একে একে যোগ করলে দুই হয় তা কে না জানে! এটা হচ্ছে যোগের অঙ্ক, বা গুণের অঙ্ক– দুই এক্কে দুই। আবার বিয়োগের বা ভাগের অঙ্কেও দুই হয়, যখন বাস্তবে দেখি যে একটা জিনিসকে কেটে দু’-খণ্ড করা হচ্ছে। বাঁদরের পিঠে ভাগ, নেতাদের দেশভাগ, শরিকের সম্পত্তি ভাগ, এমনকী– হয়তো সমাজে ‘আত্ম’ আর ‘অপর’-এর ভাগ। তার একটা ভালো নাম ‘দ্বিধা’– সেটা মনের খুব একটা ভালো অবস্থা নয়। ইদানীং, ইংরেজিতে বাইনারি (binary) কথাটাও খুব চালু হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমে এই ভাষা আর চিন্তার বাইনারি এক জায়গায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে– বকুনিও খেয়েছে। সেটা দার্শনিক জাক দেরিদার কাছে।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
১.
এই সংখ্যাটার মধ্যে যে ট্র্যাজেডি কমেডি– দুই-ই লুকিয়ে আছে, সেটা অনেকে খেয়াল করেন না। আমরা যেহেতু শেষ পাতে মিষ্টির পক্ষপাতী, তাই ‘দুই’-এর তেতো বা দুঃখের কথা দিয়েই আগে শুরু করি। যার প্রথম প্রসঙ্গ হল– দুই, একের কাছে কীভাবে হেরে আছে, তাই নিয়ে। একের যেমন আঁটোসাঁটো বিপুল গৌরব, দু’য়ের কি তেমন গৌরব আছে? এক না বলে বাংলায় ‘রাম’ কথাটাও চলে, তাতেই, ভারতে বিজেপি আসার অনেক আগে থেকেই, একের মহিমা বোঝা যায়। এক ক্লাসের ফার্স্ট বয় (নাকি গার্ল?), দুই বেচারা তো জীবনে ফার্স্ট হতে পারল না ক্লাসে, অভিভাবকদের কাছে নিশ্চয়ই তার প্রচুর হেনস্তা হয়। সমাজেও দু’-নম্বরিদের খুবই দুর্নাম; যদিও দু’-নম্বরি লোকজনে সমাজ ছয়লাপ, তারাই এখন গ্লোরিয়াস মেজরিটি। কিন্তু এক হতে পারল না– এ দুঃখ তো একের পরবর্তী তিন, চার থেকে অনন্ত সংখ্যারও। কাজেই এ নিয়ে দুই আদৌ এখন আর ভাবে কি না, জানি না। ক্রিকেটের ‘দুসরা’ বলের কী মহিমা, তা অবশ্য আমি জানি না, তা ক্রিকেটপ্রেমীরা বলতে পারবেন। তা ভালো না মন্দ, বোলারের কাছে ভালো হলে ব্যাটারের কাছে মন্দ– তা তো হতেই পারে। তাকে ট্র্যাজেডি কমেডির ছকে ফেলতে পারব কি না, জানি না।
একে একে যোগ করলে দুই হয় তা কে না জানে! এটা হচ্ছে যোগের অঙ্ক, বা গুণের অঙ্ক– দুই এক্কে দুই। আবার বিয়োগের বা ভাগের অঙ্কেও দুই হয়, যখন বাস্তবে দেখি যে একটা জিনিসকে কেটে দু’-খণ্ড করা হচ্ছে। বাঁদরের পিঠে ভাগ, নেতাদের দেশভাগ, শরিকের সম্পত্তি ভাগ, এমনকী– হয়তো সমাজে ‘আত্ম’ আর ‘অপর’-এর ভাগ। তার একটা ভালো নাম ‘দ্বিধা’– সেটা মনের খুব একটা ভালো অবস্থা নয়। ইদানীং, ইংরেজিতে বাইনারি (binary) কথাটাও খুব চালু হয়েছে, জ্যোতির্বিদ্যার পুরনো কথা এটা। বাইনারি হতে তারাদের কোনও আপত্তি ছিল বলে মনে হয় না, ভাষাবিজ্ঞানেও সমস্যা নেই। আর কম্পিউটারের কাজকর্মের সব কিছুই শুনেছি তৈরি হয়েছে বাইনারি নীতির ওপরে, ০ আর ১– এই দু’টি সংখ্যার নানা কায়দা করে। কিন্তু পশ্চিমে এই ভাষা আর চিন্তার বাইনারি এক জায়গায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে– বকুনিও খেয়েছে। সেটা দার্শনিক জাক দেরিদার কাছে। তিনি দেখিয়েছেন যে, ভাষায় যে সব বাইনারি বা ‘দ্বিভাজন’ আমরা ব্যবহার করি, যেমন আলো-অন্ধকার, নরনারী– সেগুলোতে নাকি প্রথমটার দিকে সমাজের একটু পক্ষপাত থাকে। ‘নরনারী’ কথাটা পৃথিবীর সমাজে পুরুষপ্রাধান্যের একটা চিহ্ন নাকি। ইংরেজিতেও দেখুন ‘men and women’ কথাদুটোয় ‘man’ কেমন কোঁচা দুলিয়ে আগে এসে বসেছে, ভাষাকে ঘাড়ে ধরে বুঝিয়েছে যে, ‘ওরে, আমার জায়গা আগে, তারপরে ওই শাড়িটাড়ি-পরা জীবগুলো’। তবু দুইয়ের মায়া মানুষ ছাড়তে পারে না। আলো-অন্ধকার, আলোছায়া, কাপড়চোপড়, বইটই, ঘ্যানঘ্যন, বাড়ি বাড়ি, হইচই– মানুষের কোনও কোনও ভাষা বানিয়েই চলে। ডবলের শখ মানুষের থেকেই যায়।
সব জায়গায় যে আধখানা বা ভাঙাচোরা জিনিস দাঁড়ায় তা অবশ্য নয়, দুটো সম্পূর্ণ এককও তৈরি হয়ে যায়। অ্যামিবার ক্ষেত্রে তো দুটো জ্যান্ত অ্যামিবাই পাই আমরা। আবার ‘একের পিঠে দুই, চৌকি চেপে শুই’-এর দুই আসে একটা ক্রম ধরে, একের পরে তাকে আসতেই হবে, তারপরে অনন্তের দিকে সংখ্যারা যাত্রা করুক আর না করুক। ওখানে ঠিক সময়ে দুই হাজির না হলে সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়ত, শূন্যকেও পাওয়া যেত না।
এমন যে দুই, সে যে জরুরি তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এক থেকে শূন্য, প্রাচীন এই দশটা সংখ্যা মারাত্মক সংখ্যা। প্রাচীন ভারতীয় মনীষা উদ্ভাবন করেছিলেন, না করলে পৃথিবী অন্ধকার যুগে পড়ে থাকত। তাতে একও যেমন জরুরি, দুইও তেমনই। ইউরোপ সেটা আরবদের কাছ থেকে পেয়েছিল, তাই একসময় ভুল করে ‘অ্যারাবিক নিউমেরালস’ বলত এই সংখ্যাগুলিকে, এখন শুধরে নিয়ে ‘হিন্দু নিউমেরালস’ বলে। ‘দুই’ তাদেরই একজন সম্মানিত সদস্য। ওই তালিকার মধ্যে তাকে একের পরে আর তিনের আগে থাকতেই হবে। ওই জায়গা থেকে তাকে কোনও পিতার পুত্র সরাতে পারবে না।
২.
এবার একটু পরিষ্কার কমেডির জায়গায় আসি। অবস্তুক বা abstract সংখ্যার ব্যাপারটা গণিতবিদদের জন্য থাক, আমার মতো অঙ্কে বাজে নম্বর পাওয়া লোকের তা নিয়ে বেশি বাচালতা করতে গেলে বিপদ আছে। তাই বিমূর্ত থেকে মূর্তির জগতে আসি। তবে এই তালে একটু দেবলোক হয়েও আসি। শুনেছি, ভগবান বিষ্ণু একবার খুব একাকিত্বে ভুগছিলেন, আজকাল যাকে ‘ডিপ্রেশন’ বলে। ব্রহ্মা আর মহেশ্বর অবশ্য আশেপাশে ছিলেন, কিন্তু ওই stag party বা all male company ঠিক তাঁর জুতসই লাগছিল না। তাই তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘একোহং বহুস্যাম্’। না অদ্বৈত হয়ে তত সুখ নেই, দ্বৈতই ভালো। খ্রিস্টানদের আদমও এইরকমই ভাবছিল কি না কে জানে, বিষ্ণুদেবের সঙ্গে তার কোনও আলোচনাও হয়েছিল কি না জানি না, কিন্তু সেও একসময় নিজের বুকের হাড় থেকে প্রথম মানবী ইভকে তৈরি করে ফেলল। তাদের সংসার তৈরি হল। তবে তাদের ছেলেপুলের সংসার তত সুখের হয়নি, তা আমরা জানি। আর বিষ্ণু যখন ওই কথা ভেবেছিলেন, জানি না, তখন লক্ষ্মীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে-থা হয়েছিল কি না। এই সব দৈব গেরস্থালির প্রত্নতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই নেই। তাই বললেন, বোধ হয়ে সংস্কৃতেই, যে, আমি একা আছি, বহু হতে চাই। অতএব তিনি মর্তলোকে যখন কৃষ্ণ হয়ে লীলা করতে এলেন তখন শ্রীমতী লক্ষ্মী রাধা হয়ে অবতীর্ণ হলেন। তারপর থেকে তাঁদের লীলা বর্ণনা করতে অভিধানের ‘যুগল’ কথাটা নিয়ে প্রচুর টানাটানি চলল। তারপর ‘দুহুঁ’, ‘দোহাঁ’ ইত্যাদি শব্দ নিয়েও পিংপং খেলা প্রচুর হয়েছে। তাই আমাদের স্মৃতিতে এরকম একটি ‘made for each other’ যুগলের ছবি চির-উজ্জ্বল হয়ে আছে। রাধা আর কৃষ্ণ ঠিক গেরস্থালি গড়ে তোলেননি, যদিও বৈষ্ণবদের একাংশ বিশ্বাস করে যে রাধা আর কৃষ্ণের বিয়ে হয়েছিল। যাই হোক, ওই ‘লীলা’ ছাড়া, তাদের বাস্তব, অর্থাৎ বাজার-আনা, রেশন-তোলা, বাচ্চাদের স্কুলবাসে তুলে দেওয়া বা নামিয়ে আনা– এসব-সংক্রান্ত সংসারের বিশেষ কোনও খবর কোথাও নেই।
কিন্তু নিছক নর আর নারী– দু’য়ে মিলে যে একটি সম্পূর্ণ ইউনিট তৈরি হয়, তাতে এইরকম একটা সংসার আস্তে আস্তে গড়ে উঠতে থাকল। একদিনে হয়নি। আপনারা সকলেই নানা নৃতত্ত্বের বই বা রাহুল সাংকৃত্যায়ন পড়েছেন– আপনারা জানেন যে, একজন পুরুষ আর একজন নারীর সংসার গড়ে উঠতে হাজার হাজার বছর লেগেছে। তবু শেষ পর্যন্ত ‘ফ্যামিলি’ বলে একটা ব্যাপার ওই দুইজনের একটা বৈধতা তৈরি করেছে।
আর এ-ও ঠিক যে, ওই পুরুষ আর নারী মিলে একটি নান্দনিক ‘twosome’ তৈরি করলেও, আর লোকবিশ্বাসে ‘marriages are made in heaven’ বলা হলেও পশ্চিমি সমাজে মৃত্যুর বদান্যতা ছাড়াই স্ত্রীর স্বামী আর স্বামীর স্ত্রী বদলেছে। দুই সংখ্যাটা কনস্ট্যান্ট থেকেছে শুধু।
রাজারাজড়াদের ব্যাপারে এই দুইয়ের হিসেবটা কোনও দেশেই খুব খাটত তা নয়। আরব্য রজনী থেকেই আমরা হারেমের উল্লেখ পাই, তবে আমাদের দেশেও একাধিক স্ত্রী সংগ্রহের ব্যাপারে রাজারা খুব উদাসীন ছিলেন তা নয়। রাম মোটামুটি একনিষ্ঠ হলে কী হবে, তার পিতাঠাকুরেরই তো একাধিক গৃহিণী ছিল। মহাভারতেও দুই পুরুষসিংহ– ভীম, অর্জুন নানাসূত্রে একাধিক স্ত্রী পেয়ে গিয়েছিলেন। আর এদেশে যখন কুলীন-ব্যবস্থা শুরু হল তখন পুরুষটির তো পোয়া বারো, যাকে ‘one to one correspondence’ বলে তাকে উৎখাত করে ‘one to many correspondence’-এর প্রতিষ্ঠা হল বামুন-টামুনদের মধ্যে। ওই ‘ওয়ান’টি অবশ্যই পুরুষ, আর ‘মেনি’টি অবশ্যই নারী। কাজেই এক + এক দু’য়ের ছক ভাঙার ব্যবস্থাও অনেক সমাজ ফুর্তি সহকারে তৈরি করেছিল। মৃত্যুর পর একজন স্বর্গ বা নরক যেখানেই যাক না কেন, তাদের সুখের অভাব যাতে না ঘটে সেজন্য তাদের স্ত্রী এবং রক্ষিতাদেরও পোড়ানোর সুবন্দোবস্ত করেছিল।
তবু পৃথিবীর কবিরা এই পরস্পরের সম্পূরক দুইয়ের বন্দনা গাইতে শুরু করেছেন। এই ‘তুমি আর আমি’ মিলে যে দুই, এই ‘হাম দো’ (‘হামারে দো’ বেশ কিছু পরে এই মহান ভারতে দেখা দেবে)। শেলি যেমন করেছিলেন তাঁর “Love’s Philosophy” কবিতায় যে, বলেছিলেন, ‘Nothing in the world is single’– তার ইঙ্গিত তো এই যে, দুই কে চাই, দু’য়ে মিলে একটা এক হতেই পারে। রবীন্দ্রনাথও ‘মহুয়া’র ‘মিলন’ কবিতায় তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেছেন ‘সৃষ্টির প্রাঙ্গণে দেখি বসন্তে অরণ্যে ফুলে ফুলে দুটিরে মিলানো নিয়ে খেলা’। অর্থাৎ এক-কে দুই হতেই হবে, আবার দুই মিলিয়েও এক হয়। জানি না এভাবেই দুই একের কাছে হেরে যাওয়ার বদলা নিল কি না। কিন্তু এই প্রেমবিবাহ ইত্যাদির সেন্টিমেন্টাল এলাকায় মানবসমাজ ওই সংখ্যার বহিঃসীমাও দুইয়েই বেঁধে দিয়েছে, যদিও এখানেই সমাজকে কাঁচকলা দেখিয়েছে অনেকেই। তবু ‘Two is a company, three is a crowd’ কথাটা লোকে ভুলে যেতে চায়নি। আর কে ভাবতে পেরেছিল যে আমাদের দেশে ‘হাম দো, হামারে দো’ বলে সন্তানের সংখ্যাও এরকম বেঁধে দেওয়া হবে। তাই তো দু’-একটা পাঞ্জাব ট্রাকের পেছনেও লেখা থাকতে দেখেছি, ‘দো কে বাদ ফুলস্টপ, বিবি রাখো টিপ-টপ্’। জানি না একালের নারীবাদীরা কথাটা অনুমোদন করেন কি না।
যাই হোক, দু’য়ের ট্র্যাজেডি কমেডির আখ্যান এখানে শেষ করি। নইলে পাঠকেরা ক্লান্ত হয়ে ‘দুয়ো’ দিতে শুরু করবে। জানি না, ‘দুয়ো’ কথাটা এক-এর কাছে হেরে যাওয়া দুইয়ের স্মৃতি বহন করছে কি না।
………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved