বিরহের সঙ্গে হাত-ধরাধরি তার। বাংলা ক্যালেন্ডার পৌষ-মাঘকে শীতের দায়িত্ব দিলেও, এই যে কার্তিক-অগ্রহায়ণ– শীত বলা চলে না অথচ ভোরবেলা ঠান্ডা লাগলে সসম্ভ্রম চাদরমুড়ি– এর রহস্যও নিতান্ত কম নয়। ‘হেমন্ত’ বলে ডাকাই যেত, যদি-না আড়াল থেকে উঁকি মারত অন্য-কারওর আগমনী। প্রকৃতপক্ষে কার্তিক-অঘ্রানমাস শীতেরই গৌরচন্দ্রিকা– শীত আসার আগে খানিক গা ঘামিয়ে নেওয়া।
…আর, এইসব সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতেই আবিষ্কার করে ফেলছি অন্য-এক শীতকে, যা অপেক্ষার কথা বলে। বিরহের সঙ্গে হাত-ধরাধরি তার। বাংলা ক্যালেন্ডার পৌষ-মাঘকে শীতের দায়িত্ব দিলেও, এই যে কার্তিক-অগ্রহায়ণ– শীত বলা চলে না অথচ ভোরবেলা ঠান্ডা লাগলে সসম্ভ্রম চাদরমুড়ি– এর রহস্যও নিতান্ত কম নয়। ‘হেমন্ত’ বলে ডাকাই যেত, যদি-না আড়াল থেকে উঁকি মারত অন্য কারওর আগমনী। প্রকৃতপক্ষে কার্তিক-অঘ্রান মাস শীতেরই গৌরচন্দ্রিকা– শীত আসার আগে খানিক গা ঘামিয়ে নেওয়া।
‘গৌরচন্দ্রিকা’ শব্দ-ব্যবহার মনে পড়াল গৌরের কথা। সেই সূত্রে বিষ্ণুপ্রিয়ার। ‘গৌরাঙ্গ’ ওরফে নিমাই তখন সংসারের প্রতি উদাসীন। নবদ্বীপ ছাড়েননি, তবে দেরিও নেই বেশি। পার্ষদদের নিয়ে পথে-পথে হরিনাম বিতরণই একমাত্র কাজ। ঘরে যে বিষ্ণুপ্রিয়া আছেন, সেই খেয়ালটুকুও নেই। বোঝাতে গিয়েও পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছেন নিমাই-ঘরণী। ঘরে বসে চোখের জল ফেলেন, আর মনে-মনে ভাবেন–
‘পৌষে প্রবল শীত জ্বলন্ত পাবকে।
কান্ত আলিঙ্গনে শীত তিলেক না থাকে।’ (চৈতন্যমঙ্গল, জয়ানন্দ)
কান্ত অর্থাৎ স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেই পৌষের প্রবল শীত অন্তর্হিত হবে, পুরুষবক্ষের উষ্ণতায় আরাম পাবেন বিষ্ণুপ্রিয়া। কামনা সামান্যই; জীবনসঙ্গিনী হিসেবে এটুকু চাওয়া কি অপরাধ? অথচ তা হওয়ার উপায় নেই। তিনি হরিনাম বিলোতে ব্যস্ত। ‘দৃকপাত না করে প্রভু না করে শ্রবণ।’ ক্রমে পৌষ ফুরিয়ে মাঘ আসে। শীতের কামড় বাড়ে আরও। অসহায় লাগে বিষ্ণুপ্রিয়ার। মুখে বলেন না, কিন্তু মাসের পর মাস মিলনবঞ্চনাও কি সওয়া যায় এভাবে! বা, বিষ্ণুপ্রিয়া হলে হয়তো যায়। অস্ফুট আত্মকথনেই শুরু ও শেষ হয়ে যায় সব চাওয়া–
‘বিষম মাঘ মাসের শীতে।
কত নিবারণ দিব এ দারুণ চিতে।।’ (চৈতন্যমঙ্গল, জয়ানন্দ)
তিনি ঘরে ফিরে আসুন, শীতের এই কাঁটা-দেওয়া দিনগুলোয় একসঙ্গে গড়ে তোলা যাক কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত– জোর করে চেপে রাখতে হচ্ছে মনের এইসব ইচ্ছে। অথচ বিয়ের পর কেটেছে মাত্র দু’-তিন বছর। দোষ কার– শীতের, না নদিয়া-নাগরের?
এই অপেক্ষার সঙ্গে মিলে যায় আরেকজনের বিরহবোধ। তিনিও আরেক ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’– অথবা, তাঁর ছায়াতেই বিষ্ণুপ্রিয়াকে এঁকেছেন পদকর্তারা। তিনি, রাধা। কৃষ্ণবিরহে পাগলপারা, প্রবল শীতেও মাটিতে কেবলমাত্র পদ্মপাতা বিছিয়ে শয়ন করছেন। ননদ এসে কথা শুনিয়ে যায়, তবু কৃষ্ণ ছাড়া দ্বিতীয় চিন্তা নেই রাধার–
পৌষে প্রবল শীত পবন প্রবলে।
পাতিয়া পঙ্কজপত্র শুতি মহীতলে।।
প্রভুর পীরিতি প্রেম মনে-মনে গণি।
প্রতি বোলে পুড়ে মোরে পাপ ননদিনী।।’ (ভাগবত, শ্যামদাস)
তবে রাধা কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার মতো চিত্ত নিবারণ করেন না। বিরহ তো রয়েইছে, কিন্তু শুধু তাতে ডুবে থাকাই নয়। বরং, কৃষ্ণের সঙ্গে মনে-মনে রমণ করেই জয় করবেন মাঘের একাকিত্ব–
‘মাঘেতে মাধব সঙ্গে এ মণি-মন্দিরে।
মহানন্দে রমিব মানস নিরন্তরে।।’ (ভাগবত, শ্যামদাস)
এই যে দৃঢ়চিত্ততা, এ-ও কিন্তু শীতেরই। জবুথবু ভাব কাটিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা, কোনও-না-কোনও উপায় খুঁজে নেওয়া ঠিক। বাইরে যতই কুয়াশাবৃত হোক দিন, মনে যদি মাধবসূর্য উদিত হয়, তাকে রোধ করে কার সাধ্যি!
আবার, অন্যভাবেও বিরহের জন্ম দিতে পারে শীতকাল। পৌষ পর্যন্ত রাম-সীতা-লক্ষ্মণ একসঙ্গেই বনবাসী, গোল হয়ে বসে আগুন পোহাচ্ছেন। ঠিক পরের মাসেই নেমে এল দুর্যোগ। রাবণ-কর্তৃক সীতা হরণ। এই ঘটনা জন্ম দিল দীর্ঘ বিরহের, যার ইতি না-জানি কতদিন পরে…
‘মাঘে মকরযাত্রা কর্ম্মতে দুর্গতি।
সীতার কপালে লেখা সোনার মৃগিটি।।
মৃগি খেদারিঞা গেলা রাম লক্ষ্মণ।
সীতা হর্যা লঞা গেল পাপিষ্ঠ রাবণ।।
সীতা হর্যা লয়্যা রাখে অশোকের বনে।
ছয় মাস মধ্যে দেখা নাঞী পক্ষপক্ষী সনে।।’ (সীতার বারমাস্যা, কৃত্তিবাস ভণিতায় রচিত)
সীতার এই বিরহ-বিচ্ছিন্নতা একইসঙ্গে বহির্জগতের প্রতিও। তবে তিনি ভেঙে পড়েননি, কেননা জানতেন, রাম একদিন আসবেনই। আশা ফুরিয়ে গেলে মানুষের কি বেশি শীত করে, যেমন করছিল বিষ্ণুপ্রিয়া বা রাধার?
এঁরা তো প্রত্যেকেই পরিচিত চরিত্র। এবার আসি এমন এক নারীর কথায়, পূর্ববঙ্গের গ্রাম্য পালাগান ছাড়া যাঁকে আর কোথাও পাওয়া যায় না। বগুলা, এক গ্রাম্য নারী, স্বামীবিরহে কাতর। স্বামী গেছেন বাণিজ্যে। মাসের পর মাস কাটে, ফেরার নামগন্ধ নেই। এদিকে অগ্রহায়ণ এসে পড়ল, সেইসঙ্গে ধীরে-ধীরে হিমও। বগুলা বলছেন–
‘এইতনা আগুন মাসরে শীতে হিসফিস।
বায়েতে আলিয়া পড়ে নয়া ধানের শীষ।।
ঘরে আইল নয়ারে ধান্নি জয়াদি জোকারে।
অর্ঘ্য দেয় কুলের নারী ঘরের লক্ষ্মীরে।।
আমি অভাগী নারীর চিত্তে হাহাকার।
কণ্ঠে নাই সে ফুটে আমার জয়ের জোকার।।
দয়া কর লক্ষ্মীমাতা দয়া কর তুমি।
কাল বিয়ানে উইঠ্যা দেখি ঘরে আইছে সুয়ামী।।’ (বগুলার বারমাসী, পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা)
আগুন অর্থাৎ অঘ্রান মাস, নতুন ফসলের মরশুম। নবান্নের ধান উঠছে গোলায়, নারীদের মুখে উলুধ্বনি, ঘরে-ঘরে লক্ষ্মীপুজো। সর্বত্র উৎসবের আমেজ। এমন পরিবেশেও বগুলা বিষণ্ণ, মন হু হু করে তাঁর। ফসল নয়, অঘ্রান মাসে লক্ষ্মীর কাছে চেয়ে বসছেন স্বামীর প্রত্যাবর্তন। কাল সকালে যেন উঠে দেখি, স্বামী ফিরে এসেছেন ঘরে। একে শীত, তার ওপর উৎসব– এসবের মধ্যে এই বিরহ তো আর সয় না! নিজের লোক যদি কাছেই না-থাকল, উৎসব উপভোগ করব কী করে! এই জ্বালা গড়াচ্ছে পৌষেও। ‘উত্তইরা বাতাসে আমার গায়ে আইল জ্বর’, তবুও ‘ঘরে নাই সে প্রাণের পতি’। জ্বরে ধুঁকতে-ধুকতেও বগুলা ভাবছেন, শীতের এই রাত কেটে যাবে, কাল সকালে উঠে যেন স্বামীকে দেখি।
মলয়ার পরিস্থিতি অবশ্য এর থেকে খানিকটা আলাদা। ভালোবেসেছিলেন রাজার কুমারকে, এদিকে ‘কলঙ্কী’ অপবাদ নিয়ে বনে নির্বাসিত হলেন খোদ মলয়াই। তাঁর জীবনে অঘ্রানের নবান্ন নেই। নেই উলুধ্বনি, লক্ষ্মী-আরাধনার পরিবেশও। বনের মধ্যে শীত আরও তীব্র হয়ে উঠছে, অঘ্রান মাসেই–
‘আইল আগুন মাস জ্বলিল আগুনি।
শিশিরে দহিল অঙ্গ কাতর হইল প্রাণী।।
শুন শুন তরুলতা আমার দুঃখের কথা।
দুঃখের লাগিয়া মোরে সৃজিল বিধাতা।।’ (মলয়ার বারমাসী, পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা)
বাস্তবের সঙ্গে লড়াই করছেন মলয়া। মনে বিরহ আছে, আছে রাজার কুমারের নিতে আসার অপেক্ষাও, তবে তার থেকেও বড় হয়ে উঠছে শীতের কামড়। ভাবনাও ধাবিত হচ্ছে সেদিকেই—
‘সুমুখে দারুণ শীত অঙ্গে বাস নাই।
দারুণা শীতের কাল কিমতে কাটাই।।’ (মলয়ার বারমাসী, পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা)
এভাবেই, বিভিন্ন রূপে সহ্যশক্তির পরীক্ষা নেয় শীত। যদি উত্তীর্ণ হও, তবে সুদিন আসতেও পারে। আবার, অনেকের ক্ষেত্রে আসেও না। ঋতুর নিয়মে ফাল্গুন-চৈত্রাদি বসন্ত আসে ঠিকই, নিমাই ঘরে থিতু হন না আর। ছেড়ে-যাওয়া খড়ম পরিষ্কার করতে গিয়ে, গায়ে কাঁটাও কি দেয় বিষ্ণুপ্রিয়ার? সেই কাঁটা দেওয়ার সঙ্গে অবশ্য শীতের কোনও সম্পর্ক নেই, পাঠক জানেন…
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved