মানুষ এবং বন্যপ্রাণীদের মধ্যে লড়াইয়ে এই নির্বোধ পশুরা অনেক পিছিয়ে। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে অভয়ারণ্য। দাঁত খিঁচিয়ে, চোখ রাঙিয়ে, আকাশ ছাড়িয়ে উঠছে অ্যাপার্টমেন্ট। কার কাছে, কীভাবে অনুমতি মিলছে, জানে শুধুই চেয়ার। ফাঁকা ফরেস্টে হাতির পৃথিবীতে মানুষের আগ্রাসন। হাতি জানে সমতার হিসেব। তাই মানুষের রান্নাঘর থেকে মিড ডে মিলের চালের জন্য স্কুল, হাতি তার অধিকার বুঝে নিতে বারবার দাবি নিয়ে হামলা করছে লোকালয়।
অর্জুন দাশের মৃত্যুর খবর শোনার পরেই থম মেরে গিয়েছিল মা।
অর্জুন দাশ, গত বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, যাকে পিষে মেরেছিল হাতি, বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলে। বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছছিল মা। অর্জুন কে হয় মায়ের? কেউ না। বাঁধাধরা সম্পর্কের নিরিখে কেউ না। কিন্তু অর্জুন মায়ের সন্তান। সেই হারিয়ে যাওয়া সন্তান। অর্জুনের মৃত্যুতে মায়ের হারানো সন্তান, আমার বোন আবার একবার হারিয়ে গেল। প্রিয়জনের মৃত্যু মনের এককোণে চাপা দিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করে মানুষ। তারপর সেই একইরকম ঘটনাপ্রবাহ যখন সেই দরজায় এসে ধাক্কা দেয়, তখন স্মৃতির আগল খুলে সেই মৃত্যুর সম্মুখীন হয় মানুষ বারবার।
সেদিন ছিল জুন মাসের এক রাত। গাঢ় অন্ধকারে মোটা মোটা বৃষ্টির টোপ রাতের বুক ঝাঁঝরা করে যখন ঝিঙ্গে, ধুন্দুল গাছের মাচার লকলকে সবুজ পাতা গড়িয়ে মাটিতে নামছিল, তখন জোনাকিরা যেন ম্রিয়মাণ সেদিনের সেই রাতের আঁধারের কাছে। পৃথিবীর এই কোণে, মানুষ আর জঙ্গল মিশে কেমন যেন জংলি সবুজ আভা রাতের আধাঁরেও লেগে থাকে চারিদিকে। আর সবুজ, সবুজ গন্ধে ঘন বৃষ্টির প্রতিটি টোপে যেন থাকে সবুজ বীজ। তাই বর্ষার দিনে আরও বেশি গাছ– সবুজ ঘিরে ফেলে পরপর লেগে থাকা মানুষের আবাসে।
অন্য সময় প্রকৃতির মাঝে বাড়িগুলোকে বেখাপ্পা আগ্রাসন মনে হলেও, বর্ষার সবুজ গোলা রঙে একাকার হয়ে যায় এই প্রান্তর। বাড়ির পিছনে খেত, তারপর সবুজ অপালচাঁদ ফরেস্ট তখন যেন এক বহতা সবুজ গালিচা। ঈসালে সওয়াব বাড়িতে যেরকম ছাউনি দেওয়া হয়। সবুজ ছাউনি। আর মাঝে মাঝে জরির সুতো দেওয়া কাজ। অপালচাঁদ ফরেস্ট থেকে গরুমারা অভয়ারণ্য পর্যন্ত বিস্তৃত এই অংশ যেন সেইরকম এক সবুজ ছাউনি। আর দুই ফরেস্টের মাঝের অংশে আমার বাড়ি। সবুজ গালিচায় মোড়া। আর গালিচায় লেপটে থাকে জোনাকি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমাদের পাড়ার সবার শেষ প্রান্তে বাড়ি মালিয়াতের। গত বছরের আগের বছর বই পড়ে সে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল মাত্র। হঠাৎ টের পায় কেউ টানছে তাঁর পা। বুঝে যায় কে! মেধাবী মালিয়াত গোটা লেপ ছুড়ে দেয় হাতির চোখে মুখে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের অন্য বিছানায় শুয়ে থাকা নিজের ভাইকে জাগায় আর তার পর মাকে জাগিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠোনের উল্টোদিকের ঘরে আশ্রয় নেয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রেলগাড়ি কেন্নো থেকে বিশালাকার হাতি, আর ছোট ছোট নেকড়ে, বনবিড়াল, বেজি, সজারু, নানা রকমের সাপ আর মানুষ– সবুজ ছাউনির ভেতর সব পাশাপাশি। মানুষ টিকে থাকে এর-ওর জায়গা ছিঁড়ে, খাবলে নিয়ে। এই ছাউনির নিচেই তাই প্রায়শই মুখোমুখি হয় প্রাণী আর মানুষ। সেদিন যেমন হয়েছিল সেই জুন মাসের এক রাতে। অপালচাঁদ হয়ে কুমলাই, নেওড়া নদী পেরিয়ে গরুমারা ঢুকতে বেরিয়েছিল এক দাঁতাল একাকী। আমার বাড়ির ঠিক পিছনে নিম গাছের তলায়, সবজির মাচা ভেঙে দাঁড়িয়ে আকাশ-নদী ভেঙে নেমে আসা টুকরো টুকরো জলে আনখ ভিজছিল দাঁতাল। সবাই বলে জিব্রাইল!
কী জানি, কী মনে করে আমার মায়ের কলিজার টুকরা পড়ে গেল সেই দাঁতালের পায়ে। তারপর কত ডাক! নদী পার করে বাপজান নিয়ে চলল ঘাড়ে করে… পায়ে পড়ল নার্সের… কিন্তু…
কত ডাক… মর্গে… ডাকলাম আয় বোনটি ফিরে আর… না… জিব্রাইল নাকি সোনার কলমে নাম লেখে…
পরের দিন ঝলমলে রোদ… সাদা ধবধবে কাফনে বোনটি আমার নাই হয়ে গেল।
আর আমার মা নদী হয়ে গেল, নোনতা তার জল, শাড়ির আঁচল তার নুন নুন গন্ধ। আমি আর মুখ মুছি না ওই আঁচলে। আমার মা নাকি সে অর্জুনের মা? অর্জুনের মা-ও তো নোনতা নদী…
সুখ না মেলালেও কান্না, দুঃখ মিলিয়ে বিরান চড়ে পরে থাকে সন্তানহারা মা নদী… শীত করে না তাদের। বুকে পাথর জমে গর্ভে ভারী হয় শোক।
২.
যেদিন বোন কবরে যায়, রাতে আসে বন দপ্তরের গাড়ি। ২০,০০০ টাকা নিয়ে। আমার বোনের দাম? অর্জুনের মাকেও কি তারা দিতে এসেছিল দাম? হাতি বেরলে তাকে ফরেস্টে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছিল অপর্যাপ্ত লোক ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। হাতি বেরলে, হাতি তাড়ানোর গাড়ি ফোন করলেও কখন আসবে, ঠিক নেই। এখনও তাই। সেই ২০,০০০ টাকা আমি ছুড়ে মেরেছিলাম অফিসারের মুখে। অবাধ্য, বেয়ারা আমি সেদিনও জিজ্ঞেস করেছিলাম গাড়ি এত কম কেন! উত্তর ছিল না। আজও নেই।
হাতির করিডোর আটকে লোকালয়। ট্যুরিজম-এর নাম করে যেখানে-সেখানে রিসোর্ট। জঙ্গল সাফারির নামে জঙ্গলের জীবদের উপর অত্যাচার। মানুষ এবং বন্যপ্রাণীদের মধ্যে লড়াইয়ে এই নির্বোধ পশুরা অনেক পিছিয়ে। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে অভয়ারণ্য। দাঁত খিঁচিয়ে, চোখ রাঙিয়ে, আকাশ ছাড়িয়ে উঠছে অ্যাপার্টমেন্ট। কার কাছে, কীভাবে অনুমতি মিলছে, জানে শুধুই চেয়ার। ফাঁকা ফরেস্টে হাতির পৃথিবীতে মানুষের আগ্রাসন। হাতি জানে সমতার হিসেব। তাই মানুষের রান্নাঘর থেকে মিড ডে মিলের চালের জন্য স্কুল, হাতি তার অধিকার বুঝে নিতে বারবার দাবি নিয়ে হামলা করছে লোকালয়।
আমাদের তল্লাটে সবাই জানে, শীত পড়লেই বাড়ে হাতির আনাগোনা। পটকা, সার্চ লাইট, তার ব্যাটারি সব নিয়ে তৈরি গ্রামের লোক। গ্রামের লোক জানে, ফোন করে ডিপার্টমেন্টের (ফরেস্ট) লোক আসতে আসতে হাতি ঘর বাড়ি ভেঙে সব শেষ করবে। তাই আত্মরক্ষার জন্য নিজেরাই তৈরি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: শীতের রোদে বাঘের থাবা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আর বই পড়তে পড়তে কলিজা কাঁপে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী জেবা মালিয়াতের। আমাদের পাড়ার সবার শেষ প্রান্তে বাড়ি মালিয়াতের। গত বছরের আগের বছর বই পড়ে সে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল মাত্র। হঠাৎ টের পায় কেউ টানছে তাঁর পা। বুঝে যায় কে! মেধাবী মালিয়াত গোটা লেপ ছুড়ে দেয় হাতির চোখে মুখে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের অন্য বিছানায় শুয়ে থাকা নিজের ভাইকে জাগায় আর তার পর মাকে জাগিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠোনের উল্টোদিকের ঘরে আশ্রয় নেয়। হাতি তখন ঘরের এককোণে রাখা চালের বস্তা সাবাড় করতে ব্যস্ত। আজ অবধি হাতির লাথিতে ভাঙা দেওয়াল সারাতে পারেনি মালিয়াতের বাবা। কতগুলো বস্তা জোড়া দিয়ে কোনরকমে ঢেকে দিয়েছে একপাশ। মালিয়াত এবার মাধ্যমিক দেবে। বারবার বলে, বই পড়তে পড়তে অনেক রাত হয় আর ভয়ে জান কাঁপে ফুফু!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ইলা মিত্র ও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া তেভাগার কিছু নাম
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গত বছর হাতির হানায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অর্জুন দাশের মৃত্যুর পর, সরকার এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য একটি রুটম্যাপ তৈরি করে দিয়েছে। সেই রোডম্যাপ মেনে পরীক্ষার্থীরা না হয় পরীক্ষার সময় নির্ভয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবে। কিন্তু অন্য সময়?
মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করে, সহাবস্থানের পাঠ নেওয়া মানুষের জরুরি। কিন্তু আকাশ পানে থুতু ছিটিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা মানুষের সবচেয়ে প্রিয় স্বভাব।
শীত এল। পিকনিকের মরশুম। বড় বড় আবাসন হচ্ছে। উন্নয়ন চলছে। থমকে নেই জীবন।
শুধু মা-নদীদের বুক কাঁপে। পড়তে পড়তে কেঁপে ওঠে জেবা মালিয়াত। কে যেন টানল বাঁশের পাতা! ছুটে যাবে নাকি পাশের বাড়ির কাঠের দোতালার নীচের খোপরায় (অনেকেই হাতি বেরলে এভাবে আশ্রয় নেয়। হাতি সাধারণত ঝুঁকে, বসে কাউকে মারতে পারে না)! মালিয়াত পড়া থামিয়ে কান পেতে শোনে। মহাকাল নাকি গাছের পাতা নড়ছে হাওয়ায়! মালিয়াত বলে, ‘মোর যে ভয় নাগে ফুফু!’