সত্যজিৎ যে-চেয়ারে বসতেন ঠিক তার পাশে একটি চেয়ারে বসেছিলেন উইম। প্রথমেই তাঁর নজর পড়ে, ঘরের পাশে রাখা সে বিখ্যাত পিয়ানোর দিকে। সন্দীপদা তাঁকে সত্যজিতের করা বিভিন্ন নোটেশনের ডিজিটাল কপি দেখালেন, সেই নোটেশনগুলোর মাঝে সত্যজিতের করা ইতি-উতি ডুডল। একটা জিনিস বোঝা গেল যে, সত্যজিৎ ফিল্ম ডাইরেক্টর হিসেবে বাইরে অতি পরিচিত হলেও তাঁর ইলাস্ট্রেশন, গল্প লেখা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড নিয়ে বিদেশে সেভাবে খুব একটা চর্চা হয়নি। উইম নিজেও বোধ হয় তাই সত্যজিতের অলংকরণের জগৎ সম্বন্ধে ততটা পরিচিত ছিলেন না। সত্যজিতের ইলাস্ট্রেশনের মুনশিয়ানা দেখে বিস্মিত হয়েছেন, তাঁর অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট।
স্মৃতি রোমন্থন ১
১৯৭৩। ২৩তম বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। সত্যজিতের ‘অশনি সংকেত’ (The Distant Thunder) সেবারের মূল কম্পিটিশনের অন্যতম আকর্ষণ এবং পুরস্কারের দাবিদার। উইম ওয়েন্ডার্স উঠতি চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে নতুন তুর্কি, সবে রিলিজ করেছে ছকভাঙা ‘দ্য গোলকিপারস ফিয়ার অফ দ্য পেনাল্টি’ (The Goalkeeper’s Fear of the Penalty, 1972)। শুটিং সেরে ফেলেছেন পরবর্তী ফিল্ম, ‘অ্যালিস ইন দ্য সিটিজ’ (Alice in the Cities)। একদিন ফেস্টিভাল প্রাঙ্গণে হঠাৎই দেখলেন সত্যজিৎ একা এককোণে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন। সেই সুযোগ আর ছাড়েননি উইম। উইম-এর নিজের কথায় ‘দীর্ঘকায়’ সত্যজিতের (উইম নিজেও ছয় ফুটের উপর উচ্চতা বিশিষ্ট সুপুরুষ, তবে ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি নন) কাছে কিছুটা ইতস্ততভাবে এগোতেই জানালেন তাঁর শ্রদ্ধার কথা। বললেন প্যারিসে থাকাকালীন La Cinémathèque française-এ সত্যজিতের বিভিন্ন ফিল্ম দেখার অভিজ্ঞতার কথা। এতদিনের স্মৃতি আবছা হয়ে গেছে তাই ঠিক কী কথা হয়েছিল, বলতে পারলেন না– তবে সত্যজিৎ যে ওঁর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন অত্যন্ত বিনীতভাবে, সেটা তাঁর স্পষ্ট মনে আছে।
স্মৃতি রোমন্থন ২
সন্দীপ রায় এই স্মৃতির কোলাজে আরেকটি ঘটনার কথা সংযোজন করলেন। ১৯৮৪। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মূল প্রতিযোগিতায় সত্যজিতের ‘ঘরে বাইরে’। সেবারের কম্পিটিশন চাঁদের হাট– ফিল্ম নিয়ে হাজির জন হিউস্টন, থেও আঙ্গেলোপুলোস, ভের্নার হের্ৎসগ (Werner Herzog), লারস ভন ট্রাইয়ার প্রমুখ। তবে শেষে বাজিমাত করেছিল ‘Paris, Texas,’ উইমের অন্যতম সেরা ছবি। তখন সত্যজিৎ অসুস্থ। তাই কান-এ যেতে পারেননি, তবে সেখানে হাজির ছিলেন তাঁর পুত্র সন্দীপ। উইমের সঙ্গে কথোপকথনে সন্দীপদা বললেন– তাঁর পরিষ্কার মনে আছে সেই মুহূর্ত যখন জুরি (Jury) প্রেসিডেন্ট ডার্ক বোগার্ড তাঁর স্বভাবোচিত গম্ভীর গলায় উইমের নাম ঘোষণা করলেন, Palme d’Or-এর জন্য। তারপর উইম নিজে সন্দীপদার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে এসেছিলেন। সন্দীপদা মজা করে বলেছিলেন, ‘কিন্তু সেরা তো তুমি-ই হলে।’ উইম মৃদু হেসে যেন স্মৃতি অতলে ডুব দিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন সেই স্মৃতিগুলোকে– মাঝে মাঝে অস্ফুটে বলে উঠছিলেন, ‘Yes, I remember.’
স্মৃতি রোমন্থন ৩
১৯৮৭। উইম ওয়েন্ডার্স বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘Cahiers du Cinema’-র ৪০০তম বিশেষ সংখ্যার গেস্ট এডিটর। “Editions de l’Etoile-Cahiers du cinema” প্যাডে চিঠি লিখলেন সত্যজিৎ-কে। সেই চিঠি সযত্নে রাখা আছে ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে। সেই বিশেষ সংখ্যার বিষয়: ‘the imaginary’– ‘the idea is to publish in this issue about the “imaginary” the first two or three pages of scripts of “imaginary movies” which the audience will never have a chance to see. These pages, I am sure, will make us all dream…’ (চিঠির অংশ বিশেষ)। সেই মূল চিঠি দেখে উইম অভিভূত। চিঠিটায় কোনও তারিখ দেওয়া নেই তবে প্রসঙ্গ উপস্থাপনার নিরিখে সময়কাল নির্দেশ করা খুব শক্ত কাজ নয়।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, এই সংখ্যার অসাধারণ ভূমিকার কথা, যেখানে উইম লিখছেন: “The paradoxical thing is that films begin with words, and that words determine whether the images are allowed to be born. The words are like the headland that a film has to steer round to reach the image. It’s at that point that many films go under. For all sorts of reasons (of which lack of money is the worst), they remain locked up in scripts that are never shot. Looking at it like that, film history is like an iceberg: you only ever see the 10 percent or so of completed films, the liberated image; the majority of them remain imprisoned in the ice, forever below the surface.” (Wim Wenders. The Logic of Images. ‘The History of Imaginary Films’. Faber and Faber. 1992. p.86). এই উক্তির গুরুত্ব উইম-এর কাজের মধ্যেই প্রকাশ্য। উইম শুধু ‘চলচ্চিত্রকার নন’, এখন তিনি পুরো মাত্রায় ‘দৃশ্যের সংগ্রাহক’। Wim Wenders Stiftung (Foundation) এর প্রধান কাজ উইমের নিজের তৈরি করা চলচ্চিত্র সমূহ যেগুলো বিভিন্ন প্রযোজকের কাছে আছে, সেগুলোকে restore করে যথাসম্ভব আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনসমক্ষে সহজলভ্য করে তোলা। সত্যজিৎ রায় সোসাইটির কাজও অনেকটা সে রকমই, যদিও অনেক কাজ এখনও বাকি।
***
উইম যে সত্যজিতের বাড়িতে আসবেন– সেটা আগে থেকেই জানানো হয়েছিল ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন-এর তরফ থেকে। ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার শিবেন্দ্র দুঙ্গারপুর উইমকে ভারতে আনার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন অনেক দিন ধরেই। তখনই বলেছিলেন যে, রায়বাড়িতে আসার জন্য খুবই ইচ্ছুক উইম। আলাদাভাবে কোনও প্রেস ডাকতে চাননি। ১৮.২.২০২৫। বিকেল ৩টে। একান্ত ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের সাক্ষী ফিল্ম ফাউন্ডেশনের শিবেন্দ্র, তাঁদের নিজস্ব ক্যামেরাম্যান ও সহকারীরা, উইমের স্ত্রী দোনাতা, আর ‘Wim Wenders Stiftung’-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ক্লেয়ার ব্রুনেল। আমরা ভাগ্যবান যে, রায় সোসাইটির সদস্য হিসেবে আমাদের সুযোগ হয়েছিল ওই মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার। রায়বাড়ির চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী, আপ্যায়নের কোনও খামটি রাখেননি ললিতাদি (ললিতা রায়)। গেট থেকে লিফটে ওঠার পর তিন ধাপ কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সেই বিখ্যাত দরজা। দরজা খোলার পরেই দীর্ঘ বারান্দা। এখনও সেই দীর্ঘদেহী মানুষের স্মৃতির ছায়া সর্বত্র– দরজা খুলে ঢুকলেই সত্যজিতের হাতে আঁকা ‘অপরাজিত’-র বিখ্যাত পোস্টার। উইম প্রবেশ করার পরেই হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘Everything is so open here. I could have come here any day.’ রায় বাড়ির খোলামেলা পরিবেশ প্রথমেই ওঁকে মুগ্ধ করেছে! প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে সন্দীপদার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। সত্যজিতের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা সে কত গভীর, সেই কথোপকথনেই পরিষ্কার। কিছুক্ষণ পরেই সবাই মিলে সত্যজিতের কাজের ঘরে প্রবেশ করলাম। সত্যজিৎ যে-চেয়ারে বসতেন ঠিক তার পাশে একটি চেয়ারে বসেছিলেন উইম। প্রথমেই তাঁর নজর পড়ে, ঘরের পাশে রাখা সে বিখ্যাত পিয়ানোর দিকে। সন্দীপদা তাঁকে সত্যজিতের করা বিভিন্ন নোটেশনের ডিজিটাল কপি দেখালেন, সেই নোটেশনগুলোর মাঝে সত্যজিতের করা ইতি-উতি জুড়ল। একটা জিনিস বোঝা গেল যে, সত্যজিৎ ফিল্ম ডাইরেক্টর হিসেবে বাইরে অতি পরিচিত হলেও তাঁর ইলাস্ট্রেশন, গল্প লেখা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড নিয়ে বিদেশে সেভাবে খুব একটা চর্চা হয়নি। উইম নিজেও বোধ হয় তাই সত্যজিতের অলংকরণের জগৎ সম্বন্ধে ততটা পরিচিত ছিলেন না। সত্যজিতের ইলাস্ট্রেশনের মুনশিয়ানা দেখে বিস্মিত হয়েছেন, তাঁর অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট। মাথায় রাখতে হবে, উইম নিজেও কিন্তু যথেষ্ট ভালো আঁকেন। সত্যজিতের আঁকা ওঁর ‘imaginary’ ফিল্ম রবিশঙ্করের স্টোরিবোর্ড খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। স্টোরিবোর্ডের মাঝখানে কিছু কিছু জায়গায় ইন্টারেস্টিং ক্যামেরা মুভমেন্টসের রেফারেন্স করেছিলেন সত্যজিৎ। সেগুলো দেখে সম্মতিসূচক মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন। সন্দীপদাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ওই কাজের সময়কাল সম্বন্ধে। ললিতাদি কিছু সত্যজিতের করা অরিজিনাল ইলাস্ট্রেশন দেখালেন, যা অনেকেই আগে কোনও দিন দেখেনি। কিছুক্ষণ বসে, উইম তাঁর নিজের ক্যামেরা বের করে ওই ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্রের ছবি তুলতে আরম্ভ করলেন– ঘরে রাখা ভিন্টেজ সিক্সটিন মিলিমিটার প্রজেক্টর, সত্যজিতের আঁকা বাঁধানো ছবি, তাঁর অর্জন করা বিভিন্ন পুরস্কারের রেপ্লিকা– কোনও কিছুই বাদ ছিল না তাঁর ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারের থেকে! শিবেন্দ্র বললেন যে, ওই দিন সকালেই নাকি উইম মল্লিক-ঘাট ফুলের বাজারে এবং তারপর প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে গিয়ে প্রচুর ছবি দৃশ্যবন্দি করেছেন তাঁর বিশ্বস্ত ক্যামেরায়। সন্দীপদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘How was the experience?’ পরিষ্কার উত্তর দিলেন, ‘I loved the chaos of the city.’ আসলেই ক্যাওসের মধ্য থেকেই তো বিভিন্ন দৃশ্যের জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্নবীকরণ ঘটে– আমরা হয়তো বা অনেক সময় তা দেখেও দেখি না। সেখানেই তো সত্যজিৎ বা উইমের মতো দৃশ্যনির্মাণকারীর দক্ষতা, অনন্যতা ও বিভিন্নতা। তাঁদের চোখ খুঁজে পায় এমন জিনিস যা আমাদের নতুন দৃশ্য ও দৃশ্যমানতা সম্বন্ধে ভাবায়।
***
যাওয়ার আগে উইম ক্লেয়ার ব্রুনেলকে বললেন, ‘You should send the photograph that I and Ray clicked together at Berlin in 1973.’ উনি সযত্নে সেই ফোটোগ্রাফ রেখেছিলেন নিজের কাছে, কয়েক দিন আগেই সেই ফোটোগ্রাফ ফাউন্ডেশনের আর্কাইভ-এ জমা দিয়েছেন। ক্লেয়ার বললেন, অবশ্যই সেই ফোটোগ্রাফের ডিজিটাল কপি পাঠিয়ে দেবেন রায় সোসাইটিতে। এই ভাবেই স্মৃতির আদান-প্রদান ও সংরক্ষণ জরুরি– মুহূর্তগুলো সঠিকভাবে ডকুমেন্টেশন না করলে হারিয়ে যাবে স্মৃতির অতলে।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..