Robbar

দূরদর্শনের শৈশব বড় হয়েছিল এমটিভির হরমোনে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 6, 2025 4:31 pm
  • Updated:December 6, 2025 4:31 pm  

হিন্দি ও ইংরেজি নন-ফিল্ম বেসিক গান, প্যান-ইন্ডিয়ান ব্যান্ডের গান, ইন্ডিপপ গান ক্রমাগত শোনাত এমটিভি। ইউফোরিয়া আর ইন্ডিয়ান ওসান প্রথম শোনা সেখানে। প্রথম শোনা কলোনিয়াল কাজিনস-এর প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ফিউশন। পরিক্রমা আর সিল্ক রুটের রকগন্ধী জ্যাজগন্ধী সুর। এই প্রথম দেখাশোনাগুলো সবই একলার। কেউ বলে দেয়নি, কেউ শিখিয়ে দেয়নি।

শ্রুতি গোস্বামী

১৯৯৯ সাল। মফস্‌সলের মেয়ে ইশকুল। শীত পড়তেই ব্যাগের ভেতর ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট। ইশকুল মাঠে ছুটোছুটি। নেলপালিশের লুকনো গন্ধ। হঠাৎ নতুন স্টাইল, কোমরে সোয়েটার বাঁধা। কোত্থেকে শিখলি রে? ফিসফিস ভেসে আসা কুছ কুছ হোতা হ্যায়।

২০০৫ সাল। আমি তখন নবম শ্রেণি। আমরা তখন শাড়ি পরতে শেখা বিনুনিবালিকার দল। টিফিন ব্রেকে দিদিমণি বা গম্ভীর গুপ্তচরীদের অনুপস্থিতিতে শাড়ির আঁচল সেফটিপিনের শিকল ভেঙে ফুরফুরিয়ে উড়তে থাকত। আয় হায়– সুস্মিতা সেন!

একটা রেডিও-ও ছিল অ্যান্টেনাওয়ালা। ইন্ডিয়ান আইডলের জমানা। ডায়েরির পাতায় সাঁটা প্রিয় গায়কের ঝাপসা মুখ। সেই রেডিওতে বেজে ওঠা প্রিয় ধুন। দুপুরের নির্জনতায় অনেক দূর থেকে ভেসে আসা গিটারের ফ্রেজ। আহটেঁ হো রহি তেরি… মায়াময় মোহন কানন।

সাদা কালো ছোট্ট বাক্স টিভিতে রবিবার সকালে মহাভারত আর রাত্তিরে আলিফ লয়লা দেখে দিন কেটেছিল আমাদের। নয়ের দশকের গোড়ার দিকে চ্যানেল বলতে আর ছোটদের অনুষ্ঠান বলতে তো ওই ক’টাই। তাও মাপা সময়ে। বাকিটা খবর পড়ার মতোই বিরস। আমাদের সেই দূরদর্শনের শৈশব হঠাৎ বড় হয়ে গেল এমটিভির হরমোনে।

১৯৮৬-তে আমেরিকায় জন্ম, দশ বছর পরে, ১৯৯৬-তে শুরু হয় এমটিভি ইন্ডিয়ার যাত্রা। ফলে এমটিভি কিন্তু আসলে আমাদেরই বয়সি, আমাদের সঙ্গেই বড় হচ্ছিল সে। আমাদের সঙ্গেই সে-ও ঢুকেছিল টিনেজে। আমাদের মতো নব্বই-এর জাতকদের কান-মাথার খাবারে কার্বাইড জুগিয়েছিল। একটু টক্সিক, কিন্তু না-থাকলেও চলে না।

1.90.5-7LGJ6TU5L276L4L4DPDOQJ5NA4.0.1-4

একটা নতুন পেশা বা নতুন ভূমিকার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়েছিল এমটিভি। ভি জে। আমরা যখন ক্রোড়পত্রে রণবিজয় সিং-এর ছবি দেখে পিছলে যাচ্ছি, তখন মানসিকভাবে আগের প্রজন্মের বন্ধুদের বোঝাতে সময় লাগত, ও ডিজে নয়, ভিজে। এই সময়টাতেই ‘রেডিও জকি’ বা ‘আরজে’ কথাটাও মোটামুটি চালু হয়ে গিয়েছে শহর-শহরতলি জুড়ে। এই জে-ফর জকিরা ঠিক গান শোনায় না, গান চেনায়। জকি বা ঘোড়সওয়ারদের মতোই কুল আর চনমনে তারা। টেলিভিশনের জকিদের পোশাক, হেয়ারস্টাইল, দাঁড়ানো, বসা, মোদ্দায় গোটা শরীরী উপস্থিতি আর শরীরী ভাষাই গান নিয়ে ভাবার ব্যাকরণ পালটে দিচ্ছিল। চ্যানেল ভি-র অত্যন্ত জনপ্রিয় পুরব কোহলি, রণবীর শোরে, গৌরব কাপুরের পাশাপাশি এমটিভিতেও ছিলেন বাঘা বাঘা সব ভিজে। রণবিজয় সিং-এর রাগী চোখমুখ, আয়ুষ্মান খুরানার তীক্ষ্ণ সহজ কথাবার্তা, সাইরাস ব্রোচা, সাইরাস সাহুকারের একটু বোকাটে কিন্তু সাহসী মন্তব্য, নিখিল চিনাপার ফাজলামি, মিনি মাথুরের কনফিডেন্ট দীপ্তি, বাণী জে-র ছকভাঙা উল্লাস– সব কিছুই আমাদের যৌবনের দরজাটা খুলে ফেলছিল। জীবনের এক অদ্ভুত উগ্রছন্দে তাল মেলাচ্ছিল একটা গোটা প্রজন্ম।

রণবিজয় সিং

কী দেখাতেন এই জকিরা? মিউজিক ভিডিও। অনেক নতুন পরিভাষার সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল তখন। তার মধ্যে একটা হল ‘মিউজিক প্রোডাকশন’। গান যে একটা উৎপাদিত পণ্য, তাকে চিত্তাকর্ষক করে প্রদর্শিত করতে হবে, এমনকী, প্রলুব্ধও করতে হবে– এই বাণিজ্যধারণা বাম জলহাওয়ায় একটু কমই ছিল। সেই অতি-আদর্শের ফটফটে থানকাপড়ে দুমধাড়াক্কা রং ছেটাতে থাকে নতুন সময়। ফলে সেইসব গান তো বটেই, গানের সঙ্গে তৈরি হওয়া সেইসব ভিডিওর দৃশ্যও আমাদের আর খুকি থাকতে দিল না। আমাদের বয়ঃসন্ধির ভয়, কান্না, দুঃসাহসে জুড়ে গেল সে-ও। আমাদের মধ্যবিত্ত মফস্‌সলের অল্প জানার জীবনে, বিটলস না-শোনা কানে ইলেকট্রিক গিটারের উচ্চকিত সুর প্রথম এমটিভি শুনিয়েছিল। দুধ-ভাতের জিভে একটু নিষিদ্ধ কামরাঙা। সেসব গানের অবাধ্য চিৎকার, গনগনে ঘৃণা, উদ্ধত চুমু, কোনওটাই ছাপোষা ছিল না। মেনস্ট্রিম আর অল্টারনেটিভের প্রভেদ তখন না-বুঝলেও এখন বুঝি, এমটিভিতে এই দুয়ের এক অসম্ভব মিশেল ঘটেছিল। যে লোক ‘শারুক্ষানের ফ্যান’ শুনে মুখ বেঁকায়, তাকে আকর্ষণের ক্ষমতা ছিল এর। সোনু নিগমের ‘দিওয়ানা’ অ্যালবামের উদাত্ত রোমান্স, ফাল্গুনী পাঠকের ‘অন্যরকম’ প্রেজেন্স দেখতে দেখতে আমরা ঢুকে পড়লাম নয়া মিলেনিয়ামে, আর হিন্দি তথা ভারতীয় গানবাজনার দুনিয়ায় আরও কয়েকজন আশ্চর্য গায়কের উত্থান ঘটল– শান্তনু মুখার্জী, কুনাল গাঞ্জাওয়ালা আর আদনান সামি।

কুনাল গাঞ্জাওয়ালা

শান যখন ‘তনহা দিল’-এর মতো একটা মাইলস্টোন লিখছেন, গাইছেন, আদনান সামি যখন অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাসে রানি মুখার্জি থেকে রবিনা ট্যান্ডন হয়ে মহিমা চৌধুরী পর্যন্ত সকলের সঙ্গে রোমান্টিক স্ক্রিনশেয়ার করছেন, তখন ভারতের ইতিহাস আবার পাতা ওল্টানোর ফন্দি আঁটছে, যার ফলে ২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসবেন মনমোহন সিং। গোধরার স্মৃতি তখনও টাটকা। হাইস্কুলের বোধবুদ্ধি নিয়ে রাজনৈতিক খবরাখবর সংগ্রহ করে এটুকু বুঝতাম আমরা যে, ধর্মধোঁয়ায় অনেক কিছুই আবছা আর ঘোলাটে করে রাখা যায়। নিজেদের চোখ-কান-মাথা পরিষ্কার করে নিতে হবে নিজেদেরই। একটু প্রশ্ন, তর্ক, যুক্তির অবকাশ রাখতে হবে সারাক্ষণ। আমাদের সেই খোলামনের দরজা-জানলাতেই থাকত এমটিভি। রিমিক্সের হাওয়া এল যখন, সেখানে ঝলসে উঠল শেফালি জরিওয়ালার উদ্ধত ভঙ্গি, সোফি চৌধুরীর দো-আঁশলা উচ্চারণ, ডানাওয়ালা তিন পরীর অদ্ভুত রূপকথানাচ। কাঁটা লাগা, বাহোঁ মে চলে আও, সঁইয়া দিল মে আনা রে, বিন তেরে সনম, উয়ো চলি উয়ো চলি– একের পর এক গানে পুরনো সময়ের ছদ্মপবিত্র আমেজকে ভেঙে ভেঙে কাম, মোহ আর বিলাসের উত্তাপ ছড়িয়ে দিল। আজ দেখতে বিশেষ ভালো লাগে, তা বলতে পারি না, শুনতেও মাঝারিই লাগে। কিন্তু যে স্মৃতির বাক্স তৈরি করে দিয়েছিল ওগুলো, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই কোনও।

শেফালি জরিওয়ালা

হিন্দি ও ইংরেজি নন-ফিল্ম বেসিক গান, প্যান-ইন্ডিয়ান ব্যান্ডের গান, ইন্ডিপপ গান ক্রমাগত শোনাত এমটিভি। ইউফোরিয়া আর ইন্ডিয়ান ওসান প্রথম শোনা সেখানে। প্রথম শোনা কলোনিয়াল কাজিনস-এর প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ফিউশন। পরিক্রমা আর সিল্ক রুটের রকগন্ধী জ্যাজগন্ধী সুর। এই প্রথম দেখাশোনাগুলো সবই একলার। কেউ বলে দেয়নি, কেউ শিখিয়ে দেয়নি। এক নিঃসঙ্গ বয়সে এদের হাত ধরেছিলাম, বড় হওয়ার কষ্টকে একা একাই লুকোতে লুকোতে দাঁড়িয়েছিলাম টিভির সামনে। সেই একাকিত্বকে ‘সংশোধন’ করে ভিড়ে ছিটকে দেয়নি এমটিভি, মলম লাগিয়ে অভিভাবকও সাজেনি, কাটাছেঁড়া-জ্বালাপোড়ার স্বাভাবিক অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিল।

এমটিভি ইন্ডিয়া বন্ধ হয়ে গেলে সেই অস্তিত্বের এক টুকরোই এক মুহূর্তে হারিয়ে যাবে আমাদের ইতিহাস থেকে। যে ছোটবেলাকে হাত বাড়ালে ধরা যায় না, যে কৈশোরের সঙ্গে রোজ দেখা হয় না আয়নায়, তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এমটিভি। ইতিহাসের রাজাগজাদের গল্পের জঙ্গলে আমাদের মতো মানুষের স্মৃতি, কল্পনা, স্বপ্নের সৌধ এমনিতেও কোথাও থাকবে না। এক বাবরি ধ্বংসের দিন থেকে আরেক বাবরি পত্তনের মাঝমধ্যিখানে দাঁড়িয়ে সার্কাস দেখা আমরা ওই নস্টালজিয়া হাতড়েই যা বেঁচে থাকি।