ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের নয়া নির্দেশিকায় লেখা যাবে না ব্র্যান্ডেড জেনেরিক ওষুধের নাম। শুধুমাত্র থাকবে জেনেরিক নাম। বাকিটা ক্রেতা বা ওষুধ বিক্রেতা ঠিক করে নেবেন।
এই মাসে ওষুধ কিনতে গিয়ে যা বিল হল, পরের মাসে তা একলাফে বেড়ে গেল অনেকটাই। মাসকাবারি ওষুধ কেনেন যাঁরা, এমন অভিজ্ঞতা তাঁদের নতুন কিছু নয়। অবশ্য প্রজার এমন দুশ্চিন্তার কথা রাজার কানে যে যাচ্ছে না, সেটা বলার বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু খেতে দেওয়ার মুরোদ না থাকলেও কিল তো মারাই যায়। না হলে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেই, নেই চিকিৎসা পরিষেবার খরচ কমানোর চেষ্টাও। উল্টে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের নয়া নির্দেশিকায় গোল পেকেছে বিস্তর। তাদের সাফ কথা, লেখা যাবে না ব্র্যান্ডেড জেনেরিক ওষুধের নাম। প্রেসক্রিপশনে শুধুমাত্র জেনেরিক নামটুকু লিখতে হবে। বাকিটা ক্রেতা বা ওষুধ বিক্রেতা ঠিক করে নেবেন। দোকানদার কোন সংস্থার ওষুধ দেবেন আর আপনি কোন সংস্থার কোন ওষুধটি গ্রহণ করবেন, সেটা নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু কথার অবাধ্য হলে চিকিৎসককে হারাতে হবে তাঁর আজীবনের শিক্ষার সঞ্চয়, চিকিৎসা দেওয়ার লাইসেন্সটি!
চিকিৎসক ব্র্যান্ডের নাম লিখলেই আড়চোখে তাকানো যাবে। ওই যে গিফট, সেমিনার– এসবের জন্যই তো এত ব্যাঙ্ক ব্যালান্স। কিন্তু শুধু জেনেরিক নামটি নিয়ে ওষুধের দোকানে গেলে ওষুধ বিক্রেতা সেরা ওষুধটা দেবে কি না, সে গ্যারান্টিও যে সন্দেহজনক। আচ্ছা, এভাবে না হয় ভাবা গেল যে, কেন্দ্রীয় সরকার একটি মহান কর্তব্য নিয়ে ওষুধের দাম কমানোর চেষ্টা করছে। যুক্তি– জেনেরিক ওষুধের দাম কোনও ব্র্যান্ডের জেনেরিকের তুলনায়, মানে বড় সংস্থার তৈরি ওষুধের তুলনায় ৩০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। মানে এককথায় ব্যাপারটা দাঁড়াল এমন যে, যেভাবে জামা-জুতো কিনতে গেলে ব্র্যান্ড দেখে কিনি, তেমন করে কিনব। কিন্তু ওই যে ইয়া বড় বড় সব মলিকিউল, তার কম্পোজিশন– এসব আমজনতা বুঝবে তো?
যদি বোঝেও, তাতেও একটা বিষয় রয়েই যাচ্ছে। ‘এফিকেসি’ বলে একটা কথা আছে। সহজ অর্থে, কোন ওষুধের দ্রুত সারানোর ক্ষমতা কতটা বেশি। মানে, একটি জেনেরিক নামের একাধিক ওষুধের মধ্যে কোনটির ক্ষমতা বেশি। সেটার হদিশ তো সব থেকে ভাল দিতে পারেন চিকিৎসকই। এই সত্যটাকে অগ্রাহ্য করলে তো ক্ষতি রোগীরই। কম ওষুধ নিয়ে দ্রুত সেরে ওঠা না কি সস্তার ওষুধ বেশি মাত্রায় প্রয়োগ করা, সাশ্রয় করতে গিয়ে সমস্যা বাড়বে না তো? এই ব্যবস্থায় চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন থেকে ব্র্যান্ড তুলে দিয়ে পুরোটাই দোকানদারের উপর ছেড়ে দিলে সমস্যা বাড়ারই আশঙ্কা। সে ক্ষেত্রে কোন সংস্থার ওষুধ রোগীর আর্থিক অবস্থার সঙ্গে মানানসই হবে, রোগী খরচ সামলাতে পারবে কি না, রোগী যদি রাজি থাকে তাহলে কার্যকরী ওষুধ দেওয়ায় কেন আপত্তি, তার কোনও উত্তর স্পষ্ট নয়। ভারতের মতো দেশে যেখানে ওষুধের গুণমান যাচাই করাটা খুব একটা সহজ নয়। ফলে মানের সঙ্গে আপস করার জায়গা তৈরি হতে বাধ্য। দেশে প্রস্তুত জেনেরিক ওষুধের মাত্র ০.১ শতাংশেরই গুণমান যাচাই করা যায়। সেক্ষেত্রে কোন মাপকাঠি থাকবে, সেটাই স্পষ্ট নয়।
পেটেন্ট বা স্বত্ব নেওয়া ওষুধ একটি নির্দিষ্ট সংস্থা তৈরি করে। সেটাই ব্র্যান্ডেড জেনেরিক ওষুধ। ওষুধের পেটেন্ট থাকে ১৫ বছর। পরে তা আর ব্র্যান্ডেড থাকে না। জেনেরিক ওষুধের তকমা পেয়ে যায়। সেই পরিস্থিতিতে রাসায়নিক সংমিশ্রণ না পাল্টে সেই ওষুধ তৈরি করতে পারে অন্য যে কোনও সংস্থাই। স্বাভাবিকভাবেই ব্র্যান্ডেডর তুলনায় দাম অনেকটাই কম হবে জেনেরিক ওষুধের। বড় সংস্থার পাশাপাশি ছোট সংস্থাও তা তৈরি করতে পারে। এই ধরনের ওষুধ সরকারি হাসপাতাল, জনস্বাস্থ্য, কেন্দ্রীয় জন ঔষধি কেন্দ্রে মেলে। সাধারণভাবে দেখলে ছোট হোক বা বড় সংস্থার জেনেরিক ও ব্র্যান্ডেড জেনেরিককে ‘বায়োইকুইভ্যালেন্স’ পরীক্ষার মধ্য দিয়েই যেতে হয়। কিন্তু ভারতে ‘কম্বিনেশন’ ওষুধও অসংখ্য। ছোট-বড়-মাঝারি সব সংস্থারই রয়েছে। তাই সবক’টির পরীক্ষা করা অসম্ভব। সেই পরিকাঠামোই নেই। ফলে বড় সংস্থার ওষুধের উপর ভরসা করা ছাড়া অনেক সময়ই কিছু করার থাকে না বলেই মত চিকিৎসকদেরও। মান যাচাই করা কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব। তা না করে চিকিৎসক আর রোগীর মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে জটিল করে তোলার দায় কেন্দ্র নেবে তো?
চিকিৎসদের পেশাদারি আচরণ নিয়ে যে নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেশের মানুষের যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, তার বেশিরভাগটাই যায় ওষুধ কিনতে। তাই জেনেরিক ওষুধের নাম লিখলে খরচ কমবে। অর্থাৎ, জেনেরিক ওষুধ প্রেসক্রিপশনে থাকলে ছোট সংস্থা হোক বা বড়, বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা মিলবে। এই পর্যন্ত তো বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু ওষুধের দোকানি তো সেই ওষুধটাই দিতে পারে, যে সংস্থার সঙ্গে তার সখ্য বেশি হবে। মানে, কমিশনের ব্যাপারটা এসে যাওয়া নিশ্চিত। বড় ওষুধের সংস্থার দাপটও বেশি হবে, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আদৌ ছোট সংস্থা এঁটে উঠতে পারবে তো? চিকিৎসককে নিগড়ে বাঁধতে গিয়ে ওষুধের দোকানি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে না তো?
২০০২ সালে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছিল, চিকিৎসকরা যতটা সম্ভব জেনেরিক ওষুধ লিখবেন। ২০০৬ সালে সেই নির্দেশে জোড় দেওয়া হল, বলা হল জেনারিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে কার্যত কিছুই বদলাল না। হঠাৎ করেই ফের এটা নিয়ে যেন উঠে-পড়ে লাগল কেন্দ্রীয় সরকার। কী হবে বড় কথা নয়। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্র যে কতটা কড়া, সেটা জনসমক্ষে নিয়ে আসাও তো কম প্রয়োজনীয় নয়!
পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে বলতে তাঁর অশ্রুসজল চোখ দেখে শুধু সেই সময় নির্বাক হয়েছিলাম তা’ নয়, আজও তাঁর সেই চোখ দেখতে পাই, শুনতে পাই মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরোচিত অত্যাচারের সেই গল্প বলতে বলতে তাঁর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর।