শ্রীরামকৃষ্ণ বিসর্জনে নারাজ মথুরবাবুর বুকে হাত বুলতে বুলতে বললেন, ‘ওঃ— এই তোমার ভয়? তা মাকে ছেড়ে তোমায় থাকতে হবে কে বললে? আর বিসর্জন দিলেই বা তিনি যাবেন কোথায়? ছেলেকে ছেড়ে মা কি কখনও থাকতে পারে? এ তিনদিন বাইরে দালানে বসে তোমার পূজা নিয়েছেন, আজ থেকে তোমার আরও নিকটে থেকে— সর্বদা তোমার হৃদয়ে বসে তোমার পূজা নেবেন।’
জানবাজারে মথুরবাবুর বাড়িতে দুর্গোৎসবের আয়োজন হয়েছে। সেবারে বিশেষ আনন্দের মেজাজ। কারণ শ্রীরামকৃষ্ণদেব স্বয়ং সেখানে উপস্থিত। তাঁর উপস্থিতিতে প্রতিমা সেবার যেন জ্যোতির্ময়ী রূপ ধারণ করে এক অনির্বচনীয় পরিবেশ তৈরি করেছিল। সমগ্র দালান ভাবে গম গম করছে। একদিন পূজার সময় পুরোহিত নৈবেদ্য নিবেদন করছে। ঠাকুর সেখানে উপস্থিত। হঠাৎই ঠাকুর নিজহাতে নৈবেদ্য থেকে নিয়ে খেলেন। উপস্থিত ব্রাহ্মণরা চমকে উঠলেন! মথুরবাবু তাঁদের বললেন, ঠাকুর নিজে নৈবেদ্য গ্রহণ করেছেন। সুতরাং এ পূজা সার্থক।
সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী মহানন্দে কেটে গেল। দশমীতে বিসর্জনের সময় আগত। বেঁকে বসলেন মথুরবাবু! বললেন, ‘আমি মাকে বিসর্জন দিতে দিব না। যেমন পূজা হইতেছে, তেমনি পূজা হইবে। আমার অনভিমতে যদি কেহ বিসর্জন দেয় তো বিষম বিভ্রাট হইবে— খুনোখুনি পর্যন্ত হইতে পারে।’ তিনি কারও কথা শুনতে নারাজ। অবশেষে ঠাকুরকে অনুরোধ করা হল বোঝানোর জন্য।
ঠাকুর গিয়ে দেখেন মথুরবাবু গম্ভীর। ঠাকুরকে বললেন, ‘বাবা, যে যাহাই বলুক, আমি মাকে প্রাণ থাকিতে বিসর্জন দিতে পারিব না। বলিয়া দিয়াছি, নিত্যপূজা করিব। মাকে ছাড়িয়া কেমন করিয়া থাকিব?’ ঠাকুর মথুরবাবুর বুকে হাত বুলতে বুলতে বললেন, ‘ওঃ— এই তোমার ভয়? তা মাকে ছেড়ে তোমায় থাকতে হবে কে বললে? আর বিসর্জন দিলেই বা তিনি যাবেন কোথায়? ছেলেকে ছেড়ে মা কি কখনও থাকতে পারে? এ তিনদিন বাইরে দালানে বসে তোমার পূজা নিয়েছেন, আজ থেকে তোমার আরও নিকটে থেকে— সর্বদা তোমার হৃদয়ে বসে তোমার পূজা নেবেন।’ ঠাকুরের কথায় ও স্পর্শে যে কী এমন শক্তি ছিল। মথুরবাবু ধীরে ধীরে প্রকৃতিস্থ হলেন। প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া গেল।
১৮৬৮ সাল। দুর্গাপূজা আগত। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভাগনে হৃদয়রামের ইচ্ছে হল শিহড়ে নিজের বাড়িতে শারদীয়া পূজা করবেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তখন দক্ষিণেশ্বরে। হৃদয়ের খুব ইচ্ছে পুজোর ক’টা দিন ঠাকুর তাঁর বাড়িতে থাকেন। কিন্তু তা সম্ভব নয় জেনে হৃদয় ক্ষুণ্ণ হলেন। বাড়ি যাওয়ার সময় তাঁর মন খারাপ দেখে ঠাকুর তাঁকে কথা দিয়েছিলেন যে, তিনি নিত্য সূক্ষ্ম শরীরে পুজো দেখতে উপস্থিত হবেন, অন্য কেউ তাঁকে দেখতে না পেলেও, হৃদয়রাম তাঁকে দেখতে পাবে। ঠাকুর তাঁকে আরও বলেছিলেন যে, একজন ব্রাহ্মণকে তন্ত্রধারক রেখে নিজের ভাবে মায়ের আরাধনা করতে, মা তাঁর পূজা গ্রহণ করবেন। পূজার সমস্ত বিষয় খুঁটিনাটি ঠাকুর তাঁকে বলে দিয়েছিলেন। হৃদয় আনন্দ মনে বাড়িতে এসে ঠাকুরের নির্দেশমতো পূজানুষ্ঠানে ব্রতী হলেন। সপ্তমী পূজা শেষ করে রাতে নীরাজন করার সময় হৃদয়রাম দেখতে পেল ঠাকুর জ্যোতির্ময় শরীরে প্রতিমার পাশে ভাবাবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধুমাত্র ওইদিনই নয়, প্রতিদিন এবং সন্ধিপূজার সময় তিনি এভাবে ঠাকুরকে দেখতেন। ঠাকুরের এই দিব্যদর্শন তাঁর পূজাকে সার্থক করেছিল। কিছুদিন পর মহানন্দে দক্ষিণেশ্বরে ফিরে তিনি ঠাকুরকে এই বৃত্তান্ত বললে ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, “আরতি ও সন্ধিপূজার সময় তোর পূজা দেখিবার জন্য বাস্তবিকই প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিয়া আমার ভাব হইয়া গিয়াছিল এবং অনুভব করিয়াছিলাম যেন জ্যোতির্ময় শরীরে জ্যোতির্ময় পথ দিয়া তোর চণ্ডীমণ্ডপে উপস্থিত হইয়াছি।” ঠাকুর একবার ভাবাবিষ্ট হয়ে হৃদয়কে বলেছিলেন, “তুই তিন বৎসর পূজা করিবি।” বাস্তবিক হয়েও ছিল তাই। চতুর্থবার দুর্গাপূজার আয়োজনকালে এমন বাধাবিঘ্ন উপস্থিত হয় যে, বাধ্য হয়ে তাঁকে পূজা বন্ধ করতে হয়েছিল।
১৮৮৫ সালের আশ্বিন মাস। কলকাতা নগরী শারদীয়া পূজা উপলক্ষে মেতে উঠেছে। ঠাকুরের পরম ভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্র বহু বছর পর আবার ঠাকুরকে জানিয়ে তাঁর সিমলার ভবনে পূজার আয়োজন করছেন। ঠাকুর তখন শ্যামপুকুরে ভাড়াবাড়িতে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে যেতে পারবেন না। তাই সুরেন্দ্রর মন খারাপ।
মহাষ্টমীর দিন নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য ভক্ত শ্যামপুকুরে উপস্থিত। বিকেল চারটে নাগাদ ভজন শুরু হল । খুব জমে উঠেছে। সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। তখন সন্ধিপূজা। প্রায় আধঘণ্টা পর সমাধি ভাঙলে ঠাকুর বললেন, “এখান হইতে সুরেন্দ্রের বাড়ি পর্যন্ত একটা জ্যোতির রাস্তা খুলিয়া গেল। দেখিলাম, তাহার ভক্তিতে প্রতিমায় মার আবেশ হইয়াছে! তৃতীয় নয়ন দিয়া জ্যোতিরশ্মি নির্গত হইতেছে! দালানের ভিতরে দেবীর সম্মুখে দীপমালা জ্বালিয়া দেওয়া হইয়াছে, আর উঠানে বসিয়া সুরেন্দ্র ব্যাকুল হৃদয়ে ‘মা’, ‘মা’ বলিয়া রোদন করিতেছে। তোমরা সকলে তাহার বাটীতে এখনই যাও। তোমাদের দেখিলে তাহার প্রাণ শীতল হইবে।”
ঠাকুরের কথামতো নরেন্দ্রনাথ-প্রমুখ সকলে সুরেন্দ্রর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন যে, ঠাকুরের যখন সমাধি হয় তখন পূজা দালানে ঠাকুর যে স্থান বলেছিলেন সেখানে দীপমালা জ্বালা হয়েছিল এবং সুরেন্দ্র প্রতিমার সামনে উঠানে বসে প্রাণের আবেগে ‘মা’ ‘মা’ বলে প্রায় এক ঘণ্টা কেঁদেছিলেন।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved