Robbar

রিফান্ডে প‌ড়িয়া বগা কান্দে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 20, 2025 6:56 pm
  • Updated:December 20, 2025 7:37 pm  
Significance of Refunds in Daily Life by Sumanta Chatterjee

মেসির কলকাতা আগমনে ‘রিফান্ড’। ডার্বি বাতিল হলে ‘রিফান্ড’। ইন্ডিগো ফ্লাইট ক্যানসেল হলে ‘রিফান্ড’। রিফান্ড আর কত কিছুতেই! হবে না-ই বা কেন? পুঁজিপতিরা সবসময় গিলে খাবে মধ্যবিত্তর উজ্জ্বল স্বপ্নের দলা? কিন্তু শেষত আমরা যা রিফান্ড চাই, তা টাকাপয়সার নয়। লেনদেনের নয়। তবে কীসের?

সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

জানেন সেবার কী হয়েছিল?

সেবার মানে, অনেক কাল আগে, তখন‌ও বাংলাদেশ আজকের ‘সোনার বাংলা’ হয়ে ওঠেনি। তখন‌ও ‘স্যান্ডো-গেঞ্জি’ পরা ডি’পলকে নিয়ে মেসি দ্বিতীয়বার কলকাতা ভ্রমণে আসেননি। তখন‌ও টিম ইন্ডিয়া টেস্টে বিড়াল, টি-টোয়েন্টিতে বাঘ হয়নি।

কলকাতায় মেসি, সঙ্গে সতীর্থ রড্রিগো ডি’পল

সেই ‘অচ্ছে দিন’-এ আমার মামাতো ভাইয়ের কাকাতো দাদা রহমান ডাকাইতের মতো এক ‘ধুরন্ধর’ অভিসন্ধি ভেজে ফেলেছিল! সে ব্যাটাচ্ছেলে, পিতৃপুরুষের ওয়ালেট ধ্বংস করে পটাপট রাতবিরেতে সুইগি-জ্যোমাটো-টমাটো থেকে অনলাইনে খাবার অর্ডার করত। করে খেত। পুরোটা নয়, সিংহভাগ। বাকিটার ছবি তুলে ‘রিফান্ড’ চাইত! পচা খাবার, নয়তো খাবারে নোংরা– এমন নানা ছলে কাস্টমার কেয়ারকে বোকা বানাতে দেখেছি সে বাছাধনকে। আসলে কাস্টমারের কথা বেদবাক্য মনে করা হয় তখনও সে-সময়। ক্রেতার অভাব-অভিযোগে ‘কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো’ রপ্ত করেনি অনলাইন সংস্থাগুলো। কিন্তু একদিন পালে বাঘ পড়ল! অভিযোগের পাহাড়ে চড়ে কোম্পানিগুলো রা-কাড়া বন্ধ করে দিল। আর সেই কাকাতো ভাইয়ের মামাতো দাদা, থুরি উল্টোটা। তার কী হল?

হাতে হ্যারিকেন!

ইদানীং ‘রিফান্ড’ ব্যাপারটা বেশ ট্রেন্ডিং। ‘দিবে আর নিবে, মিলিবে মিলাইবে’-তে শেষ নয়, ‘পছন্দ না হলে রিফান্ড’– এই অভ্যাসে জনগণ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বিলকুল। আগে পচা আলু-আনাজ দেওয়ার জন্য বাপ-কাকাদের বাজার‌ওয়ালার সঙ্গে চিলচিৎকার জুড়তে দেখেছি। মাছের নরম ‘গলা’ পেট গরম তেলে ছাড়তে ছাড়তে মা-মাসিদের দেখেছি, বাড়ির কর্তার ‘বাজার-সরকার’ তকমা মুখ-ঝামটায় কেড়ে নিতে। ট্রেনে-বাসে-পথে-ঘাটে-দোকানে হকারকে বলতে শুনেছি, ‘মাল খারাপ হলে পয়সা ফেরত!’ সেসবের রোজনামচায় শীতের কুয়াশার মতো বিছিয়ে থাকত আশ্বাসের সুর– ‘ভরসা রাখুন, ঠকবেন না।’ তাই বলে কি ঠকেননি? বহুবার ঠকেছেন। তবু হাজার‌ও গজগজানির আর বাপবাপান্তের পর সেই বিক্রেতা আর আপনার মাঝে রিফান্ড রেড কার্পেট বিছিয়ে দেয়নি।

এখন দিচ্ছে। দিচ্ছে বলেই আমাদের জীবনের টুকিটাকিতে সিঁধ কেটেছে রিফান্ডের ফান্ডা। অনলাইনে ফল কিনেছেন কিংবা ১ টাকায় কেনা সবজি পচা বেরল। ওমনি! ই-কমার্সকে অপছন্দের মাল ফেরত দিয়ে রিফান্ড পাওয়া না পর্যন্ত শান্তি নেই। কলকাতা ডার্বি ভেস্তে গেলে আমাদের রিফান্ড চাই। মেসি কলকাতায় এসে দেখা না করলেও রিফান্ড চাই। যুবভারতী লন্ডভন্ড করে ভাঙা চেয়ার, ম্যাট কিংবা ছেঁড়া জালের বিনিময়ে আমরা সেই রিফান্ডের স‌ওদা করি, সুবিধাবাদী ক্ষমতাবানদের শায়েস্তা না করতে পেরে। দিনকয়েক আগে লখন‌উয়ে ঘন কুয়াশায় ভেস্তে যাওয়া ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে‌ও ‘ট্রেন্ডিং’ হয়েছিল টিকিটের দাম রিফান্ডের দাবি। বিক্ষুব্ধদের সেই দাবির কাছে বাধ্য হয়েই মাথা নুইয়েছে বিসিসিআই। ইন্ডিগোয় বিমান বাতিলের কারণেও ভেসে ওঠে রিফান্ডের সোচ্চার দাবি। ওঠা উচিতও। কারণ পুঁজিপতিরা সবসময় হাঁ করে গিলে ফেলবে মধ্যবিত্তের উজ্জ্বল স্বপ্নের টুকরো, তা তো হয় না।

লখনউয়ে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টির ম্যাচ ভেস্তে গেল দৃশ্যমানতার অভাবে

প্রতি পদক্ষেপে রিফান্ডের তুলাযন্ত্রে মানুষ মেপে নিতে চায় তার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, লাভ-লোকসান। বুঝিয়ে দিতে চায়, সে লাভবান হতে এসেছে এ-পৃথিবীতে, নিঃস্ব হ‌ওয়ার ভার সহ্য করা তার পক্ষে কঠিন। এই গোলকধাঁধায় আমাদের শেষতম চাহিদা সময়ের রিফান্ড। পাই কি? জীবনের ঘেরাটোপে গাঢ় হয়ে ওঠা মুহূর্ত, যে মুহূর্ত জোনাকির মতো মিলিয়ে গিয়েছে জীবন থেকে চিরকালের মতো, কিংবা সেই মানুষ, যে কথা দিয়ে কথা রাখেনি, প্রতীক্ষার দুয়ারে অপেক্ষমাণ সেই মানুষের অস্তিত্ব কি হাজার রিফান্ড দাবি করেও মেলে? মেলে না। যেমন ফেরত পাওয়া যায় না সারল্যময় বাল্যকাল। ফেলে আসা শীতকাতুরে মাঝদুপুর। ইশকুল-মালির দু’চার রকম আচার।

পুরনো আড্ডা, চেনা গল্প, যার রিফান্ড নেই

আমাদের বিশ্বাসটুকু, যেটুকু বেঁচেবর্তে আছে, তা এখন ওই রিফান্ডেই। ‘বিফলে মূল্য ফেরত’– জুড়ে গিয়েছে আমাদের যাপনে। সাবধানীর মার নেই, অতি সাবধানীর রিফান্ডও আছে। কিন্তু জীবন কি শুধুই বড় সাবধানে, বড় আঁটসাঁট হয়ে বাঁচার জন্য? প্রশ্নটা সহজ, আর উত্তর? অজানা?

………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়-এর অন্যান্য লেখা

………………….