সবচেয়ে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে ছোট প্রকাশকদের নিজেদের। সংগঠনের রাজনীতি ভুলে একটি সমবায়ী সংগঠন তাঁরা তৈরি করুন। এবং প্রতি মাসে চাঁদার বিনিময়ে সুরক্ষার দিকটি বজায় রাখুন। প্রয়োজনে কোথাও দ্বিতলে বা ত্রিতলে গোডাউন ভাড়া নিয়ে সংগঠন সমস্ত প্রকাশকের বইগুলির সুরক্ষার ব্যবস্থা করুন। পাশাপাশি যাঁদের আউটলেট আছে তাঁরা শুধুমাত্র তালাচাবির সুরক্ষার কথা ভাববেন না। কতখানি জল উঠতে পারে, তা আন্দাজ করে সেইভাবে বইগুলোকে সাজান। বর্ষাকাল বা আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সর্তকতা নিতে হবে।
বাংলা সাহিত্যের আঁতুরঘর, কলেজ স্ট্রিটে, এখন এই মুহূর্তে, গীতাঞ্জলির গৌরবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জলাঞ্জলির সৌরভ। পিছু ছাড়ছে না অনেক দিনই। তার লন্ডনের ডানায় লন্ডভন্ডের সানাই বেজে উঠেছে আবার কলেজ স্ট্রিট জুড়ে। অবশ্য এসব নিয়ে এতদিন বেশি হইচই হয়নি। এ এক সাম্প্রতিক অসুখ, দীর্ঘদিন চোখ বুজে থেকে আমরাই যার নিরাময় চাইনি। তার কারণ পাঠক আগে জানত না কে প্রকাশক– কে বই বাঁধাই করেন, ছাড় বা মহাছাড়ের কী-ই বা মহিমা! আজ সেইসব সীমারেখা, দূরত্ব মুছে গিয়েছে। একজন পাঠক, আসলে একজন লেখক ওরফে একজন সম্পাদক ওরফে একজন প্রকাশক একই দেহে লীন। আর তাই আমাদের চেনা কবি-বন্ধু, আসলে প্রকাশক । আমাদের চেনা লেখক আসলে ডিটিপি অপারেটর। আমাদের চেনা প্রকাশক ওরফে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী পাঠক। এভাবেই জড়িয়ে আছে সব পরিচয়। আক্ষরিক অর্থেই ঘেঁটে-ঘ। গত পাঁচ বছরে, কোভিড-পরবর্তী কলেজ স্ট্রিট, প্রকাশক মাত্রই গ্রন্থব্যবসায়ী– এই ধারণার বাইরে আসতে পেরেছে। এর কারণ প্রযুক্তি আমাদের সহায় হয়েছে। বড় প্রকাশকের মনোপলির যাবতীয় কারণগুলি ছোট প্রকাশকেরও হাতের মুঠোয়। তাই সাধ আর সাধ্যের আপাত দ্বন্দ্ব ঘুচেছে। যদিও ভেতরে ভাঁড়ে মা ভবানী। মায়াকান্নার জ্বর মাঝে মাঝে সমাজমাধ্যমে আমরা টের পাই। যদিও উদ্ধত কবিটি ভাবেন, তাঁর বই বিক্রি করে রয়্যালটির টাকা ফাঁকি দিয়ে প্রকাশক আকাশচুম্বি ফ্ল্যাটে থাকেন। এভাবেই দিন ফুরয়। কিন্তু কলেজস্ট্রিটের দুরাশার রাত ফুরয় না।
ঠিক যখন ছোট প্রকাশকদের একটি নিজস্ব বাজার তৈরি হয়েছে, রুচিমতো বই প্রকাশের দায়ভার বহনের স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, ফেসবুকের বিজ্ঞাপনে পাঠক তৈরির সামান্য আলোক এসেছে তখনই মহামারী করোনার ছোবল এল। সব কিছু বিপর্যস্ত, বলা চলে তার শিরদাঁড়াই ভেঙে যায়। মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছিল ছোট প্রকাশকের গুমোর, বেঁচে থাকবার আকাঙ্ক্ষা। বাজার নেই, বইমেলা নেই, কর্মীদের মাইনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই, গুদাম ঘরের ভাড়া দেওয়ার পয়সা নেই– এমতাবস্থায় অনেকেই একটু একটু করে সরে গিয়েছেন। আর যারা আশায় বুক বেঁধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছিলেন কেউ কেউ ঢুকে গিয়েছেন তন্ত্র বা থ্রিলারের দিকে, বেঁচে থাকার জন্য। তারপর যে এতদিনেও ফিরে আসেননি, সে অবশ্য অন্য কথা। দ্বিতীয় ধাক্কাটি এরপর আমফান। এক বিপুল বিপর্যয়ে ছোট প্রকাশকরা কার্যত তলিয়ে গেলেন। নিজেদের বই নষ্ট হল, অন্যান্য প্রকাশকের বই যার দাম মেটাতে হবে বিক্রি করে, আউটলেটে সেগুলি পচে ফুলে উঠল। সে সময় অবশ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। দু’-একজন বড় প্রকাশক এবং ছোট প্রকাশকদের সুহৃদজন দ্রুত ফান্ড তৈরি করে দৈনন্দিন জীবন ধারণের উপকরণের জোগান দিয়েছিলেন কিছুদিন। তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই। সেই তালিকাও সমাজ মাধ্যমে ঘুরে বেরিয়েছে। আজ, এখনও পর্যন্ত ছোট প্রকাশকদের ফান্ড তৈরির উদ্যোগ দেখা গেল না– তার একটা বড় কারণ নিশ্চয়ই আমফানের শিক্ষা। নানা টিটকিরি, দুর্নীতি, অমানবিক আক্রমণে যাঁরা সামান্য সাহায্য পেয়েছিলেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন এই মুহূর্তে এটা কোনও পন্থা নয়।
সোমবার সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও বজ্রপাত। যান চলাচল বিপর্যস্ত। বহু মানুষ অফিসে পৌঁছতে পারেননি। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক নয়। আগাম পুজোর ছুটি ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এর ভেতর মানুষের দৈনন্দিন বিপর্যয় আছে। হয়তো বিক্ষোভ আছে। একদিন হঠাৎ ছুটির আনন্দ আছে। কারওর মাইনে কমবে না, এই নিশ্চয়তা আছে। সাত-আট জনের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মৃত্যু হলেও, সেই অনিশ্চিত ভোটারের মৃত্যু শোক তৈরি করছে না আপাতত। মেয়র বলেছেন, গঙ্গা দিয়ে জল ঢুকছে। আর কিছুদিনের মধ্যে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ‘গঙ্গা তুমি বইছ কেন’ বাজিয়ে হয়তো এই দুর্বিষহ ঘটনা আড়াল করা যাবে। আর একে ‘সামান্য ক্ষতি’ বলে নিলিপ্ত থাকাই নিশ্চয়ই সঙ্গত। কিন্তু আমরা তা পারছি না।
প্রকৃত অর্থে যাঁদের ক্ষতি হল তাঁরা কলেজ স্ট্রিটের ছোট-বড় নানা প্রকাশক। এই মুহূর্তে কলেজ স্ট্রিটের মূল জায়গায় অনেক ছোট প্রকাশকের নিজস্ব আউটলেট। সেখানে অন্যান্য বই-পত্রপত্রিকাও বিক্রি করা হয়। জায়গার কার্যত অভাব। কেউ কেউ গোডাউনে রেখে আসেন আগামী বইমেলার ভবিষ্যৎ। একদা হরেক মাল, শায়া-ব্লাউজের দোকানগুলি সবই এখন বই বিক্রির আউটলেট। বৃষ্টিতে আগের সেসব দোকানের ক্ষতি আটকানো সহজ ছিল। কিন্তু জলে বা আগুনে বই নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য। এখন যা পড়ে রইল তা অজস্র বইয়ের কঙ্কাল। তার হোমও নেই, যজ্ঞও নেই। এমনকী, কেজি দরে বিক্রির ভবিষ্যৎ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এখনও প্রচুর পৃথুলা শারদীয়া আউটলেটগুলিতে রয়ে গিয়েছে। যেগুলি বিক্রি হলে ছোট প্রকাশকরা কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখবেন। অনেকেই এখান থেকে বইমেলার প্রয়োজনীয় মূলধন জোগাড় করে নেবেন। সেসব এখন অতীত। এবং আজও যে আমরা এই মুহূর্তে কলেজস্ট্রিটের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি, সান্ত্বনা বাক্য আওড়াচ্ছি তার কারণ গণলেখকের ভিড়। ওই জলের সমুদ্রে যে বইটি বিলীয়মান– সে কি আমারই বই! তাই এই বেদনায় একটু সমব্যথী না হলে বাজারদর থাকে না! তাই শুরু হয়ে গিয়েছে দুঃখের উদযাপন। সান্ত্বনার ছোট ছোট বরাভয়। ‘পাশে আছি’ ফাঁকা বুলি বিতরণের ছদ্মবেশী নানা আয়োজন। সুরাহার পথ আপাতত কী? কে দাঁড়াবেন এই দুঃসময়ে? সরকার? গিল্ড? স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন? হঠাৎ তৈরি করা কোনও ক্রাউড ফান্ড? কে বাঁচাবে আমাদের?
সবার আগে বলতে চাই কলকাতা পৌরসভার কাজ কী? তাদের প্রধান কাজ বোধহয় এই মুহূর্তে আগামী কোনও কবির জন্মশতবর্ষ পালনের ধামাকা। এতদিন ধরে যখন সামান্য বৃষ্টি হলেই কলেজ স্ট্রিট কার্যত অচল হয়ে যায়, কেন সেই নিকাশি ব্যবস্থার কোনও বিজ্ঞানসম্মত সুরাহা হল না? কেন, তার একটা বড় কারণ এসবের সঙ্গে ভোটের সম্পর্ক নেই। বই, লেখক, প্রকাশক, প্রেসকর্মী সব মিলিয়ে কতজন! আর পাঁচটা ব্যবসায় যখন কিছু করা হচ্ছে না, তখন বই ব্যবসায়ীদের নিয়েই বা কেন সরকার ভাববেন? নেহাত আগুন লাগলে দমকল মন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে হয়, যেহেতু আগুন দমকল মন্ত্রীর দিকেও ধেয়ে আসে। কিন্তু জলের ছোট ছোট ঢেউ আসলে তো ভেনিসের সৌন্দর্যপ্রতিমা। আর বৃষ্টি যখন চিরাচরিত কাব্যের উপাদান তার সঙ্গে খিদেকে যোগ করতে যাবে কোন আহাম্মক?
কার্যত এই মুহূর্তে গিল্ড সচল না অচল– আমাদের বোঝার উপায় নেই। কবে বইমেলা হবে– সেই ঘোষণাটি ছাড়া তার পেখম মেলার সময় নেই। অথচ বইমেলার চেয়ে আরও বড় দায়িত্ব বইয়ের সঙ্গে জড়িত মানুষদের জীবন ও জীবিকা। তাঁরা বেঁচে থাকলে তবে না বইমেলা। না হলে বইমেলার খাদ্যমেলা হতে বাকি আর কী আছে? আজও আমাদের বইভাবনা মূলত ব্যক্তিগত ব্যবসা, তা সমবায় ভাবনায় জড়িত নয়। কাজেই প্রতিবেশীর দুর্যোগে আরেক প্রতিবেশীর বোধহয় কিছু যায় আসে না। বাকি রইল তৎপর জরুরি ভিত্তিতে তৈরি ফান্ড। সেটা খুব কাজের বলে মনে হয় না। তার কারণ বন্যাদুর্গতদের ত্রাণ দিলে যে মহত্ব তৈরি হয়, বইকর্মীদের দিলে সেটা তৈরি হয় না। তারপর কে প্রকাশক, কে সম্পাদক, কে ছদ্মবেশী প্রকাশক, কার দুঃখের কান্না মূলত ভান– এসব নানা প্রশ্নে সকলেই জর্জরিত হলেও টাকা ওঠে অল্প। এই দয়ার দান চিরস্থায়ী কোনও বন্দোবস্ত নয়। ছোট প্রকাশকরা নিজেরাও কি এ ব্যাপারে তৎপর? আগাম কোনও সতর্কবার্তা মেনে চলেন? বইয়ের বিজ্ঞাপনে, ফেসবুক প্রচারে, শারদীয়া তৈরির হিড়িক, আরও নানা কারণে যে পরিমাণ টাকা তাঁরা খরচ করেন– তার সামান্য কি বইয়ের সুরক্ষার জন্য ভাবেন? তাঁরা লাভের টাকা গুনবেন, রয়্যালটির টাকা গোপন করবেন, আর সুরক্ষা চাইবেন দৈবকৃপার কাছে– এই বা কেমন কথা! সামান্য আর্থিক সংগতি হলেই তাঁরা দু’জন কর্মী রাখেন, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, কিংবদন্তি লেখকের গাড়িভাড়া মেটান। নিজেরাই এমন এক মিথ্যে স্বপ্নের জগৎ নির্মাণ করেন তার ফুটো চালটি কার্যত পাঠক দেখতে পান না। তবু আজ এসব কথা থাক। বরং কয়েকটি ছোটখাটো দাবি তুলে ধরা যাক। আশা করাই যায় একদিন সরকারি কৃপায় বা দৈবদুর্বিপাকে সে স্বপ্ন সফল হবে।
বহুদিন ধরেই তো গিল্ডে, ক্ষমতাশীল প্রকাশকরাই আছেন। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ। তাই তাঁরা অবিলম্বে দাবি সনদ তৈরি করে নিকাশি ব্যবস্থার সুরাহা চাইতে পারেন। তাঁরাই উদ্যোগ নিয়ে একটি সরকারি গোডাউন তৈরি করতে পারেন। যা ন্যূনতম মূল্যে সকল ছোট-বড় প্রকাশকের বই রাখার সুরক্ষিত জায়গা হয়ে উঠবে। সরকারি উদ্যোগে ছোট প্রকাশকদের সুরক্ষিত আউটলেট করে দেওয়া যায়। এই মুহূর্তে সরকারের কাছে এটুকু সহৃদয়তা আশা করা কি অন্যায়?
গিল্ডের আর্থিক সংগতির অভাব নেই। তাঁরা নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করুন। প্রয়োজনে বইমেলার সামান্য প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করে সেই অর্থ সুরক্ষার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপন বা লোগোর বিনিময়ে সুরক্ষাবাবদ ছোট প্রকাশনীকে কিছু অর্থ দিতে পারেন যা ব্যবসা এবং বিজ্ঞাপন উভয়ের কাজেই লাগবে।
সবচেয়ে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে ছোট প্রকাশকদের নিজেদের। সংগঠনের রাজনীতি ভুলে একটি সমবায়ী সংগঠন তাঁরা তৈরি করুন। এবং প্রতি মাসে চাঁদার বিনিময়ে সুরক্ষার দিকটি বজায় রাখুন। প্রয়োজনে কোথাও দ্বিতলে বা ত্রিতলে গোডাউন ভাড়া নিয়ে সংগঠন সমস্ত প্রকাশকের বইগুলির সুরক্ষার ব্যবস্থা করুন। পাশাপাশি যাঁদের আউটলেট আছে তাঁরা শুধুমাত্র তালাচাবির সুরক্ষার কথা ভাববেন না। কতখানি জল উঠতে পারে, তা আন্দাজ করে সেইভাবে বইগুলোকে সাজান। বর্ষাকাল বা আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সর্তকতা নিতে হবে।
ছোট প্রকাশকদের অনুরোধ করব এইসব ছাড়ের গল্প থেকে বেরিয়ে আসুন। কারণে-অকারণে অতিরিক্ত ছাড় দিলে পাঠক যখন বইটি প্রকাশমাত্র কেনেন তখন তাঁরা প্রতারিত বোধ করেন এবং মনে করতে থাকেন বই বিক্রিতে আসলে অনেক লাভ। ছাড় বা আছাড় দিয়ে আপনাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করবেন না। উৎসবে, স্বাধীনতা দিবসে, আরও কত পার্বণে, কী জানি হয়তো কোনও নির্যাতনের দ্বিবর্ষপূর্তি উপলক্ষেও ছাড় দেবেন আপনারা। নিজেদের চারপাশ থেকে সস্তা করলে এই কুম্ভীরাশ্রু কিন্তু কাজে আসবে না। আপনার বিখ্যাত লেখকের বৈঠকখানার খবর না রেখে এবার থেকে বরং আবহাওয়ার খবর রাখুন।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved