Robbar

অ্যাসাঞ্জের মুক্তি আবারও জিতিয়ে দিল জনমানসের বাক্-স্বাধীনতাকে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 27, 2024 5:10 pm
  • Updated:June 27, 2024 5:50 pm  

অ‌্যাসাঞ্জ ঠিক করেছেন না কি ভুল, সেই বিতর্ক সহজে শেষ হওয়ার নয়। তবে গোপন সামরিক তথ‌্য ফাঁস করার কৌশল যে বরাবর আমেরিকাই গ্রহণ করে থাকে, সেই অভিযোগও পাল্টা উঠেছে। ১৯৬২ সালে কিউবা সংকটের সময় রাষ্ট্রসঙ্ঘে আমেরিকার কেনেডি প্রশাসন প্রথম ফাঁস করেছিল কিউবায় অবস্থিত সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাঁটির ছবি। মার্কিন সেনার নজরদারি ‘ইউ-টু’ বিমান আকাশ থেকে সেই ছবি তুলেছিল। কেনেডি প্রশাসন কিউবার বুকে সোভিয়েত সামরিক ঘাঁটির ছবি প্রকাশ্যে এনে বিশ্বের জনমত বদলে দিয়েছিল। গোপন সামরিক তথ্যের মাহাত্ম‌্য বুঝেছিল গোটা দুনিয়া।

সুতীর্থ চক্রবর্তী

লন্ডনের কুখ্যাত বেলমার্শ কারাগারের অন্ধকার কুঠুরি থেকে ১৯০১ দিন পর আচমকাই মুক্তি ঘটল উইকিলিক্‌স কর্তা জুলিয়ান অ‌্যাসাঞ্জের।

গত ১৪ বছর ধরে, প্রথমে ন’বছর লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে ও পরে পাঁচ বছর বেলমার্শ কারাগারে, অ‌্যাসাঞ্জের বন্দি থাকার জীবন যতটা নাটকীয়, ততটাই নাটকীয় তাঁর মুক্তিও। কিছুদিন আগেই ব্রিটিশ সরকার অ‌্যাসাঞ্জকে আমেরিকায় প্রত্যর্পণে রাজি হচ্ছিল না এই আশঙ্কা থেকে যে, মার্কিন আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। সংবাদমাধ‌্যমে লেখা হচ্ছিল যে, যদি অ‌্যাসাঞ্জের মৃত্যুদণ্ড না-ও হয়, তাহলে গোপন সামরিক তথ‌্য পাচারের অভিযোগে মার্কিন আদালতে তাঁর অন্তত ১৭৫ বছরের কারাদণ্ড হবেই!

Julian Assange banned from returning to US without permission, pleads guilty for leaking America's national secrets - Hindustan Times
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ

এই ধরনের নানারকম আশঙ্কা ও জল্পনার মধ্যেই আচমকা অ‌্যাসাঞ্জের মুক্তির খবর পেল গোটা দুনিয়া। এবং সব কিছুই খুব দ্রুত ঘটে গেল। মঙ্গলবার জানা গেল, বেলমার্শ কারাগার থেকে অ‌্যাসাঞ্জ সোজা প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান মারিয়ানা আইল‌্যান্ডসের সাপিয়ান দ্বীপে উড়ে গিয়েছেন। কারণ, মূল মার্কিন ভূখণ্ডে যেতে রাজি নন অ‌্যাসাঞ্জ। অস্ট্রেলিয়ার নিকটতম এই সাপিয়ান দ্বীপটিই শেষ বিচারের জন‌্য অ‌্যাসাঞ্জের পছন্দ। মূল মার্কিন ভূখণ্ডে না হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এই দ্বীপটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। এখানকার মার্কিন আদালতেই বুধবার অ‌্যাসাঞ্জকে হাজির করানো হয়। মাত্র তিন ঘণ্টায় অ‌্যাসাঞ্জের বিচারপর্ব শেষ। আরও তিন ঘণ্টার উড়ানে তিনি বুধবারই পৌঁছলেন অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক‌্যানবেরায়। বেলমার্শ কারাগার থেকে অ‌্যাসাঞ্জের মুক্তির খবর বিশ্ব যখন শুনল, তার ঠিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক‌্যানবেরা বিমানবন্দরে দেখা গেল সেই অসাধারণ ছবি, দেশে ফিরে আনন্দে চুম্বনরত স্ত্রীকে কার্যত কোলে তুলে নিলেন অ‌্যাসাঞ্জ।

Julian Assange passionately kisses wife and waves to supporters after landing back in Australia | World News | Sky News
বিমানমন্দরে স্ত্রীর সঙ্গে অ্যাসাঞ্জ

১৪ বছরের এই নাটকীয় ঘটনার শেষ অঙ্কটির যে এত দ্রুত পরিসমাপ্তি ঘটবে, তা অকল্পনীয় ছিল দুনিয়ার কাছে। অ‌্যাসাঞ্জের মুক্তির জন‌্য গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন আদালতের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সেই চুক্তিটাই বড় কথা নয়। এই মুক্তির নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ‌্যান্থনি আলবানিজ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক আদানপ্রদান। অ‌্যাসাঞ্জের মুক্তির পর বলা হচ্ছে, এটা সম্ভব হল কূটনীতি, রাজনীতি ও আইনের বিরল সমন্বয়ে।

কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও প্রকাশক অ‌্যাসাঞ্জ তাঁর উইকিলিক্‌স নামক ওয়েবসাইটে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ৫ লক্ষের ওপর গোপন তথ‌্য প্রকাশ করেছেন। এসবই ছিল ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকার সামরিক অভিযান সংক্রান্ত। এছাড়া উইকিলিক্‌স-এ অ‌্যাসাঞ্জ প্রকাশ করেছেন আমেরিকার লক্ষ লক্ষ গোপন কূটনৈতিক কেব্‌ল বা টেলিগ্রাম। যেগুলি প্রধানত চিন ও ইরান সম্পর্কিত। উইকিলিক্‌স-এ ফাঁস হওয়া তথ্যের মধ্যে সবচেয়ে হইচই ফেলেছিল যেটি, তা হল ২০০৭ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের একটি ভিডিও। যেখানে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন সেনার একটি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে ১২ জন নিরীহ নাগরিককে হত‌্যা করা হচ্ছে। যাঁর মধ্যে ছিলেন রয়টার্সের দু’জন সাংবাদিক!

অ‌্যাসাঞ্জ তাঁর উইকিলিক্‌স-এ মার্কিন সেনার গোপন তথ‌্য ফাঁস করে বরাবর দাবি করেছেন যে, তিনি সাংবাদিক হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাক্‌-স্বাধীনতার কথা বলেছেন। যে বাক্‌-স্বাধীনতার অধিকার মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনী তথা ‘ফার্স্ট অ‌্যামেন্ডমেন্ট’-এ দেওয়া রয়েছে।

অ‌্যাসাঞ্জ ঠিক করেছেন না কি ভুল, সেই বিতর্ক যদিও সহজে শেষ হওয়ার নয়। তবে গোপন সামরিক তথ‌্য ফাঁস করার কৌশল যে বরাবর আমেরিকাই গ্রহণ করে থাকে, সেই অভিযোগও পাল্টা উঠেছে। ১৯৬২ সালে কিউবা সংকটের সময় রাষ্ট্রসঙ্ঘে আমেরিকার কেনেডি প্রশাসন প্রথম ফাঁস করেছিল কিউবায় অবস্থিত সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাঁটির ছবি। মার্কিন সেনার নজরদারি ‘ইউ-টু’ বিমান আকাশ থেকে সেই ছবি তুলেছিল। কেনেডি প্রশাসন কিউবার বুকে সোভিয়েত সামরিক ঘাঁটির ছবি প্রকাশ্যে এনে বিশ্বের জনমত বদলে দিয়েছিল। গোপন সামরিক তথ্যের মাহাত্ম‌্য বুঝেছিল গোটা দুনিয়া।

সম্প্রতি ইউক্রেন সীমান্তে পৌনে দু’লক্ষ রুশ সেনা সমাবেশের গোপন ছবি প্রকাশ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পুতিনের সমর অভিযানের প্রস্তুতির খবর দুনিয়াকে আগাম জানিয়েছিলেন। রাশিয়ার যুদ্ধ-প্রস্তুতির আরও গোপন তথ‌্য প্রকাশ্যে আনে মার্কিন সেনাবাহিনী।  যা ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই পুতিনের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনে সহায়ক হয়।

………………………………………………………

গোপন তথ‌্য ফাঁসের ঝুঁকির দিকও থাকে। গোপন তথ‌্য প্রকাশ্যে এলে তা বহু সময় তথ্যের সূত্র বা সোর্সকে চিহ্নিত করে দেয়। সোর্স উন্মুক্ত হয়ে পড়া সবসময় বিপজ্জনক। এটা যেমন সোর্সের জীবনের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তেমন গুপ্তচরবৃত্তির পেশাকেই বিপজ্জনক করে তোলে। অ‌্যাসাঞ্জ তাঁর উইকিলিক্‌স-এ গোপন সামরিক তথ‌্য ফাঁস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামো-সহ বহু সোর্সকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।

………………………………………………………

জুলিয়ান অ‌্যাসাঞ্জকে যখন ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের নানা গোপন সামরিক তথ‌্য প্রকাশ করে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তখন বুশ প্রশাসন থেকে শুরু করে ওবামা প্রশাসন– বারবার সিআইএ-র পাওয়া নানা তথ‌্য মিডিয়ায় ফাঁস করে দিয়ে নিজেদের নীতির পক্ষে বিশ্বজনমতকে আনার চেষ্টা করেছে। গোপন সামরিক তথ্যের নামে কখনও কখনও মার্কিন প্রশাসনের তরফে ভুয়া তথ‌্য ফাঁসের অভিযোগও উঠেছে। বাইডেনের আমলে গোপন তথ‌্য ফাঁস করা মার্কিন কূটনীতির প্রধানতম কৌশল হয়ে উঠেছে। জাতীয় নিরাপত্তা যখন একটি অত‌্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তখন এই সংক্রান্ত তথ‌্য কেন সাধারণ মানুষের বিতর্কের  মধ্যে আনা হবে না, এই প্রশ্ন গণতন্ত্র ও বাক্‌-স্বাধীনতার পক্ষে থাকা জনতার তরফে সবসময় তোলা হয়।

তবে মনে রাখতে হবে, গোপন তথ‌্য ফাঁসের ঝুঁকির দিকও থাকে। গোপন তথ‌্য প্রকাশ্যে এলে তা বহু সময় তথ্যের সূত্র বা সোর্সকে চিহ্নিত করে দেয়। সোর্স উন্মুক্ত হয়ে পড়া সবসময় বিপজ্জনক। এটা যেমন সোর্সের জীবনের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তেমন গুপ্তচরবৃত্তির পেশাকেই বিপজ্জনক করে তোলে। অ‌্যাসাঞ্জ তাঁর উইকিলিক্‌স-এ গোপন সামরিক তথ‌্য ফাঁস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামো-সহ বহু সোর্সকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।

………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন সুতীর্থ চক্রবর্তী-র লেখা: ভারতীয় রাজনীতিতে ‘রাহুল-যুগ’ কি আর শুধুই অলীক কল্পনা?

………………………………………………………………………………………

অ‌্যাসাঞ্জের মুক্তি নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে তাতে অ‌্যাসাঞ্জকে মার্কিন আদালতে দাঁড়িয়ে তাঁর দোষ কবুল করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তথ‌্য পাচারের যে ধারায় অ‌্যাসাঞ্জকে অভিযুক্ত করা হয়, মার্কিন আইনে তাঁর সর্বোচ্চ সাজা ৬২ মাসের জেল। ২০১০-এ উইকিলিক্‌স-এ অ‌্যাসাঞ্জ লক্ষ লক্ষ মার্কিন সামরিক ও কূটনৈতিক  গোপন তথ‌্য প্রকাশের পর সুইডেনে যৌন নিগ্রহের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। সুইডেন সরকারের হাত থেকে বাঁচতে তিনি লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই দূতাবাসে আশ্রয়ের সময় তাঁর বিয়ে এবং দুই কন‌্যার জন্ম।

……………………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………………………

২০১৯-এ মার্কিন চাপেই ইকুয়েডর দূতাবাস থেকে তাঁকে বহিষ্কৃত হতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ সরকার। সেই থেকে তাঁর ঠিকানা ছিল বেলমার্শ কারাগারের অন্ধকার কুঠুরি। যেহেতু বেলমার্শ কারাগারে ৬২ মাস অ‌্যাসাঞ্জ কাটিয়ে ফেলেছেন, তাই প্রশান্ত মহাসাগরের নির্জন দ্বীপ সাপিয়ানের আদালতে দোষ কবুল করতেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। অ‌্যাসাঞ্জের মুক্তির সঙ্গে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে কূটনীতি, আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতি ও মার্কিন আইনের যে মারপ্যাঁচ জড়িয়ে থাকুক না কেন, এটা দুনিয়া জুড়ে বাক্‌-স্বাধীনতার লড়াইকেই ফের জয়ী করল।