৬ অক্টোবর কামদুনি কাণ্ডের রায়ে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী ও বিচারপতি অজয় কুমার গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চ পূর্বের রায় খারিজ করে সাজাপ্রাপ্ত ছয় জনের মধ্যে (একজন ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত-সহ) চারজনকে বেকসুর খালাস ও বাকি দু’জনের যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে। রায়ে চার আসামীর মুক্তি প্রসঙ্গে এই বেঞ্চ জানায়, ধর্ষিতার ক্ষত যথেষ্ট ‘গভীর এবং নৃশংস’ ছিল না। তবে কি নির্ভয়ার মতো অন্ত্রের ৫ শতাংশ অবশিষ্ট থাকা অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হলে তবেই সুবিচার পাওয়া যাবে? আর ক্ষত না খুঁজে পাওয়া গেলে বা ‘যথেষ্ট’ মারাত্মক না হলে?
রাজ্যে ধর্ষণের ইতিহাস জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে অনেক নাম। বিরাটি, বানতলা, কামদুনি– এই নামগুলো শহরপট বিদীর্ণ করেছে, যখনই শাসক-বিরোধী চাপানউতর খবরের মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে। ঠিক যেমন পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড। কামদুনির ঘটনা খুবই ‘ছোট’ হয়ে যায়, বিধান সরণির ঘটনায় তরুণীর বক্তব্যে ‘অসংগতি’ খুঁজে পাওয়া যায়। একের পর এক কেসে তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে টালবাহানা ও প্রশাসনের যে অসহযোগিতা ও অস্বচ্ছতা প্রকাশ পায়, তা নির্যাতিতার ন্যায়বিচারকে আরও দীর্ঘায়িত করে। অর্থাৎ কি না রাষ্ট্রের চোখে, সমাজের চোখে ধর্ষণের মাপকাঠিতে ‘কাদম্বিনী মরিয়াও’ প্রমাণ করিতে পারে না যে সত্যিই নির্যাতন হয়েছিল। সমাজের নির্লজ্জ দাঁড়িপাল্লায় মাপা হতে থাকে ‘তীব্রতা’, যেখানে ধর্ষিতার চারিত্রিক ‘পবিত্রতা’ বারবার হয়ে ওঠে ধর্ষণের গুরুত্ব মাপার সূচক। মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা সর্বতোভাবে যে কোনও প্রগতিমনষ্ক সমাজের স্বাভাবিক অবস্থান হওয়া উচিত, কিন্তু এই রায়ে ফাঁসির আদেশ রদের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে ফাঁসির আদেশের অনুপযোগী নৃশংসতার অনুপস্থিতির কথা, অর্থাৎ মরেও তরুণী রাষ্ট্রীয় মাপকাঠিতে সর্বোচ্চ নৃশংসতা প্রমাণ করতে পারলেন না, এই হল মোদ্দা কথা।
ঠিক এইখানেই অশনি সংকেতটি চিহ্নিত করা প্রয়োজন। যে ‘ক্ষত’ খোঁজা নিয়ে এত শোরগোল, সেই ক্ষত খুঁজে পেলেও সমস্যা মেটে না। ২০১৩ সালের ৭ জুন। উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসাত থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে, কলেজে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কামদুনির তরুণী গণধর্ষিত হয় ও শেষ পর্যন্ত তার ক্ষতবিক্ষত শরীর পাওয়া যায় এক পাঁচিল ঘেরা পরিত্যক্ত এলাকায়। গোটা রাজ্য শিউরে ওঠে এই ঘটনায়। গোটা দেশের গায়ে দগদগে ঘায়ের মতো তখনও জ্বলছে ২০১২ সালের দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের কথা।
রাজ্যজুড়ে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়, ১০ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী কামদুনিতে পৌঁছে নির্যাতিতার পরিবার ও বিক্ষোভরত গ্রামবাসীদের প্রতিশ্রুতি দেন দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। অভিযুক্ত ১০ জন অপরাধীকে গ্রেফতার ও মামলা রুজু করা হয়। প্রথমে বারাসত আদালতে এবং তারপর নগর দায়রা আদালতে মামলা স্থানান্তরিত হয়েছিল। সিআইডি তদন্ত রিপোর্ট ও সাক্ষীসাবুদের ভিত্তিতে তিনজন অভিযুক্তের ফাঁসি ও তিনজন অভিযুক্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল নগর দায়রা আদালত।
আরও পড়ুন: আইন-আদালত কি আর বিবেক জাগ্রত করতে পারে?
৬ অক্টোবর কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী ও বিচারপতি অজয় কুমার গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চ পূর্বের রায় খারিজ করে সাজাপ্রাপ্ত ছয় জনের মধ্যে (একজন ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত-সহ) চারজনকে বেকসুর খালাস ও বাকি দু’জনের যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে। রায়ে তিন আসামীর মুক্তি প্রসঙ্গে এই বেঞ্চ জানায়, ধর্ষিতার ক্ষত যথেষ্ট ‘গভীর এবং নৃশংস’ ছিল না। তবে কি নির্ভয়ার মতো অন্ত্রের ৫ শতাংশ অবশিষ্ট থাকা অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হলে তবেই সুবিচার পাওয়া যাবে? আর ক্ষত না খুঁজে পাওয়া গেলে বা ‘যথেষ্ট’ মারাত্মক না হলে? কামদুনির রায়ে নির্লজ্জভাবে লেখা হচ্ছে যে, দু’জন ছাড়া বাকিদের যা ‘দোষ’, তাতে ৭ বছরের সাজাই ‘যথেষ্ট’ এবং যেহেতু ইতিমধ্যেই ১০ বছর জেল খেটেছেন তারা, তাই তাদের বেকসুর খালাস দেওয়া হল।
হ্যাঁ, হাথরাস বা বিলকিস বানোর কেসের মতো মালা দিয়ে ধর্ষকদের বরণ করা হল না ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্র আরও একবার প্রমাণ করল এই দেশ, এই বিচারব্যবস্থা কেবলই পুরুষকেন্দ্রিক। এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নির্যাতিতার পরিবার তাদের প্রাণনাশের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। সিআইডি ও সরকারি আইনজীবীদের ভূমিকা আজ প্রশ্নের মুখে। এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে নির্যাতিতারা মরেও প্রমাণ করতে পারে না অত্যাচারের তীব্রতা। তবে অভিযুক্তরা যে এই কাজের জন্য গৌরবান্বিত, তা বোঝাই যায় অপরাধ করার পর তাদের উপর্যুপরি বাড়বাড়ন্ত দেখলে। আর করবে না-ই বা কেন? পিছনে আছে পৃষ্ঠপোষক সরকার, পুলিশ, আদালত।
আরও পড়ুন: যে রবীন্দ্র-উপন্যাস ম্যারিটাল রেপের ইঙ্গিতবাহী
এই সংস্কৃতি ও সমাজ যা মেয়েদের যৌন সামগ্রী মনে করে, তার ফলস্বরূপ সমাজে মেয়েদের প্রতি নানারকম অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে চলে। সরকারও তাদের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার জন্যেই এই সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখতে চায়। কেন্দ্র বা রাজ্যের নেতাদের নানা মন্তব্য ও পদক্ষেপ এই ধর্ষণ সংস্কৃতিকে আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠা করে। ‘ঘরে ঢুকে ধর্ষণ’, ‘ছোট ঘটনা’, ‘প্রেমের সম্পর্কের জন্যই হয়েছে’ বা দেশজুড়ে একের পর এক মনুবাদী সংস্কৃতির পরিচয়বাহক পদক্ষেপ (মহিলা কুস্তিগীরদের ক্ষেত্রে, মণিপুর প্রশ্ন-সহ বহু ক্ষেত্রে) ভারতকে ধর্ষণ সংস্কৃতির উদারভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিধান সরণির ঘটনা কামদুনির ঘটনার সঙ্গ ছাড়ে না একটি গুরুতর কারণে। ২০১৪ সালে, এই কলকাতার বুকেই ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, যা সম্পর্কে আমাদের বিস্মৃত হওয়া চলবে না। শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র বিধান সরণি লাগোয়া এবং চাচাজ় হোটেল সংলগ্ন গলিতে একটি সতেরো বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। রাত তখন সাড়ে ৯টা হবে। ঘটনার পরের দিন যখন মেডিকেল টেস্ট করানো হয় মেয়েটির, তখন আর সব পরীক্ষার সঙ্গে তাকে দিতে হয় সেই কুখ্যাত ‘টু-ফিঙ্গার’ টেস্ট। এই পরীক্ষাকে আধুনিক যুগের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ বলা চলে, কারণ এতে যোনিতে আঙুল প্রবেশ করিয়ে বারবার বোঝার চেষ্টা চলে যে, মেয়েটির যা যা বিস্ফারিত-সঙ্কুচিত-অক্ষত-দীর্ণ হওয়ার কথা ছিল, তা আদৌ হয়েছে কি না। বিচারালয়ে ডাক্তার জানান, মেয়েটি যৌনসঙ্গমে ‘অভ্যস্ত’ (ঠিক এইখানে কুযুক্তির তোড়ে হারিয়ে যায় ম্যারিটাল রেপ-এর মতো ইস্যু)। যদি এই কথার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এক মুহূর্তের জন্য সরিয়ে রাখা হয়, তার মানে এই দাঁড়ায়– নিয়মিত যৌনসঙ্গম করলে ধর্ষণ আরেকটি তদমধ্যবর্তী ঘটনা। রায়ে স্পষ্টভাবে লেখা আছে, মেয়েটি চিৎকার করেনি যেহেতু, ধর্ষণ জায়েজ নয়। অর্থাৎ, আইনের ভাষায় ‘বারডেন অফ ট্রুথ’ বইতে হবে ধর্ষিতাকেই। ধর্ষণের সময় সে কতটা চিৎকার করেছিল, বা আদৌ করেছিল কি না, এ জাতীয় নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর ধর্ষিতাকে দিয়ে যেতে হবে, যতক্ষণ না সে ট্রমা সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়া কিন্তু এই ক্ষেত্রে ধর্ষিতার প্রতি কোনও সহানুভূতি আদায় করবে না– বরং ধর্ষিতার বয়ানের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবে, যা সম্পূর্ণভাবে বিচার প্রক্রিয়ার ধরন নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রেও ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ ঠিকমতো পেশ না করা ও সরকারি উকিলের অনুপস্থিতির কারণে অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দিয়ে দেওয়া হল।
ভারতে সাম্প্রতিক কালে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও কম হয়নি। দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর মুখেও এক রা। তবে এই সব আন্দোলনের অন্যতম ফসল হল নারীর পরিচয় ‘মা-বোন’ ও ‘দেবীত্ব’-এ সীমাবদ্ধ করা। সম্প্রতি মোদি সরকারের ‘মাতৃবন্দনা’ যার স্বরূপ। নারী অধিকার, ক্ষমতায়নকে বদলে দেওয়া হয় চার দেওয়ালের মধ্যে ‘দেবী’ মূর্তি বানিয়ে। ধীরে ধীরে এই ন্যারেটিভই প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে– নারী মানে তার চাহিদা নেই, তিনি পবিত্র দেবী, বাড়ির চার দেওয়াল আলো করে রাখা এক নিঃসাড় প্রাণী, অকৃতদ্বার। নারী মানে সিঁদুর, আলতা, বোরখা আর ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকা প্রাণী, এরা থাকবে পুরুষের থেকে নীচে এবং চলবে পুরুষের অঙ্গুলিহেলনে।
এইরূপ মা-বোনদের আরও বৈশিষ্ট্য– তারা দিনে-রাতে কোনও সময়েই একা বেরবে না, প্রেম নিবেদন নৈব নৈব চ আর তার পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি– সব নির্ধারিত হবে পুরুষের অঙ্গুলিহেলনে। তাদের তো পবিত্র থাকতেই হবে, এটা তাদের চরম সৌভাগ্য যে, গৌরবময় পুরুষজাতি তাদের হাতে এই দায়িত্ব তুলে দিয়েছে। কাজেই ‘নির্যাতিতা’-র শরীরে নয়, ক্ষত ভীষণভাবেই খোঁজা প্রয়োজন এই বিচারব্যবস্থা, এই সরকার, এই মহিলা বিরোধী ও মানুষ বিরোধী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে। ২০১২-২০২৩– কেটে গেল এগারোটা বছর। বানতলা ধরলে যোগ করতে হবে আরও বছর ২০। কিছু কি পাল্টাল? ক’টা রাজনৈতিক দল ধর্ষণ রুখতে বয়সভিত্তিক জেন্ডার সেনসিটাইজেশনের দাবি তুলল? বরং বহাল থাকল ধর্ষণকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা, বিরলের মধ্যে বিরলতর প্রমাণ করা বা প্রমাণ খণ্ডানোর আইনি মারপ্যাঁচ। আর কবে, কে বদলাবে সংজ্ঞা– ‘আউটরেজিং দ্য মডেস্টি অফ আ উওম্যান’-কে সরিয়ে কবে উঠে আসবে ‘ভায়োলেটিং দ্য প্রাইভেসি অফ আ উওম্যান উইথ নাথিং বাট কনটেম্পট ফর হার অ্যাজ় আ হিউম্যান লাইফ’?