Robbar

সেই তরুণরা আলোচনায় আসে না, যাদের কল্পজগতে নেই কোনও মনিকা বেলুচ্চি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:April 4, 2024 8:09 pm
  • Updated:April 7, 2024 1:04 pm  

পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্রের বিপ্রতীপে থাকে নারীবাদ। একই সমাজে নারী এবং পুরুষের অবস্থানে যে কত ফারাক তা আমাদের জানা। কিন্তু এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে পুরুষ হলেই যে সমাজের সমস্ত সুবিধা কেউ পাবে, তা নয়। সমকামী পুরুষেরা পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও দশকের পর দশক এই সমাজে তারা ব্রাত্য থেকেছে। একইরকম হেনস্থা জুটেছে রূপান্তরকামী-পুরুষদেরও।

ভাস্কর মজুমদার

২.

দু’হাজার সালের গোড়াতেই খবরটা চারদিকে ভাসছিল। এমন একটা সিনেমা নাকি এসেছে, যা সব ছেলেদের ভালো লাগবে। আর সে-ছবির নায়িকা ‘টাইটানিক’-এর কেট উইন্সলেটের থেকেও সুন্দরী আর খোলামেলা।

কী আছে সেই সিনেমায়? সেটা জানার জন্য তখনকার তরুণদের কল্পনার জগৎ তোলপাড় হচ্ছিল। কিন্তু সেটা কেবল-টিভির যুগ। ভিসিআর সে-সময় বিলুপ্তির পথে। ভিসিডি সবে সবে আসছে। অতএব কিছুতেই সিনেমাটার হদিশ মিলছিল না। আর সে-সময়ের তারুণ্যের যে নিষিদ্ধ জগৎ– সেই এফটিভি বা চ্যানেল সিক্সেও ফিল্মটা দেখাবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। এর বেশ কয়েক বছর পর যখন ডাউনলোডিং-এর সংস্কৃতি বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, তখন আমাদের দেখার সুযোগ হল জিউসেপ তোরনাতোরের ‘ম্যালেনা’।

Malena | Rotten Tomatoes

মোনিকা বেলুচি-র অপার্থিব সৌন্দর্য সেই সময়ের বহু তরুণকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আর ‘ম্যালেনা’ সিনেমার যে গল্প, সেটাও রেসোতো আমোরোসো-র নামের এক তরুণেরই গল্প। সেই তরুণের কল্পনার জগৎ ছেয়ে থাকে ম্যালেনা (মোনিকা বেলুচি)। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ম্যালেনার শারীরিক সৌন্দর্য। দু’তরফই খুব তাড়াতাড়ি ‘পুরুষ’ হয়ে উঠতে চাইত।

এই পুরুষ হয়ে ওঠার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মনস্তত্ত্ববিদেরা আজ বহু দশক এসব নিয়ে চর্চা করছেন।

পুরুষের নিজস্ব যৌনতা গড়ে ওঠা, তার সমাজ ও সংস্কৃতির কতটা পরিপূরক, তা সম্বন্ধে আমাদের অল্পবিস্তর ধারণা আছে ফ্রয়েডের জন্য। শুধু ‘ম্যালেনা’র রেসোতো নয়, কিয়সলস্কির ‘আ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট লাভ’-এর টোমেক বলে চরিত্রটি কিংবা কেতন মেহতা-র ‘মায়া মেমসাব’-এর ললিত– এমন অনেক চরিত্রই তখনকার মিডিয়াতে ছিল, যেখানে একজন তরুণের পুরুষ হয়ে ওঠা আসলে তার থেকে বয়সে বড় কোনও নারীর সঙ্গপ্রাপ্তি।

Deepa Sahi on intimate scenes with SRK in 'Maya Memsaab': Did get giggly at first - India Today

বাংলা সাহিত্যেও এমন হাজারও উদাহরণ আছে। কিন্তু পৌরুষের আলোচনায়, তার বেড়ে-গড়ে ওঠায় সব সময়ই দেখা গেছে কেবল তথাকথিত ‘স্ট্রেট’ (বিসমকামী) পুরুষের তারুণ্য-যৌবন নিয়েই কথা হয়েছে। একজন ‘স্ট্রেট’ তরুণ কী করে নিজেকে গড়ে তোলে, অথচ একই বয়সের ভিন্ন যৌনতার ছেলেগুলো কীভাবে নানা হেনস্তা-হিংসার শিকার হয়, তা আমরা কখনও আলোচনাযোগ্য বলেই মনে করিনি।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

মোনিকা বেলুচি-র অপার্থিব সৌন্দর্য সেই সময়ের বহু তরুণকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আর ‘ম্যালেনা’ সিনেমার যে গল্প, সেটাও রেসোতো আমোরোসো-র নামের এক তরুণেরই গল্প। সেই তরুণের কল্পনার জগৎ ছেয়ে থাকে ম্যালেনা (মোনিকা বেলুচি)। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ম্যালেনার শারীরিক সৌন্দর্য। ইটালীয় সেই তারুণ্য কোথাও বাঙালি তরুণদের সঙ্গে তখন ভাগ করে নিত তার বড় হয়ে ওঠা। দু’তরফই খুব তাড়াতাড়ি ‘পুরুষ’ হয়ে উঠতে চাইত।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

অনেক তরুণ তো আমাদের চারপাশেই আছে, যারা ওই পুরুষ হয়ে উঠতে চায় না। তারা হয়তো নারী হয়ে উঠতে চায়। কিংবা অনেক নারীও তো থাকতে পারে, যারা পুরুষ হয়ে উঠতে চায়। কিংবা শারীরিক কোনও পরিবর্তন চায় না এমনও অনেকে আছে, কিন্তু তাদের যৌনতার বোধ যখন নিজেদের কাছে পরিষ্কার হয়, তারা টের পায় ‘ম্যালেনা’র রিসোতোর মতো কিংবা ‘আ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট লাভ’-এর টোমেকের মতো অথবা ‘মায়া মেমসাব’-এর ললিতের মতো তাদের কল্পনা-জগৎ ছেয়ে কোনও নারী থাকে না। থাকে একজন পুরুষ বা তার শরীর। সেই সব তরুণদের কী হয়? পুরুষ হয়ে ওঠার উদযাপনে কি তারা আদৌ অংশগ্রহণ করতে পারে?

না, সামাজিক ইতিহাস বলে তারা পারে না। কারণ পুরুষ হয়ে ওঠা মানে নারী শরীরের প্রতিই আকর্ষণ কেবল, এই বিশ্বাস এবং সংস্কার আমাদের রাষ্ট্রে, সমাজে আজ বহুযুগ প্রচলিত। পুরুষ কেন অন্য পুরুষকে যাচনা করবে? পুরুষের জন্য তো তার জীবনপথের রূপরেখা নির্ণীত আছে। সে প্রথমে প্রেমিক, তারপর স্বামী এবং শেষে পিতা। সব থেকে বড় কথা, সমাজে তার সব দায়িত্বই নারীকে ঘিরে। তাকে রক্ষকের ভূমিকা পালন করতে হবে। তাকে পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের আয়োজন করতে হবে। তাকে নেতা হতে হবে। নারীর মাধ্যমে তার সন্তানপ্রাপ্তি হবে। পরের প্রজন্মকে পথ দেখাবেও এই পুরুষই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ইতিমধ্যে তার দায়িত্ব স্থির করে রেখেছে। জানা-অজানায় তাকে সেগুলির পালন করতে হবে। না করতে পারলে সে তবে পুরুষই নয়।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

পড়ুন মাসকুলীন পর্ব ১: কেন ‘যৌন’ শব্দের সঙ্গে ‘ক্ষমতা’ বা ‘শক্তি’ জুড়ে পুরুষের যৌনতা বোঝানোর দরকার পড়ে?

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

এই ক্ষমতার নেশা, নেতৃত্বের নেশা যে একবার পিতৃতান্ত্রিক সমাজ পুরুষকে ধরিয়ে দেয়, তা থেকে মুক্তি পাওয়া অসাধ্য। সুতরাং, এ-যাত্রায় যে পুরুষ অন্য পুরুষকে শারীরিক-মানসিকভাবে চায়, তার কোনও স্বীকৃতি অবশ্যই থাকবে না। কোনও সিনেমা বা সাহিত্য এই সব পুরুষদের জন্য নির্মিত হবে না। নিজস্ব যৌনতার চেতনা ও চাহিদাকে তাদের লুকিয়ে রাখতে হবে। বিবাহ, সঙ্গীর সঙ্গে যৌথজীবন কিংবা সন্তানপালনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি তার জন্য কখনওই গড়ে উঠবে না এবং সে যে আসলে পুরুষই নয় বা দুর্বল ও খোঁজা অর্থাৎ সন্তানজন্মে অপারগ পুরুষ– এমন অনেক হেনস্তার মুখোমুখি তাকে হতে হবে। সে সান্ত্বনা কিংবা কারুণ্যেরও পাত্র হয়ে উঠতে পারে।

একজন বিসমকামী তরুণের আমাদের সমাজে গড়ে উঠতে কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয় না তেমন। তার যৌনতা এ-সমাজে উদযাপিত হয়। কোনও মেয়েকে তার পছন্দ হবে, সে প্রেম করবে, বিয়ে করবে, সন্তান উৎপাদন করবে।অন্যদিকে, সমকামী কোনও তরুণের নিজের যৌনতা বুঝে উঠতেই চলে যাবে জীবনের অনেকটা সময়। ছোটবেলা থেকেই নিজের পছন্দ সে টের পায় কিন্তু কাউকে বলতে পারে না। বন্ধুরা জানলে যদি টিটকিরি করে? তাকে যদি একঘরে করে দেয় সবাই? সে শোনে এসব জিনিস নোংরা, অস্বাভাবিক। কী করবে সে এসব গোপন না করে? সে রূপান্তরকামী নয়, আবার নারীও তার পছন্দ নয়। তার প্রেম পাওয়ার অনেক অসুবিধা এ-সমাজে। তাকে হয়তো বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে সঙ্গী পেতে চেষ্টা করতে হবে। অনেক সময় এই অ্যাপ থেকেই জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনবে। এ জগতে কোনও ভালোবাসা তার পাওয়া হবে না। বিসমকামী বিয়েগুলোতে নিয়মরক্ষার্থে তাকে যেতে হচ্ছে, অথচ মনে মনে সে জানে তার জীবনে কখনও এমন মুহূর্ত আসবে না।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্রের বিপ্রতীপে থাকে নারীবাদ। একই সমাজে নারী এবং পুরুষের অবস্থানে যে কত ফারাক তা আমাদের জানা। কিন্তু এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে, পুরুষ হলেই যে সমাজের সমস্ত সুবিধা কেউ পাবে, তা নয়। সমকামী পুরুষেরা পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও দশকের পর দশক এই সমাজে তারা ব্রাত্য থেকেছে। একইরকম হেনস্তা জুটেছে রূপান্তরকামী-পুরুষদেরও। সমাজ সেসব মনে রাখতে চায় না। এসব ইতিহাস মুছে ফেললেই ভালো।

(চলবে)