু’দিন ইজরায়েলের ড্রোন আক্রমণ চলে ফ্লোটিলায়। আগুন ধরে যায় দু’টি জাহাজে। একইসঙ্গে ইজরায়েল হামলা শানায় সৌদি আরবের দোহাতেও। তবু যাত্রা থামেনি। আগুন নিভিয়ে জাহাজ মেরামত করতে করতেই সবাই জানিয়েছেন তাঁরা এগিয়ে যাবেন। জাহাজ টিউনিসিয়া পৌঁছলে সেখানে অপেক্ষারত হাজারে হাজারে মানুষ আসেন প্রাণভরা ভালোবাসা আর সংহতি নিয়ে। বন্দর মুখরিত হয় স্লোগানে, ‘With our soul, with our blood, we sacrifice for you, Palestine.’ (আমাদের জান দিয়ে, সমস্ত রক্তবিন্দু দিয়ে, তোমার জন্য লড়ব ফিলিস্তিন)। উল্টোদিকে শোনা যায় ফিলিস্তিনের মানুষের গাজার তীরে ফ্লোটিলাকে অভ্যর্থনা জানাতে বালিতে লিখে রাখা ভালোবাসার বার্তা। ইজরায়েল যখন গাজা শহরকে সম্পূর্ণরূপে ধবংস করার হুমকি দিচ্ছে, তখন এই ভালোবাসার, স্পর্ধার, লড়াইয়ের বিপ্লবী স্বপ্ন ও আশা নিয়েই ফ্লোটিলা এগোতে থাকে। স্পেনের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী প্রতিরোধ নিয়ে, আরব বসন্তের স্পর্ধা নিয়ে, ইতালির পার্টিসানদের ঐতিহাসিক লড়াইয়ের আগুন নিয়ে, আলজিরিয়ার মুক্তি সংগ্রামের ক্রোধ নিয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ-বিরোধী সংগ্রাম নিয়ে, আয়ারল্যান্ডের রক্তাক্ত বিপ্লবী ইতিহাস নিয়ে, ফিলিপিনসের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঐতিহ্য নিয়ে, পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত এক করতে করতে এবং সর্বোপরি, ফিলিস্তিনের ঘাসান কানাফানি থেকে লীলা খালেদ, আহেদ তামিনি থেকে হিন্দ রাজাব, বহু বহু প্রাজন্মিক সাহস নিয়ে। জাহাজের পর জাহাজ চলেছে এই বিশ্বকে আগামীর শিশুদের বাসযোগ্য করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। সাম্রাজ্যবাদ উৎখাত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। মানবমুক্তির দিন বদলের লড়াই নিয়ে। 

আরবি ভাষায় ‘সুমুদ’ কথাটার অর্থ প্রতিরোধ। বিশ্বজুড়ে যখন সমস্ত দেশের সরকার ফিলিস্তিনের জন্য কুম্ভীরাশ্রু ব্যয় করে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, রাষ্ট্রপুঞ্জ যখন শুধুমাত্র কিছু কড়া ভাষায় বিবৃতি দিয়ে দায় সেরে ফেলছে, যখন সভ্যতা ও গণতন্ত্রের গালভরা পাঠ শেখাতে চাওয়া ইউরোপ-আমেরিকা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ইজরায়েলের গণহত্যার মদত দিয়ে যাচ্ছে, যখন সৌদি আরব, ইজিপ্ট-সহ একের পর এক আরব দেশগুলি আমেরিকা ও ইজরায়েলের কাছে সমর্পণ করে মুখে কুলুপ এঁটেছে– তখন নিজেদের দেশের সরকারের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে এগিয়ে চলেছে এই অন্ধকার সময়ের আলোর পথযাত্রীরা। সেই সুমুদের ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে সুদান, কঙ্গো, কাশ্মীর-সহ বিভিন্ন মুক্তি সংগ্রামের প্রতিরোধের স্রোত। সেই দিনবদলের জোয়ারেই জর্ডান নদী থেকে ভুমধ্যসাগর যেন গেয়ে উঠছে– ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে’। আর আমরাও বুক বেঁধে স্বপ্ন দেখছি, একদিন না একদিন নদী থেকে সমুদ্রতক স্বাধীন ফিলিস্তিন আমরা দেখবই।