কলোনিতেই আদর-অনাদরে মায়ের তিন সন্তান বড় হয়ে উঠছে। দুম করে মা বদলি হয়ে গেল রংপুরে। কারমাইকেল কলেজ। নাকি পানিশমেন্ট ট্রান্সফার। শুরু হল উদ্বাস্তু জীবন। একবার দাদির মোতালেব কলোনি তো আবার নানুর সেগুন বাগান। শেষমেশ ধানমন্ডির গা ছোঁয়া কলেজ স্ট্রিট। উধাও ঈদের জমজমাট আনন্দ! মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মা ছেলেমেয়ে নিয়ে আগরতলা কলকাতা হয়ে শান্তিনিকেতনে। ঈদের সময় মায়ের কিপটের মতো শুধু জর্দা পোলাও রান্না। দু’-একজন বন্ধু আসে কি আসে না। ব্যস ওইটুকুই। স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পরে নানুর আশ্রয়ে কিছুদিন থেকে মা থিতু হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকায়। প্রায় দুই দশক অন্য এক ঈদের স্বাদ।
১.
ঈদ! জামাতে যাব। ভোরবেলাতেই নানার পিছু ধরেছি। বিশাল পাঞ্জার মধ্যে খুদে আঙুল গুঁজে দিয়ে সেগুন বাগান থেকে রওনা। কোথায়? সে কি আর আমি জানি! নানার গন্তব্য ছিল কাকরাইল মসজিদ। মানুষ আঁটে না। পাশের রমনা উদ্যানে কাতার বাঁধে মুসল্লিরা। নামাজ দোয়া আর কোলাকুলি সেরে আলাভোলা কাজী মোতাহার হোসেন যে ঠিকঠিক নাতিকে ফিরিয়ে এনেছেন– সে বড় ভাগ্যি! দু’চার আনা ঈদিও কি মিলেছিল? সে-ই ঈদের স্মৃতির শুরু। বয়স, সম্পদ, পেশা, দেমাক ভুলে ছোট-বড় প্রত্যেকের মিলনমেলা, আনন্দমেলা!
২.
তখন থেকেই ঈদ মানে ভেদাভেদ ভুলে আনন্দ, খেলাধুলো, খাওয়া-দাওয়া। একসময়ে হয়ে উঠল বেড়ানোর উপলক্ষ। ঈদ আসছে, আমরা আনন্দে ফুটছি। ঈদের ছুটিতে বেরিয়ে পড়ার রেওয়াজ শুরু আমাদের ঘরে। রাজেন্দ্রপুর বা শ্রীপুর। দিন দুয়েক ধরে মায়ের গোছগাছ। তোয়ালে-সাবান, পেস্ট-ব্রাশ, জামা-জাঙিয়া, ডেটল-বার্নল, টর্চ-মোমবাতি-দেশলাই। কী নেই! সব নিয়ে মা পরিপাটি। ঝামেলা আমাকে নিয়েই। বাড়তি জামা চাই। বলতে নেই, বিছানা ভেজানোর রোগ ছিল তো!
ট্রেনে যাওয়া-আসা। স্টেশনের কাছেই সরকারি রেস্ট হাউস। একদম হাঁটাপথ। কিন্তু বাক্স-প্যাঁটরার ঝক্কি। রিকশায় উঠতেই হয়! একেবারে শুনশান। গোটা বাংলোই আমাদের। মাটিতে গাছের মোটা মোটা কান্ড পোঁতা। তার ওপরে গোটা বাড়ি। কাঠের। নীচটা ফাঁকা। সেখানে কুকুর-বেড়ালের আনাগোনা। ওপরে আমরা। তিন-চারখানা ঘর। আলাদা কিন্তু অদূরে রান্নাঘর, কর্মচারীদের বাস। হাঁক পাড়লেই সব হাজির!
ছড়ানো চৌহদ্দি। বাংলোর চারপাশ বেশ ফাঁকা। আসমান-জমিন চোখ জুড়ানো সবুজ ঘাসে ছাওয়া। সীমানার চিহ্ন শুধু বড় বড় শাল-গজারি-সেগুন-মেহগনি। মাঝে মাঝে নানা লতাগুল্মের ঝোপ। সেসব ছাড়িয়ে গাছের আড়ালের একধারে ক্ষয়া মাটির পথ। কোনও কালে রেললাইনের মতো টুকরো পাথর ফেলেছিল। চিহ্ন থাকলেও, অস্তিত্ব নেই। ওই-ই এলাকার রাজপথ। পথের ধারে দাঁড়ালে ক্বচিৎ-কদাচিৎ একটা-দুটো গরুর গাড়ি বা রিকশা চোখে পড়ে। টানা গাড়ির চাকার ক্যাঁচর-ম্যাঁচর ছাড়া শহুরে গাড়িঘোড়ার আনাগোনা-আওয়াজ কোনওটাই জ্বালায় না।
ভেতরে যাওয়ার একচিলতে পথ ছাড়া বাংলো সীমানার সব ধারই শাল-গজারি-সেগুনের দখলে। এতই ঘন যে, মুহূর্তেই নিরুদ্দেশ হওয়া যায়। নিজে ফেরার পথ পাওয়া যেমন কঠিন, অন্যেও খোঁজ পাবে না। জংলাভূমিতে প্রকৃতির কোলে কাঠের বাংলোয় দিনযাপন। দিনের ঝকঝকে আকাশ, সুরো-বেসুরো পাখির কাকলি। রাতের আঁধার ফিকে করা চাঁদের আলো, জোনাকি, ঝিঁঝিঁর ডাক। কী নৈসর্গিক! শহরের দালানকোঠা আর পথেঘাটে বেড়ে ওঠা আমাদের জন্য সব মিলিয়ে রীতিমতো স্বর্গবাস!
মনে হত, আমি বুঝি টারজান। দাপটে আফ্রিকার জঙ্গলে চরে বেড়াচ্ছি। মাঝেমধ্যে হিরোর মতো হাঁক দিয়েও বসতাম। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্করের মতো বুকভরা সাহস নিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দু’-এক পা ফেলেও দেখেছি। ওসব অ্যাডভেঞ্চার আর খেলাধুলা। আদরের দখল নিয়ে ভাইবোনের ঝকাঝকি আর গাল ফোলানো। আনন্দেই কাটত বাবা-মায়ের ছুটির দু’-চারদিন।
দিনের বেলা যেমন তেমন। গা-ছমছম করত রাতে। ফিকে চাঁদের আলো পেলেও হ্যারিকেন বা হ্যাজাকের আলোই ভরসা। মায়ের ব্যাগে থাকে মুশকিল আসানের মোমবাতি-দেশলাই। দিনের আলো একেবারে মরে এলে সবাই জোট বাঁধি বাংলোর বারান্দায়। কিছু ভাজা-পোড়ার সঙ্গে এই গল্প, সেই গল্প। জিভের সুখ মিটলে পরে গান। হারমোনিয়ামে মা। হই হই করে গলা মেলাই সবাই। আঁধারে বিশেষ আর কিছু করার থাকে না। রাতের খাবার আগেভাগে সেরে বিছানায় সবাই। ওসব ছুটির সময় তখন আবহাওয়া বেশ নিরপেক্ষ। তবে সময় সময় কাঠের তক্তার মেঝের ফাঁক গলে শীতের আঙুল আঁকড়ে ধরে। কাঁথা মেলে কি না মেলে, কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালটা বরাবরই ঝলমলে। বারান্দার রেলিং ছাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকছে কাঠের চওড়া সিঁড়ির পাশের মর্নিং গ্লোরি। মা-ই চিনিয়ে দিয়েছে। ওই ফুল নাকি সকাল সকাল পাপড়ি মেলে আর বেলা পড়তে পড়তে এলিয়ে যায়। স্কুলে যাওয়ার ছুট নেই বলে সকালের নাস্তায় মায়েরও ঢিলিমিলি। ওই ফাঁকে আবিষ্কার করি– ছুঁলেই আত্মরক্ষার জন্য পয়সা হয়ে ওঠা কেন্নো; সার বেঁধে ব্যস্তসমস্ত পিঁপড়েগুলো কোথায় ছোটে; লাজে মুখ গোটানো লজ্জাবতী। ডানপিটে অপালা নেতা। পয়সা-কেন্নোকে ছুড়ে দূরে ফেলত; পিঁপড়ের সারি ভেঙে দিত; ঝোপঝাড়েও ওর অবাধ বিচরণ, পাতার লজ্জা আর ছুটবে কী! বুড়ো আঙুলটা মুখে ঠুসে রুচি চলত পেছন পেছন। সাহসে কুলালে কেবল আমিই অপালার ডাকাতে-কাজকারবারে কথা বলি, আপত্তি করি। ধমক বা চড়-চাপড় খেলে, সেও আমি। দিন কেটে যেত ঘোরাঘুরি আর নয়া নয়া আবিষ্কারে।
জোগাড়যন্ত্র, কোটা-বাছা, রান্নাবান্না আর গোছগাছের মধ্যে মা শুধু কোনও ফুট ফরমাশ দিতে বা খাওয়ার সময় আর আঁধার ঘনালে ছোটদের দিকে নজর ফেরাত। ফরমাশ খাটতে আমরা রীতিমতো পাল্লা দিতাম। টেবিলে প্লেট-গ্লাস পাতা, দেশলাইটা এগিয়ে দেওয়া, পাতিলে একটু টিউবওয়েলের পানি ভরে আনা, আলু-পটল ধুয়ে দেওয়া– কত্ত সব কঠিন-কঠিন দায়িত্ব! আমরা আবার হিসাবও রাখতাম, কে কোনদিন কত বেশি কাজ করেছি।
আনন্দে ক’টা দিন কাটিয়ে নিরানন্দে বাড়ি ফিরতাম আমরা। আজিমপুরের সরকারি কলোনি। আবার যন্ত্রের মতো ছকে বাঁধা জীবন। নিয়ম বেঁধে খাওয়া-দাওয়ার বাইরে, সকালে ওঠো স্কুলে যাও; ফিরে মাঠে খেলা; সন্ধ্যায় অন্য কারও বাড়িতে টিভি দেখা; রাতে পড়ার টেবিলে ঝিমোনোর পর মায়ের গল্প শুনতে শুনতে ঘুম। মাঝে সাঝে গান নিয়ে বসত মা, বাবা।
৩.
কলোনিতেই আদর-অনাদরে মায়ের তিন সন্তান বড় হয়ে উঠছে। দুম করে মা বদলি হয়ে গেল রংপুরে। কারমাইকেল কলেজ। নাকি পানিশমেন্ট ট্রান্সফার। শুরু হল উদ্বাস্তু জীবন। একবার দাদির মোতালেব কলোনি তো আবার নানুর সেগুন বাগান। শেষমেশ ধানমন্ডির গা-ছোঁয়া কলেজ স্ট্রিট। উধাও ঈদের জমজমাট আনন্দ! মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মা ছেলেমেয়ে নিয়ে আগরতলা কলকাতা হয়ে শান্তিনিকেতনে। ঈদের সময় মায়ের কিপটের মতো শুধু জর্দা পোলাও রান্না। দু’-একজন বন্ধু আসে কি আসে না। ব্যস ওইটুকুই। স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পরে নানুর আশ্রয়ে কিছুদিন থেকে মা থিতু হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকায়। প্রায় দুই দশক অন্য এক ঈদের স্বাদ।
ঈদের ভোরবেলা জামাতে যাওয়ার কথা বলে ছেলেরা বেরিয়ে পড়ে। আগে তো আড্ডা! গায়ে নতুন জামা। কেউবা পুরনো পাঞ্জাবি পরেই হাজির; বিকেলে নতুনটা গায়ে দেবে। তখন কি আর হাফ ডজন থেকে এক ডজন জামা মিলত! মসজিদ থেকে ফিরে বন্ধুরা সব নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য ঘরে ঢুঁ মারতাম। তখন বাড়ি-বাড়ি হামলা করাই মোক্ষ। ওই অত্যাচারে কী-ই যে খুশি হতেন খালা-খালু, চাচা-চাচিরা! কোয়ার্টার্সের নানা বাড়িতে খেয়ে টইটম্বুর। বাড়ি ফিরে চৌচির ফাটাপেটে আর কিছু দিতে পারি না। অথচ সকাল সকাল লুচি-তরকারি করে রাখে মা। ততদিনে জর্দা পোলাওয়ের পাশে, চটপটি, পুডিং, নেশাস্তার হালুয়া, ঝুরো সেমাই সাজাতেও শিখেছে। কিন্তু কে ছোঁয় অত! ফালুদা, দহি-বড়া, বিরিয়ানি নিয়ে অন্য বাড়ির নানা স্বাদের নানা পদের পর কি আর বাড়ির রান্না জিভে রোচে! বন্ধুরা ঠিকই হাপুস-হুপুস খেত। ওদের তো অন্য বাড়ি! মায়ের তাতেই তৃপ্তি।
৪.
চুরানব্বইয়ে মা রিটায়ার করল। উঠে গেলাম সেগুন বাগানের পুরনো বাড়িতে। সেখান থেকে গ্রিন রোড হয়ে ধানমন্ডি। তিন ভাইবোনই সংসারী। ছেলেমেয়ের মা-বাবা। থাকি একসঙ্গে, আবার আলাদাও। একই দালানের নানা ফ্ল্যাটে। মায়ের বয়স হয়েছে। জনে জনে আর ঈদের জামা-কাপড় কিনে দেওয়ার মুরোদ নেই। কিছুদিন ধরেই নতুন কায়দা ধরেছে। খামে খামে নাম লিখে পাঁচশো, হাজার দিয়ে দেওয়া। ততদিনে ঈদির চলও ঘরে ঘরে। তাতে মা আবার বারাবরের মতো। মিতব্যয়ী। সে যে-ই হোক, মাথাপিছু ১০০ টাকা। তবে সব চকচকে তাজা গন্ধ ছড়ানো নোট।
ঈদের সকালে আমরা বের হয়েই প্রথমে যাই মায়ের ওখানে। বেজায় খুশি সুগন্ধি ফুল পেলে। মুখে চওড়া হাসি। বেদম বিরক্ত অন্য যে কোনও উপহারে। একা থাকে। আগে নিজের হাতে রাঁধত। আইটেমের সংখ্যা দিনে দিনে কমেছে। যাই থাক খাওয়ার জন্য জোরাজুরি, ঈদি দেওয়া আর পুরনো গল্পে মশগুল থেকে মায়ের সকালটা আনন্দেই কাটত। দুপুরে এক বাসায় তো রাতে অন্য বাসায় সবাই মিলে খাওয়া। ছাদ দিয়ে, লিফট দিয়ে মা চলে আসত। পরের দিকে লাঠি হাতে। কমজোরি হাঁটু। শেষে আর পেরেই উঠত না। সবাই খাবার নিয়ে সাজিয়ে দিয়ে আসতাম। সেই খেয়েই কত খুশি! কাজের মানুষের একঘেয়ে খাবার থেকে মুক্তি, স্বাদবদল।
মা আমার। এই প্রথম তোমার সঙ্গে ঢাকায় থেকেও ঈদের আনন্দ উপভোগ করা হল না। তোমার মিটি মিটি আর চওড়া হাসির দেখা পেলাম না। হল না– অভিনয় করে করে, গলা আর সুর অবিকল নকল করে তোমার পুরনো নানা মজার ঘটনার স্মৃতিচারণ– সবার মধ্যে হাসির হররা তোলা। যেখানে শুয়ে আছ, শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে রেখেছ। সে হাতের অদৃশ্য ছোঁয়া আর অমোঘ ছায়া যেন সকলকে অনন্তকাল এবং সকল সময়েই ভেদাভেদ ভোলা ঈদের আমেজ-আনন্দে রাখে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved