স্বদেশি গানগুলোর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় স্বদেশি সংগীতের যৌথতাবোধকে। এই সমস্ত গানই সে সময়ে স্বদেশের প্রতি মানুষের ভালোবাসা তৈরির প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সমাজের একটা বড় অংশকে আন্দোলনের পক্ষে এনেছে। আবালবৃদ্ধবনিতার মনন নির্মাণ করেছিল এই সমস্ত গান। মানুষের ঘৃণাকে পরিচালনা করেছিল সঠিক দিকে। শহিদদের নাম, দেশের রূপ, সৌন্দর্য– কী ছিল না সেই সব গানে। আমরা যারা এপার বাংলাতেও অল্পবিস্তর গণ আন্দোলনের দরজায় টোকা দিয়েছি, আমরা হয়তো আন্দাজ করতে পারি যে কোনও আন্দোলনে সংগীতের ভূমিকা ঠিক কতটা। একথা বলতে দ্বিধা নেই, স্লোগানের মতোই সংগীতও একটা আন্দোলনের মন নির্মাণ করে। তার গতিমুখ নির্ধারণ করে।
বর্ষার জলে কানায় কানায় ভরে উঠেছে বাংলাদেশ। খানাখন্দ থইথই করছে জলে। রাজপথে উপচে পড়া মানুষের ঢল তখন পাহারা দিচ্ছে সংখ্যালঘু অঞ্চল, হিন্দু উপাসনালয়। একটা ছাত্র নাগরিক গণ অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করল বাংলাদেশ। গোটা জুলাই মাস একপ্রকার ভয়াবহ দমন-পীড়ন, অজস্র লাশের মিছিলের মধ্য দিয়ে ইংরেজির আগস্ট মাসে প্রবেশ করেছে তারা। আন্দোলনের মুখে নতিস্বীকার করে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করলেন শেখ হাসিনা। প্রথম পর্যায়ের সাফল্য দেখল এই গণ অভ্যুত্থান। তবু প্রশ্ন রয়ে গেল। অজস্র প্রশ্ন, অনিশ্চয়তা।
তবে এই সকল অনিশ্চয়তার ভিড়েই গণমাধ্যমে ইতিমধ্যে নজর কেড়েছে বেশ ক’টি প্রতিবাদী জমায়েতের ভিডিও। তার মধ্যে একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের অজস্র ছাত্রছাত্রী এবং নাগরিকগণ সমস্বরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কালজয়ী স্বদেশি গান, ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা…’ গাইছেন।
এই ভিডিও একদিকে যেমন বাংলাদেশের গণজাগরণের এক অভূতপূর্ব উদাহরণ, আবার তেমন-ই আমাদের কাছে এই ভিডিও ফিরিয়ে আনে বাংলার স্বদেশি সংগীতে যৌথতার স্মৃতি।
ভিডিওটি চট্টগ্রামের। যেখানে গিজগিজ করছে কালো মাথা। আর সকলের গলায় এক সুর।
আমরা যারা এপার বাংলাতেও অল্পবিস্তর গণ আন্দোলনের দরজায় টোকা দিয়েছি, আমরা হয়তো আন্দাজ করতে পারি যে কোনও আন্দোলনে সংগীতের ভূমিকা ঠিক কতটা। একথা বলতে দ্বিধা নেই, স্লোগানের মতোই সংগীতও একটা আন্দোলনের মন নির্মাণ করে। তার গতিমুখ নির্ধারণ করে। আসলে একটা গানের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয় সে আন্দোলনের চেতনা।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৯০৫ সালে এই গানটি রচনা করেন। তখন দেশজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই জোরদার হচ্ছে। বাংলায় তখন চলছে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। সেই সময়ের রচনা এই গান। পরবর্তীতে ১৯০৯ সাল নাগাদ ‘সাজাহান’ নাটকে এই গানটি ব্যবহৃত হয়।
এই আলোচনার গভীরে প্রবেশ করতে হলে আমাদের এদেশে স্বদেশি সংগীতের যে ধারা, তার দিকে খানিক সংক্ষিপ্তাকারে হলেও নজর দিতে হবে বইকি।
উনিশ শতক থেকে বাঙালির মনে যে পরাধীনতার জ্বালা সৃষ্টি হল, বলা চলে এই পরাধীনতাবোধই স্বদেশি সংগীতের উৎস। একদিকে যেমন পরাধীনতার বোধ, অন্যদিকে তেমনই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। এই দুই বোধের হাত ধরেই জন্ম হয় স্বদেশ প্রেমের, যার ফল স্বদেশি সংগীত।
স্বদেশি সংগীতকে মূলত চার পর্যায় ভাগ করা যায়, ১) সিপাহি বিদ্রোহ পরবর্তী সময়কাল ২) জাতীয় মহাসভার জন্ম থেকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ৩) বঙ্গভঙ্গ ও দেশের সশস্ত্র আন্দোলনের সময়কার গান ৪) অসহযোগ আন্দোলনের সময়কার গান।
উদাহরণস্বরূপ দু’টি গান যদি দেখি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘চলরে চল সবে ভারত সন্তান’, বা আরেকটি গান ‘ক্ষুদিরাম গেল হাসিতে হাসিতে ফাঁসিতে করিতে জীবন দান।’
এই স্বদেশি গানগুলোর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় স্বদেশি সংগীতের যৌথতাবোধকে। এই সমস্ত গানই সে সময়ে স্বদেশের প্রতি মানুষের ভালোবাসা তৈরির প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সমাজের একটা বড় অংশকে আন্দোলনের পক্ষে এনেছে। আবালবৃদ্ধবনিতার মনন নির্মাণ করেছিল এই সমস্ত গান। মানুষের ঘৃণাকে পরিচালনা করেছিল সঠিক দিকে। শহিদদের নাম, দেশের রূপ, সৌন্দর্য– কী ছিল না সেই সব গানে।
‘চলরে চল সবে ভারত সন্তান,
মাতৃভূমি করে আহ্বান।’
খেয়াল করে দেখুন, যে যৌথতাবোধের কথা একটু আগে বললাম, যেখানে ধর্ম নয় জাত নয়, তার ঊর্ধ্বে ভারতের সন্তানদের ডাক দেওয়া হয়েছে। এই ডাক আসলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনেরই মন।
যে কারণে এখন এত আলোচনা, তা হল বাংলাদেশ।
ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন গণমুখী আন্দোলনের চেহারা নিল, তখন একাধিক প্রশ্নবাণ এই আন্দোলনকে বিদ্ধ করেছে। সুধীজনদের একাংশ ‘রাজাকারদের আন্দোলন’ বলেও দায় এড়িয়েছেন। হাসিনা সরকারের পতন হলে মৌলবাদীদের হাতে ক্ষমতা চলে যাবে, এ আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।
৫ অগাস্টের পর, মৌলবাদীরা আন্দোলনকারীদের বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ খুঁজছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাও করেছে বেশ কিছু জায়গায়। আবার বহু জায়গায় সংখ্যালঘুদের স্পর্শটুকু করতে পারেনি। ছাত্রছাত্রী এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কড়া পাহারায় নিরাপদে রাত কাটিয়েছেন সংখ্যালঘু মানুষেরা।
নিঃসন্দেহে একটা নতুন বাংলাদেশের জন্ম হচ্ছে।
যত দিন পেরচ্ছে, সে কথাই যেন আমরা টের পাচ্ছি। বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে মৌলবাদকে নির্মূল করতে। এটা তাদের শপথ, তারা নতুন বাংলাদেশ গড়বে। বারবার তেমনটাই জানাচ্ছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। তারা সমাজের সমস্ত বৈষম্য দূর করতে তৎপর হয়েছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর, সাংবাদিক বৈঠক করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা জানিয়ে দেয় যে সংখ্যালঘুদের উপর কোনও প্রকারের হামলা তাঁরা সহ্য করবেন না। বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। মৌলবাদীরা খালি মাঠ পাচ্ছেন না। একদল এই আন্দোলনের সুযোগে যখন দেওয়াল থেকে বাংলায় লেখা একটি দেওয়াল লিখন মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, ছাত্রছাত্রীরা রুখে দাঁড়ালেন সেখানে। লাইভ ভিডিওতে শোনা গেল তাদের স্পষ্ট জবাব, ‘ভাষা আন্দোলনটা হাসিনা করেনি! করেছিল ভাষা শহিদেরা। আমাদের দেওয়ালে কেবল বাংলা থাকবে।’
উত্তেজনায় জনতা যে সমস্ত জিনিস গণভবন থেকে নিয়ে এসেছিল, তা সমস্ত ছাত্রছাত্রী আবার ফেরত দিয়ে এসেছে। বেগম রোকেয়ার ছবির ওপর কালি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা সে কালি মুছে দিয়েছে। রাস্তায় দক্ষ হাতে যান চলাচল সামলাচ্ছেন পুলিশ নয়, ছাত্র ছাত্রীরা। রাস্তা সাফ করছেন তাঁরা। আসলে, এই নতুন বাংলাদেশ তাঁদের, সেখানে স্বৈরাচারের বা মৌলবাদের কোনও জায়গা নেই।
ছাত্রছাত্রীরা স্পষ্ট করে দিচ্ছে এই আন্দোলনের মতাদর্শকে। তারা দেওয়ালে আঁকছেন মাওলানা ভাসানীর ছবি, পাশে তাঁর অমোঘ বাক্য, ‘শুনো, ধর্ম আর দেশ মিলাইতে যায়ো না। পরে ফুলের নাম কি দিবা ফাতেমা চূড়া?’
এই নতুন বাংলাদেশে শত শত আবু সাঈদরা বুক পাতছে হিন্দু মন্দিরের সামনে, দুই হাতে সংখ্যালঘু অঞ্চল আগলে। সংখ্যালঘু অঞ্চলের অলিগলি থেকে মীর মুগ্ধদের স্বর শোনা যাচ্ছে, ‘পানি লাগবে! পানি!’
একটু আগে যেমনটা বললাম, পরাধীনতা বোধের সঙ্গে কাজ করে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, আর তার থেকেই জন্ম নেয় স্বদেশ প্রেম। আর, এই স্বদেশ প্রেম থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখছে ছাত্রছাত্রীরা। এটাই তাদের আন্দোলনের সবথেকে সম্ভাবনাময় দিক।
এই চিত্র এড়িয়ে যাওয়ার নয়। ছাত্রছাত্রীরা যখন জমায়েতে অন্য যে কোনও গানের বদলে, একসঙ্গে ধরলেন ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা..’ তখনই একপ্রকার তারা এ বার্তা দিয়ে দিয়েছিল, যে আবু সাঈদরা আবার বুক পাতবে, ওই শেষ কটা লাইনের জন্য,
‘ভায়ের মায়ের এতো স্নেহ
কোথায় গেলে পাবে কেহ
ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন
এই দেশেতে মরি…’