Robbar

দুর্গাবতী দেবীকে ‘দুর্গা ভাবী’ করার রাজনীতি ভুলিয়ে দিতে চায় তাঁর জীবন বাজি রেখে অস্ত্রপাচারের কথা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 22, 2025 8:41 pm
  • Updated:September 22, 2025 8:41 pm  

এক মেয়ের সচেতন রাজনৈতিক স্বত্তাকে শুধু একটি চাঞ্চল্যকর মুহূর্তে বন্দি করে রাখার মধ্যে একটা পরিকল্পিত রাজনীতি আছে। এই ভুলে যাওয়ার, ভুলিয়ে দেওয়ার রাজনীতির সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে মেয়েদের ‘দেবী’ করে তোলার ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি। দুর্গাবতীকে শুধুমাত্র ‘দুর্গা ভাবী’ করে দেওয়ার রাজনীতিও। এই রাজনীতি ভুলিয়ে দিতে চায় দুর্গাবতীর জীবন বাজি রেখে বারংবার অস্ত্রপাচারের কথা। ভুলিয়ে দিতে চায় সেই মেয়েটির কথা যাঁর শোষণমূলক রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে বাড়ির পিতৃতান্ত্রিক নিয়মাবলির সূত্রে– যে অলিখিত নিয়মাবলির স্বার্থে দুর্গাবতীর পিসি তাঁর ওপর একের পর এক অর্থহীন সাংসারিক কাজ চাপিয়ে দিত, যাতে তাঁর মাথায় কোনও ‘বিপজ্জনক’ ভাবনাচিন্তা আসার অবকাশ না থাকে। তবু, এলাহাবাদে জমিদারি ব্যবস্থায় ভূমিহীন কৃষকের শোষণ দেখে বড় হওয়া মেয়েটির মাথায় এক শোষণমুক্ত সমাজের বিপজ্জনক স্বপ্ন ভিড় করা বন্ধ করা যায়নি।

ঝিলম রায়

১৯ ডিসেম্বর, ১৯২৮। লাহোর স্টেশন।

লাহোরের কনকনে ঠান্ডায় গভীর রাতে এক ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়ায়। সেদিন গোটা স্টেশন ছিল পুলিশের দখলে। একের পর এক গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি চলছিল। কয়েক ঘণ্টা আগে সেদিন বিকেলেই স্যান্ডার্সকে খুন করা হয়েছে। অভিযুক্ত পাগড়িপরা এক শিখ তরুণ!

গোটা শহর স্তব্ধ করে তখন সেই তরুণের খোঁজ চলছিল। সেই শুনশান স্টেশনে আসা গাড়িটিতেও তল্লাশি করতে গেলে পুলিশ দেখেন এক সাহেবি দম্পতি তাঁদের কোলের ছেলেকে নিয়ে চলেছেন, সঙ্গে এক কাজের লোক। পুরুষটির পরনে সাহেবি কোট, প্যান্ট, চুল ছোট করে কাটা, মাথায় সাহেবি টুপি। মেয়েটির পরনে দামি শাড়ি, গয়না এবং লিপস্টিক। ছেলেটির কোলে একটু ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা। সঙ্গে গ্রাম্য জামা পরা এক কাজের লোক। নবীন দম্পতির কাছে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। কাজের লোকটি যাবে একই ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির কামরায়।

দুর্গাবতী দেবী

ট্রেন রওনা হয় লখনউয়ের দিকে। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তাদেরই নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যান সেই শিখ তরুণ, ভগৎ সিং। সঙ্গে দুর্গাবতী দেবী, তাঁর ছেলে সচিন এবং রাজগুরু। লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর বদলা নিতে ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি’র কর্মীরা ভগৎ সিং-এর নেতৃত্বে হত্যাকারী পুলিশ সুপার জেমস স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তবে ঘটনার সময় চিনতে না পেরে স্কটের জায়গায় তাঁরা খুন করেন সহযোগী সুপার জে. পি. স্যান্ডার্সকে।

ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডদের ধরতে পুলিশ গোটা শহর ঘিরে ফেলে। সমস্ত গাড়ি, ট্রেন থামিয়ে তল্লাশি চলতে থাকে। গভীর রাতে ভগৎ সিং, রাজগুরুরা আশ্রয় নিতে এসে পৌঁছয় তাঁদের কমরেড ভগবতীচরণ বোহরা এবং দুর্গাবতী দেবীর বাড়িতে। ভগবতী অবশ্য তখন কংগ্রেসের একটি সভায় অংশগ্রহণ করতে কলকাতায় গেছেন। দুর্গাবতীকে সংসারের যে কোনও জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্দেশ্যে দিয়ে গেছেন ৫০০ টাকা। দুর্গাবতী তাঁদের আশ্রয় দেন এবং সেই অসম্ভবের মধ্যেই শহর ছেড়ে পালানোর এক দুরন্ত প্ল্যান বাতলান। সেই পরিকল্পনা মতো ভগৎ সিং নিজের চুল ছোট করে কেটে, কোট প্যান্ট টুপি পরে পুরোদস্তুর সাহেব সেজে ওঠেন। দুর্গাবতী নিজেও সব থেকে দামি শাড়িটি পরে, মুখে পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে সেজে ওঠেন। কোলে নিয়ে নেন নিজের শিশু সন্তান সচিনকে। সঙ্গে সেই ৫০০ টাকা। রাজগুরু সেজে ওঠেন কাজের লোক হিসেবে। তিনজনেরই সঙ্গে লুকোনো পিস্তল। তিনজনে স্টেশন পৌঁছে নির্দিষ্ট ট্রেনে উঠলে কিছুক্ষণ বাদেই এক ইংরেজ পুলিশ এসে তাঁদের পরিচয়পত্র দেখতে চান। ভগৎ সিং তৎক্ষণাৎ সতর্ক হয়ে নিজের লুকোনো পিস্তলে হাত দিতে গেলে দুর্গাবতী ঠান্ডা মাথায় নিজের ছেলেকে চিমটি কাটেন। ছেলেটি কাঁদতে শুরু করলে তিনি অসহায় ভাবে তাকিয়ে সেই অফিসারের কোলে বাচ্চাকে দিয়ে পরিচয়পত্র খোঁজার ভান করলে সেই পুলিশকর্মী তাঁদের ‘ঠিক আছে, লাগবে না’ বলে চলে যান। নির্বিঘ্নে ভগৎ সিং, দুর্গাবতী, রাজগুরু লখনউ পৌঁছলে রাজগুরু সেখান থেকে বেনারসের ট্রেন ধরেন। ভগৎ সিং, দুর্গাবতী কলকাতার।

ইতিহাস বইয়ের পাতায়, সিনেমায়, গল্পগাথায় এই রোমহর্ষক মুহূর্ত অবিস্মরণীয় হয়ে আছে ভগৎ সিং-এর বীরগাথা হিসেবে। একই সঙ্গে এই একটি মুহূর্তই ইতিহাসের পাতায় আটকে দিয়েছে দুর্গাবতী দেবী ওরফে, ‘দুর্গা ভাবী’-কে। সেই মেয়ে যিনি জীবনের বাজি লড়ে ভগৎ সিংদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, যিনি তৎকালীন সামাজিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই বিপ্লবের স্বার্থে ‘পর’পুরুষের স্ত্রী সেজে ভিনরাজ্যে যাত্রা করতে পিছপা হননি। ইতিহাস সেই মুহূর্তকে মনে রেখেছে, মনে রেখেছে সেই দৃশ্যর সিনেমাটিক আবেদনকে, মনে রেখেছে সেই উত্তাল সময়ের রোমান্টিকতাকে। সেই উত্তাল সময়ের সামাজিক ওলটপালটের দাবির সামনে মাথা নত করেই ক্ষমা করে দিয়েছে দুর্গাবতী দেবীর সেই মুহূর্তের সামাজিক নৈতিক সীমালঙ্ঘনকেও। কেউ কেউ খুঁজতে চেয়েছে সেই ভারতীয় বিবাহিতা নারীর পরপুরুষের সঙ্গে যাত্রার মুহূর্তের রোমাঞ্চকতার অন্য মানে, কাটাছেঁড়া করেছে ভগৎ সিং এবং দুর্গাবতী দেবীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ককে। তাই ইতিহাসের পাতায় ঠিক যতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থেকেছে দুর্গাবতীর সেই মুহূর্তের লক্ষণরেখা পার, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থেকেছে কলকাতা পৌঁছলে তাঁর স্বামী ভগবতীচরণের সেই ঘটনার সহজ মেনে নেওয়া, স্ত্রীর কাজে গর্বিত হওয়া। সেটাই যেন একা হাতে বাঁচিয়ে রেখেছে দুর্গাবতীর দেবীত্বকে। আগলে রেখেছে তাঁর পবিত্রতা, তাঁর সম্মান। দুর্গাবতী দেবীকে স্মরণীয় করেছে ‘দুর্গা ভাবী’ হিসেবে। আর সেই দেবীত্বের আলো মুছে দিয়েছে দুর্গাবতীর রাজনৈতিক সত্তাকে। ভুলিয়ে দিয়েছে দুর্গাবতীর ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি’র (HSRA) সদস্য হওয়ার কথা। নওজওয়ান ভারত সভার সক্রিয় কর্মী হওয়ার কথা। ভগৎ সিং-এর কমরেড হওয়ার কথা। ভুলিয়ে দিয়েছে সেই সমস্ত বিপজ্জনক পরিচয়, সেই সমস্ত বিপজ্জনক কর্মকাণ্ডের কথা, যা প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ জানায় দেবীত্বের ধারণাকে, যা প্রতিনিয়ত ফুৎকারে উড়িয়ে দেয় সমাজের সমস্ত লক্ষণরেখাকে।

এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের প্রায় ৬০ বছর বাদে সেই দেবীর আড়ালে থাকা, সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে বাক্সবন্দি হয়ে থাকা রক্তমাংসের মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে নারীবাদী আন্দোলনের কিছু কর্মীরা পৌঁছে যান দুর্গাবতীর শেষজীবনের গাজিয়াবাদের আস্তানায়। জনসাধারণের চোখের আড়ালে এক অতি সামান্য জীবনযাপন করা বৃদ্ধা দুর্গাবতীকে খুঁজে বার করেন ঐতিহাসিক উমা চক্রবর্তীর এক বন্ধু, দুর্গাবতীর তখনকার আস্তানার পড়শি, শান্তি কাকার। সেই খবর পেয়েই উমা চক্রবর্তী এবং নারীবাদী প্রকাশক উর্বশী বুটালিয়া ১৯৮৮-র এক নভেম্বরে পৌঁছে যান দুর্গাবতীর সঙ্গে আলাপ করতে। এক কালে সংসার ত্যাগ করে বিপ্লবী জীবন বেছে নেওয়া দুর্গাবতী তখনও তাঁর বর্তমান সাংসারিক জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খেয়ে উঠতে পারেননি। সেই মুহূর্তে এই একদল মানুষের তাঁকে নিয়ে প্রচলিত গল্পগাথা, ইমেজ সরিয়ে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, তাঁর সত্তাকে বুঝতে চাওয়া যেন তাঁর সাধারণ জীবনে আবারও নতুন জোয়ার এনেছিল।

চার দফায় দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে দুর্গাবতী আক্ষেপ করেন, ‘সবাই মনে করে শুধু ভগৎ সিং-কে পালাতে সাহায্য করেছি। শুধুমাত্র ওই একটাই কাজ! অথচ আমি সেই সময় অস্ত্র পাচার করেছি, ঘরের কাজ সামলেছি, সংগঠনের  কেন্দ্র হয়ে থেকেছি, কুরিয়ার হয়েছি… সেই সমস্ত কিছু করেছি যা ছেলেরা করত। কিন্তু ওই একটি মুহূর্ত, ওই একটি ঘটনা যে বড় চঞ্চল্যকর– একটি মেয়ে একটি ছেলেকে পালিয়ে নিয়ে গেছে! কখনও কখনও রাগ হয়। বলে উঠি, মেয়েদের তো পুরুষরাই নিয়ে পালায়, আমরা যদি কখনও একজন পুরুষকে নিয়ে পালাই, তবে তাতে এমন আশ্চর্য কী আছে?’

আসলে, এক মেয়ের সচেতন রাজনৈতিক সত্তাকে শুধু একটি চাঞ্চল্যকর মুহূর্তে বন্দি করে রাখার মধ্যে একটা পরিকল্পিত রাজনীতি আছে। এই ভুলে যাওয়ার, ভুলিয়ে দেওয়ার রাজনীতির সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে মেয়েদের দেবী করে তোলার ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি। দুর্গাবতীকে শুধুমাত্র ‘দুর্গা ভাবী’ করে দেওয়ার রাজনীতিও। এই রাজনীতি ভুলিয়ে দিতে চায় দুর্গাবতীর জীবন বাজি রেখে বারবার অস্ত্র পাচারের কথা। ভুলিয়ে দিতে চায় সেই মেয়েটির কথা, যাঁর শোষণমূলক রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে বাড়ির পিতৃতান্ত্রিক নিয়মাবলির সূত্রে– যে অলিখিত নিয়মাবলির স্বার্থে দুর্গাবতীর পিসি তাঁর ওপর একের পর এক অর্থহীন সাংসারিক কাজ চাপিয়ে দিত, যাতে তাঁর মাথায় কোনও ‘বিপজ্জনক’ ভাবনাচিন্তা আসার অবকাশ না থাকে।

তবু এলাহাবাদে জমিদারি ব্যবস্থায় ভূমিহীন কৃষকের শোষণ দেখে বড় হওয়া মেয়েটির মাথায় এক শোষণমুক্ত সমাজের বিপজ্জনক স্বপ্ন ভিড় করা বন্ধ করা যায়নি। ১১ বছর বয়সে ভগবতীচরণ বোহরার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলেও সেই সময়ের আর পাঁচটা মেয়ের মতো সংসারের চার দেওয়ালে আবদ্ধ থাকা হয়নি দুর্গাবতীর। ভগৎ সিং-এর সমবয়সি দুর্গাবতী সেই প্রজন্মের মানুষ, যাঁরা স্বদেশি আন্দোলনের উত্তাল সময় শুধুমাত্র ঘরে আবদ্ধ থাকতে পারেননি। ভগবতী এবং দুর্গাবতী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন গান্ধীর নেতৃত্বে চলা অসহযোগ আন্দোলনে। তবে ভগৎ সিং-এর মতোই তাঁদেরও চৌরিচৌরার আন্দোলন থেকে গান্ধীর মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হতাশ করেছিল।

ন্যাশনাল কলেজে ভগৎ সিং-এর সঙ্গে ভগবতীর আলাপ হলে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তার যেন অনুরণন খুঁজে পান। যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকেন উত্তরপ্রদেশ, বাংলার বিপ্লবী ধারার সশস্ত্র সংগ্রামের সঙ্গে। বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের জেলজীবন নিয়ে লেখা, ‘বন্দি জীবন’ সেই সময় দুর্গাবতীর মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তাই তাঁর নামেই ছেলের নাম রেখেছিলেন শচীন্দ্র। তুলনামূলক ভাবে অবস্থাপন্ন হওয়ায় HSRA স্থাপিত হলে ভগবতী ও দুর্গাবতীর ঘরই হয়ে ওঠে সংগঠনের কাজের কেন্দ্র। দুর্গাবতী কাজ করতে থাকেন সংগঠনের কর্মী হিসেবে। কখনও এক মারাঠি মেয়ে সেজে শরীরের খাঁজে খাঁজে পিস্তল লুকিয়ে জয়পুর থেকে দিল্লি গিয়ে, কখনও দিল্লি থেকে পেশোয়ারে শেল বানানোর জন্য এক বস্তা পেতলের কৌটো পৌঁছে দিতে, তো কখনও নিজের নামে এক বাড়িভাড়া নিয়ে সেই বাড়িতে বোমা তৈরির কারখানা গড়ে তুলে দুর্গাবতীর রাজনৈতিক কাজকর্ম চলতে থাকে। তাই স্যান্ডার্সকে হত্যা করে ভগৎ সিংদের আশ্রয় খুঁজতে দুর্গাবতীর শরণাপন্ন হওয়া একেবারেই আশ্চর্যজনক নয়। একইভাবে কমরেডদের নিরাপদে পালাতে সাহায্য করতে ছদ্মবেশধারণ করাও দুর্গাবতীর কাছে ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নানা রাজনৈতিক দায়িত্বের মধ্যে একটি।

দেবীর ইমেজ আসলে দুর্গাবতীর রাজনৈতিক জীবনকে শুধুমাত্র একটি ঘটনায় সীমাবদ্ধ করতে চায়নি, সেই ঘটনাকে শুধু একটি মুহূর্তের আবেগ, সেই একটি মুহূর্তের রোমাঞ্চে আবদ্ধ করে খুব সচেতনভাবেই তাকে দুর্গাবতীর রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে। ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে দুর্গাবতীর রাজনৈতিক জীবন ওই ঘটনা দিয়ে শুরু হয়নি, ওই ঘটনায় শেষও হয়নি। মুছে দেয় নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করতে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির সাংসদে বোমা মেরে গ্রেপ্তার হলে তাঁদের ডিফেন্স কমিটিতে ছিলেন দুর্গাবতী। সংগঠনের তরফ থেকে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভগৎ সিং এবং উকিলদের মধ্যে কথোপকথনের সূত্র হওয়ার। জেলে খাবার দিতে যাওয়ার ছলে দুর্গাবতী ভগৎ সিংদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অনায়াসে খবর পৌঁছে দিতেন। যোগাযোগ রাখতেন উকিলদের সঙ্গে। পৌঁছে যেতেন তাঁদের প্রতিটি কোর্ট ডেটে। এমনকী রাজনৈতিক বন্দিদের মর্যাদার দাবিতে দীর্ঘ ৬৩ দিন অনশন করে শহিদ হলে লাহোর জেল থেকে যতীন দাসের শবযাত্রার মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দুর্গাবর্তী।

ভগৎ সিংদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হলে লুকিয়ে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আরউইনের সঙ্গে আলোচনার শর্ত হিসেবে কমরেডদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করতে অনুরোধ করেছিলেন দুর্গাবতী। গান্ধী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন একমাত্র দুর্গাবতী যদি প্রতিজ্ঞা করেন তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ত্যাগ করবেন, তবেই তিনি এই শর্ত রাখতে পারবেন। দুর্গাবতী স্পষ্ট জানান, তিনি নিজে কিংবা সংগঠনের তরফে এই প্রতিজ্ঞা করতে অনড়। গান্ধীর সঙ্গে সেই আলোচনা বিফল হলে ভগবতীচরণ ও অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে দুর্গাবতী ভগৎ সিংদের জেলব্রেক করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। ঠিক হয় ভগৎ সিংদের জেল থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ ভ্যানে বোমা মেরে তাঁদের মুক্ত করা হবে। ভগবতীচরণরা বোমা তৈরিতে মনোনিবেশ করলে ভগৎ সিং-এর পিসি সেজে তাঁর সঙ্গে জেলে দেখা করতে গিয়ে এই প্ল্যান সম্বন্ধে তাঁদের জানানোর ভার পড়েছিল দুর্গাবতীর ওপর।

ইতিমধ্যেই, একদিন রাবি নদীর তীরে বোমা পরীক্ষা করতে গিয়ে সেই বোমা হাতে ফেটে শহিদ হন ভগবতীচরণ। পুলিশের নজর এড়াতে তাড়াতাড়ি তাঁর দেহ দাফন করতে এত বছরের সাথীকে বিদায় জানানোরও সুযোগ হয়নি দুর্গাবতীর। রাতারাতি নিজেদের শেলটার ছাড়তে বাধ্য হন অন্য কমরেডদের সঙ্গে। সুযোগ হয়নি শোকপ্রকাশ করারও। উল্টে শোককে আগুনে পরিণত করতে ভগৎ সিংদের মুক্ত করার শেষ চেষ্টায় দুর্গাবতী পঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর মালকম হেইলিকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। হেইলিকে মারতে ব্যর্থ হলেও দুর্গাবতীর গুলি হত্যা করেছিল তার দুই শাগরেদকে। পুরুষ সেজে সেই ‘অ্যাকশন’ করে পুলিশের চোখে অনায়াসে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছিলেন দুর্গাবতী। কিন্তু সেই সময়ে ধরা না পড়লেও ভগৎ সিংদের লাহোর চক্রান্তের মামলাতেই তাঁদের কিছু কমরেড রাজসাক্ষী হলে তাঁদের বয়ানে বারবার উঠে আসে দুর্গাবতীর নাম। তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ফাঁস হয় এবং দুর্গাবতীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ব্রিটিশ সরকার। দুর্গাবতী বাধ্য হন ফেরার হতে। দীর্ঘদিন এই আস্তানা সেই আস্তানা, আত্মগোপন করে অবশেষে ১৯৩১-’৩২-এ তাঁর জেল হয়। তিন বছর জেল খেটে মুক্ত হলেও তার কিছু বছর পরেই ১৯৩৮-এ শ্রীরাম মিল ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করলে আবারও গ্রেপ্তার হন তিনি। জেলবন্দি হন ১০-১২ দিন।

দুর্গাবতীর বয়ানে উঠে আসে জেল জীবনের নানা কথা। জেল হাসপাতাল এবং মর্গের মাঝে একলা একটি সেলে বন্ধ হয়ে থাকার কথা। অকপটে স্বীকার করেন এতবার সংগঠনের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিলেও এই প্রথম দিনের পর দিন হাসপাতালে রুগীদের চিৎকার এবং মর্গে মৃতের আত্মীয়দের হাহাকার শুনে ভয় হয় তাঁর। রাজবন্দি হওয়ার সুবাদে তাঁকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি নিকটবর্তী আত্মীয়, কমরেডদের সঙ্গে। এমনকী দেখা করতে পারেননি নিজের ছেলের সঙ্গেও। সেই সমস্ত কষ্টের সঙ্গেই উঠে আসে জেলে থাকা আরেক কমরেড, সুশীলার ভোর রাতে জেলগার্ডদের নজর এড়িয়ে দুর্গাবতীর সঙ্গে দেখা করতে আসার গল্প। জেলের নির্মমতা, নিপীড়নের সামনে বন্ধুত্বের প্রতিরোধের গল্প।

দেশ ইংরেজ মুক্ত হলে দুর্গাবতী সংসদীয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে মন দিয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে। লখনউ-এ শ্রমজীবী শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন স্কুল। তবু লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েননি। লোকচক্ষুর আড়ালে বিস্মৃত জীবন কাটালেও ছেলেকে নিয়েই শামিল হয়েছেন নানা সময়ে নানা প্রতিবাদ মিছিলে। সেখানেও শোনা যায় দুর্গাবতীর ঘর বারবার হয়ে উঠেছিল বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীদের আশ্রয়স্থল।

কিন্তু ভগবতীচরণ শহিদ হওয়ার পরেও কেন আমৃত্যু টিকে গেলেন দুর্গাবতী লড়াইয়ের ময়দানে? এটা কি তাঁর জীবনসঙ্গীর রাজনৈতিক স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যেতে? নাকি তাঁর নিজস্ব মতাদর্শগত দায়বদ্ধতায়? সপাট উত্তর দেন দুর্গাবতী, নিজেকে বুঝে না নিলে কি টিকে থাকতে পারতাম? সহজেই টলে যেতাম তো! এই দৃঢ়তাই যেন এক নিমেষে খান খান করে ‘দুর্গা ভাবী’ থেকে তিনি হয়ে ওঠেন দুর্গাবতী। এই নিষিদ্ধ জীবন ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের দেবীত্বের কোনও কাঠামোই ধারণ করতে অক্ষম। রাষ্ট্রীয় ইতিহাস জায়গা দিতে নারাজ এই আপসহীন বিপজ্জনক জীবনকে। তাই রাষ্ট্র, সমাজ দুর্গাবতীর এই রাজনৈতিক সত্তাকে চূর্ণ করতে চেয়েছে তাঁর জীবনকে খণ্ডিত করে। তাঁর মতাদর্শকে বোতলবন্দি করে পেশ করতে চেয়েছে নিরাপদ বিন্দুতে।

যে গৃহস্থালি কোনও দিন বাঁধতে পারেনি দুর্গাবতীকে, সেই পরিকাঠামোতেই বেঁধে ছেঁচে ফেলতে চেয়েছে ‘দুর্গা ভাবী’র আদলে। তবে এই বিপজ্জনক মেয়েদের আগুনকে বশ করতে গিয়ে রাষ্ট্র ভুলে গেছে এই আগুন ছড়িয়ে গেলে তা দাবানল হয়ে এই ব্যবস্থাকেই পুড়িয়ে তছনছ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেই আগুন ছড়িয়ে যায় দুর্গাবতী থেকে প্রীতিলতায়। প্রীতিলতা থেকে বীণা দাসে। বীণা দাস থেকে মাতঙ্গিনীতে। মাতঙ্গিনী থেকে ইলা মিত্রে। ইলা মিত্র থেকে অহল্যায়। অহল্যা থেকে ধনেশ্বরী দেবীতে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একে অপরের হাত থেকে মশাল নিয়ে সেই আগুন শান দিতে থাকে দিনবদলের স্বপ্নে।

নিজস্ব পরিচয়ে, নিজস্ব মতে, নিজস্ব শর্তে।

………………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন ঝিলম রায়-এর অন্যান্য লেখা

………………………..