রণেন আয়ান দত্ত যেমন একটি যুগের নাম, তেমনই একটি যুগ পরিবর্তনের এপিটাফও তিনি। দু’দিক থেকে সাঁড়াশির মতো তাঁকে চেপে ধরেছিল এক অমোঘ শক্তির ‘যুগ পরিবর্তন’। একদিকে মাল্টিমিডিয়ার সুনামিতে ভেসে যাচ্ছিল ‘হাতের কাজের গর্ব’। ডিজিটালের বন্যায় রং-তুলি-তেলের কাজ ‘কদরহীন’-‘নজরহীন’ হতে শুরু করল। অন্যদিকে আঁকার ভুবনে প্রবেশ করল ‘বিমূর্ততার থিম’। জনজীবনে-দর্শনে-রাজনীতিতে দেখা গেল পাশ্চাত্যমুখীন ছাঁচে ‘আধুনিকতা’-র পেরেস্ত্রৈকা-গ্লাসনস্ত। এই বহির্বিশ্বমুখিতার ঝোঁক, প্রাদেশিক ভাষাতে তো বটেই, দেশীয় কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত সর্বস্তরের শিল্পক্ষেত্রের ‘আত্মবিশ্বাস হরণ’ করল।
সে এক যুগ ছিল। না ছিল টিভি, না ছিল মাল্টিমিডিয়া। রেডিওতে শুধু কণ্ঠ দিয়ে ‘বোরোলিনের সংসার’ পাতছেন শ্রাবন্তী মজুমদার। বিজ্ঞাপন বনাম ‘অ্যাড’-এর স্থান তখন খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। পত্রিকার কাগজে হাতে আঁকা ছবিতে মুগ্ধ হয়েই শালিমার তেল ও জবাকুসুমের কদর ঘরে ঘরে। বিজ্ঞাপন তখন ‘হাতে-বোনা’ বা ‘কণ্ঠে-গাঁথা’ এক শিল্প। ‘মেশিন’ তখনও মানুষের ‘মনিব’ হয়ে ওঠেনি। ‘যন্ত্র’ তখনও যুগটির ‘মন্ত্র’ হয়ে ওঠেনি। তারও বহু আগে– সেই সময়ের সূচনাপর্বে, বিজ্ঞাপন জগতের দু’টি তাবড় নাম– সত্যজিৎ রায় এবং রণেন আয়ান দত্ত। জহুরি অন্নদা মুন্সীর জহর চিনতে ভুল হয় না।
আর্ট কলেজ থেকে ডিস্টিংশন-সহ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া রণেন আয়ান দত্ত ধীরে ধীরে ‘অঙ্কন থেকে আর্কিটেক্ট’, ‘বিজ্ঞাপন থেকে বইয়ের প্রচ্ছদ’– গ্রিক দেবতা অ্যাটলাসের মতো নিজের হাতে ধরে রাখার ক্ষমতা প্রতিপন্ন করে ‘জিনিয়াস’ ডাকনামটি আদায় করে নিলেন সমসাময়িক শিল্পসমাজে। সেই সময়টিতে বিজ্ঞাপন জগতের দুই কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় এবং রণেন আয়ান দত্ত– দু’জনেই ছিলেন ‘ক্যামেরা-দক্ষ’। অনেকেই জানেন না, নানা অ্যাঙ্গেলে তাঁর তোলা সাদা-কালো কিছু শিল্পসম বিজ্ঞাপনের ছবি রয়েছে, যা এখনই রক্ষা না করলে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হবে। একবার একটি বিখ্যাত ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমার বিজ্ঞাপনের সমস্ত নারী-ই ‘হিল্লোলা’।
অসমের শিলচরে আঠেরো বছরের হিল্লোলা নামের পরমা সুন্দরী মেয়েটির পাত্র খোঁজা চলছে। হাতে দু’টি আলাপ। একটি ‘সরকারি উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার’ অন্যটি ‘শিল্পী’। হিল্লোলার বাবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে প্রথম শ্রেণিতে পাশ করা এক দুঁদে আইনজীবী। উপেন্দ্রশঙ্কর দত্ত মনস্থির করে উঠতে পারছেন না। মেয়ের একমাত্র ভাই তাপসশঙ্কর দত্ত বেঁকে বসলেন, ‘শিল্পীই ভালো। মনটি কোমল হবে।’ সাক্ষাতে দেখা গেল, কী মধুর-মার্জিত ব্যক্তিত্ব, কী সুন্দর গান করেন, কী মোলায়েম কথা। যেন কথা নয়, শিল্প।
১৯৫৪ সালে চলে এলেন হিল্লোলা আয়ান দত্ত কলকাতায় প্রায় ১৪ বছরের বড় এক ‘শিল্পী-স্বামী’-র সঙ্গে ঘর বাঁধতে। সারাজীবন ‘ম্যাডাম’ সম্বোধনে সম্মান ও স্বাধীনতা দিয়েছেন তিনি অনিন্দ্য সুন্দরী স্ত্রী-কে।
টালিগঞ্জের যৌথ পরিবারের বাড়ি থেকে কেয়াতলার বাড়ি, সেখান থেকে ডোভারলেন। জীবনের একেকটা ‘মাইলস্টোন’ গড়ছেন রণেন আয়ান দত্ত। সঙ্গে অর্জন করছেন সংগ্রামের দিনগুলো পার করে এক শিল্পনির্ভর উপচে-পড়া বৈভবের জীবন। যা সে যুগে অনেক তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছিল শিল্পকে ‘পেশা’ করতে। তাঁর ‘আর অ্যান্ড ডি’ কোম্পানিতে কত তরুণের যে শিল্পীজীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল! আবার পরবর্তীকালে বিভিন্ন শিল্প আঙ্গিকের কত তরুণ শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে এখনও তাঁর কাজ! পোশাক ডিজাইনার শর্বরী দত্তের পুত্র অমলিন দত্ত সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী রণেন আয়ান দত্তের মডার্নাইজ প্রেসেন্টেশন মা-কে খুব মুগ্ধ করত। সত্তর দশকে আমি খুব ছোট ছিলাম। সেই সময়ে মডার্ন কনসেপ্টে ট্রেড ফেয়ারে কোল ইন্ডিয়ার প্যাভেলিয়ন রণেন আয়ান দত্ত করেছিলেন, যা আমি মা-র কাছ থেকেই জেনেছি।’
…………………………………………………………
পড়ুন তর্পণ সিরিজের অন্য লেখা: এক গভীর রাতে সমুদ্রতীরে বসে রাজনীতিতে আসার সংকল্প নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব
…………………………………………………………
এক্সপো ৭০-এ জাপানে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন রণেন আয়ান দত্ত। এছাড়াও লন্ডন, প্যারিস, রাশিয়ায় তাঁর প্যাভিলিয়ন স্থাপত্য চোখ জুড়িয়েছে বিশ্বের। খাবার টেবিলে বসে গল্প করেছেন, রাশিয়ায় হোটেলের ব্রেকফাস্ট এলাকায় এসে দেখেন যে, ‘চশমাটি নেই’। কর্মরতদের আকারে ইঙ্গিতে কিছুতেই বোঝাতে পারেন না। তাঁরা এনে দেয় প্রথমে দুটো ডিম, পরে দুটো আলু, দুটো পেঁয়াজ। অবশেষে এঁকে দিলে, চশমা খুঁজে পেলেন।
তেমনই লন্ডনে একটি স্থাপত্য আঁকতে বসেছেন, কোনও ফুরসতই পেলেন না। কিছুটা এঁকেছেন। দেখলেন লোকজন জমে গিয়েছে। যেখান থেকে পারে কাগজ নিয়ে ভিড় জমিয়েছে অগুনতি লোকজন। সবাই কিনে নিলেন তাঁর আঁকা। নিজের আঁকাটি সেদিন আর হল না। তাঁর মুখেই শুনেছি যে, আর্ট কলেজের এনট্রান্স পরীক্ষায় তাঁর আঁকা ছবিটি বহু কাল আর্ট কলেজে টাঙানো ছিল।
তাঁর পরিবারের প্রত্যেকেই কৃতী। তাঁর একমাত্র ভাই ‘পান্না’ শিক্ষাজগতের এক স্বনামধন্য নাম– যিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ত্রিগুণা সেনের জামাতা ছিলেন। তিনি নিজে বিশ্বজুড়ে খ্যাতনামা শিল্পী হলেও, আমাদের কাছে ‘পিসেমশাই’ কিন্তু বাড়ির জামাই। শিলচরে যে আশ্রমে হিল্লোলার পরিবার যেতেন, সেখানকার ছবি আঁকা, শ্বশুরবাড়ি নিয়মিত যাওয়া, শ্যালকপত্নীকে বউভাতের দিন ‘চন্দনে সাজানো’ বা তাঁর প্রথম পুস্তকের ‘প্রচ্ছদ’ করে দেওয়া, নিজের কন্যার মতো, তাঁদের কন্যার ‘বিয়ের কার্ড’ নিজে হাতে করে দেওয়া– এই সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের কাছে ‘বড় মাপের মানুষ’-এর এক ‘বর্ম’ রচনা করেননি কখনও। শ্বশুরবাড়ির সকলকে নিয়ে তাজ বেঙ্গল, ক্যালকাটা ক্লাবে যাওয়ার সময় তিনি দিয়েছেন সবসময়।
একদিন ঘরে ঢুকলেন খুব বিরক্ত হয়ে। ফুচকাওয়ালা ‘রাতের রাস্তার’ বলে একটু অন্ধকার এঁকেছেন। সবাই অন্ধকারটাকেই ‘ফোকাস’ করছে! বাড়িতে ঢুকেই রং-তুলি নিয়ে বসলেন। যেমন দিলেন চার-পাঁচটি রং-তুলির টান, অমনি ‘দিনের’ হয়ে উঠল ‘রাতের ফুচকাওয়ালাটি’। ‘ছায়াবাণী’ ও ‘চারুচিত্র’ প্রডাকশনের কর্ণধার অসিত চৌধুরীর ভাইপো ছিলেন সম্পর্কে। কী সুন্দর কথা বলতেন! অসিত চৌধুরী বলতেন, “রণেন, তোমার ‘তুলি’-র সঙ্গে ‘বুলি’-ও চলে ভালো।” চারুচিত্র নিবেদিত, তপন সিন্হার পরিচালিত ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির প্রচ্ছদ-বিজ্ঞাপনের কাজও করেছেন তিনি।
তাঁর বড় শ্যালিকার মেয়ের জামাই শিল্পপতি ও লেখক অমিতাভ চৌধুরী। বহু অনুরোধেও, ‘মেসো’ নিজের হাতে আঁকা একটা ছবি জামাইকে দিচ্ছেন না বলে বেশ উপায় বাতলালেন।
দূরদর্শনের এক সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘মেসো, তুমি যে এক মিনিটে পেনসিল না তুলে একটা ঘোড়া আঁকো, সেটা সবাই-কে করে দেখাও।’ যেমনি আঁকা শেষ, অমনি অনস্ক্রিনে জামাই বলল, ‘মেসো এটা কিন্তু আমার।’ সেই শ্বশুর ও সেই জামাই– দু’জনেই আজ আর নেই। কিন্তু ম্যান্ডেভিল গার্ডেনের বাড়ির দেওয়ালে হাসছে সেই ছবি।
হুমায়ুন কবীর এবং আতাউর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ যেমন করেছেন, তেমনই আতায়ুর রহমানের পুত্র ছিল তাঁর জামাতা। অশোক মিত্র তাঁর ‘আপিলা চাপিলা’ বইতে সেই সাড়া-জাগানো ত্রিধর্মমিলিত বিবাহের উল্লেখ করেছেন।
……………………………………………………….
পড়ুন তর্পণ সিরিজের অন্য লেখা: হাওয়া, রোদ্দুর ও তারার আলোয় ভেসে যেতে পারত দেবারতি মিত্রর মন
……………………………………………………….
রণেন আয়ান দত্ত যেমন একটি যুগের নাম, তেমনই একটি যুগ পরিবর্তনের এপিটাফও তিনি। দু’দিক থেকে সাঁড়াশির মতো তাঁকে চেপে ধরেছিল এক অমোঘ শক্তির ‘যুগ পরিবর্তন’। একদিকে মাল্টিমিডিয়ার সুনামিতে ভেসে যাচ্ছিল ‘হাতের কাজের গর্ব’। ডিজিটালের বন্যায় রং-তুলি-তেলের কাজ ‘কদরহীন’-‘নজরহীন’ হতে শুরু করল। অন্যদিকে আঁকার ভুবনে প্রবেশ করল ‘বিমূর্ততার থিম’। জনজীবনে-দর্শনে-রাজনীতিতে দেখা গেল পাশ্চাত্যমুখীন ছাঁচে ‘আধুনিকতা’-র পেরেস্ত্রৈকা-গ্লাসনস্ত। এই বহির্বিশ্বমুখিতার ঝোঁক, প্রাদেশিক ভাষাতে তো বটেই, দেশীয় কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত সর্বস্তরের শিল্পক্ষেত্রের ‘আত্মবিশ্বাস হরণ’ করল। দেশজ দর্শন নির্ভর শিল্পকে অপ্রগতিশীলতার চোখে দেখতে অভ্যস্ত হল শিল্পরসিক ও শিল্পসমালোচক মন।
‘অবনঠাকুর-যামিনী রায়-শিক্ষিত’ রণেন আয়ান দত্তের ‘তুলি’, কোনও সমঝোতা-স্বীকার না করে, সম্পূর্ণ প্রচারসম্বলহীন ভাবে আপসহীন একটানা– ৯০ বছর পর্যন্ত করে গেলেন কাজ– কালের বুকে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে।
তাঁর জীবনকথা নিয়ে ‘যেতে যেতে’ নামের এখনও একটি অপ্রকাশিত বই তাঁর অধরা স্বপ্ন হয়ে রয়ে গিয়েছে এখনও।
তাঁর কাজের কোনও সংগ্রহশালা শুধু তাঁর কাজ সংরক্ষণের জন্য নয়, প্রচারের অভাবে একটা বিরাট সময় জুড়ে, এই ‘অনন্য খনি’ থেকে হয়তো বঞ্চিত হয়ে রয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, তা উন্মোচিত হোক পরবর্তী শিল্পী-প্রজন্মের কাছে। তাঁকে ‘শ্রদ্ধার্ঘ’ জানানোর নৈবেদ্যেই হয়তো পূর্ণ হয়ে উঠবে আমাদের অনন্য প্রাপ্তির ঝুলি।
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..