ক্রিকেট বিধাতার আপন খেয়ালে আফগান স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটেছে ‘ম্যাক্সওয়েল’ নামক এক ‘আহত’ বাঘের ক্রিকেট নৈপুণ্যে। দিনশেষে হারের অন্ধকূপে স্থবির হয়ে থাকা ওই বিজিত আফগানদের ট্র্যাজিক চরিত্র মনে হতেই পারে। ইতিহাসও হয়তো কালের অমোঘ নিয়মে বিজয়ীকে মনে রাখবে, মুছে দেবে রশিদ খান, ইব্রাহিম জাদরানদের অধরা স্বপ্ন-প্রয়াসকে। কিন্তু সেই উপেক্ষার অধিক কি আর কিছুই প্রাপ্য নয় আফগানিস্তানের? অবশ্যই প্রাপ্য।
সে যেন এক ঐশ্বরিক উদ্ভাস। মঙ্গলবার ওয়াংখেড়েতে যার অবয়ব সংস্থান ঘটেছে এক অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট-যোদ্ধার বেশে। সেই ক্রিকেট-ক্ষত্রিয় আর কেউ নন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
মায়ানগরীর ক্রিকেট রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে ২০১ রানের যে অপরাজিত ও অনবদ্য ইনিংস খেলে গেলেন অজি অলরাউন্ডার, তা ইতিমধ্যে ক্রিকেটের রত্নবেদিতে শ্রেষ্ঠত্বের রাজমুকুট মাথায় সমাসীন। ‘ম্যাড ম্যাক্স’-এর মহাকাব্যিক ইনিংসের ভাষ্যরচনার পর থেকেই ক্রিকেট কুশীলবরা তাঁদের মুগ্ধতার অর্ঘ নিবেদন করে চলেছেন, সেই মহাকীর্তির পাদপদ্মে। প্রশ্নাতীতভাবে বিশ্বকাপের মঞ্চে অস্ট্রেলিয়ার মর্যাদা ও জয়ের বৈতরণি পার করতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় দ্বিশতরান। ওয়ান ডে ক্রিকেটের মরা গাঙে বান ডাকার জন্য এমন কিছু ব্যক্তিগত পারঙ্গমতার আশু প্রয়োজন ছিল, যার আবেশ ও চর্চা হবে কালোত্তীর্ণ। বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা ভেদ করে মহাবিস্ময়ের সেই উচ্চতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন ম্যাক্সওয়েল। আর পেরেছেন বলেই তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের বরমাল্যে বরণ করে নিয়েছে ক্রিকেটবিশ্ব।
আরও পড়ুন: ম্যাথিউজকে মাঠে ফিরিয়ে আনলে বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম ক্রীড়াদূত হিসেবে উত্তরণ ঘটত শাকিবের
রুপোলি পর্দার চিত্রনাট্যকে হার মানানো ম্যাক্সওয়েলের এই রূপকথাধর্মী ব্যাটিংকে ঘিরে সাফল্যের যে হীরকদ্যুতি, তার বাইরে আরও একটা জগৎ আছে। যে দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে আছেন ওঁরা।
ওঁরা মানে ওয়াংখেড়ের ওই ১১ জন আফগান। ২২ গজে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারানোর স্বপ্ন তপ্ত মরুভূমিতে মরীচিকার মতো যাঁদের সামনে প্রতিভাত হয়েছিল। তারপর ক্রিকেট বিধাতার আপন খেয়ালে সেই স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটেছে ম্যাক্সওয়েল নামক এক ‘আহত’ বাঘের ক্রিকেট নৈপুণ্যে। দিনশেষে হারের অন্ধকূপে স্থবির হয়ে থাকা ওই বিজিত আফগানদের ট্র্যাজিক চরিত্র মনে হতেই পারে। ইতিহাসও হয়তো কালের অমোঘ নিয়মে বিজয়ীকে মনে রাখবে, মুছে দেবে রশিদ খান, ইব্রাহিম জাদরানদের অধরা স্বপ্ন-প্রয়াসকে। কিন্তু সেই উপেক্ষার অধিক কি আর কিছুই প্রাপ্য নয় আফগানিস্তানের? অবশ্যই প্রাপ্য।
আবেগ-আতিশয্য দূরে সরিয়ে নিছক পরিসংখ্যান বিচার করলে কুর্নিশের কিয়দাংশ দাবি করতে পারেন রশিদ, নবীন-উল-হকরাও। চলতি বিশ্বকাপে চারটে ম্যাচ জিতেছে আফগানিস্তান। প্রতিপক্ষ? বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড, ‘জায়ান্ট কিলার’ নেদারল্যান্ডস, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো বিশ্বজয়ী দলের বিরুদ্ধে এসেছে সেই স্মরণীয় জয়। অথচ ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে ২০১৯ এবং ২০১৫– দুই বিশ্বকাপ সংস্করণে আফগানিস্তানের জয় মাত্র একটি। সেটিও আট বছর আগে, ‘দুর্বল’ স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সেই অবস্থান থেকে আফগানিস্তানের এই উত্তরণ ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটিং-বিক্রমের চেয়ে কম অবিশ্বাস্য নয়। আর সেটার নেপথ্যে যেমন কাজ করেছে রশিদদের নিরলস পরিশ্রম, জেতার অদম্য তাগিদ। তেমনই কার্যকর হয়েছে বিশ্বকাপ ঘিরে আফগানিস্তানের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। ভারতের দীর্ঘসময় ধরে আবাসিক শিবির করা থেকে জোনাথন ট্রটের মতো দক্ষ কোচকে নিয়োগ, সর্বোপরি বিশ্বকাপে দলের মেন্টর হিসাবে অজয় জাদেজার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর প্রয়াস, সেই প্রতুৎপন্নমতিত্বের সুফল পাচ্ছে আজ আফগানিস্তান। তাও এমন একটা সময় যখন রশিদদের দেশে বিরাজ করছে তালিবানি শাসন। যেখানে সভ্যতার বিকাশ, সামাজিক প্রগতি অলীক কল্পনা মাত্র।
আরও পড়ুন: নতুন দেশ আবিষ্কারের স্বপ্নে ক্রিশ্চিয়ানোই ফুটবলের ভাস্কো দা গামা
অবক্ষয়ের সেই সীমানায় দাঁড়িয়ে সাফল্যের তৃষ্ণায় হাসমাতুল্লা, মহম্মদ নবিদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াসকে একবার কুর্নিশ জানাবেন না? না-ই বা হল তাঁদের অস্ট্রেলিয়া-বিজয়। ইতিহাসের মলীন ভূজপত্রে নাই বা খোদাই হল আফগান-রূপকথা। এদেশের বুকে কোনও এক ‘মন্নত’বাসী তো আমাদের শিখিয়েছেন, ‘হার কর জিতনে ওয়ালে কো বাজিগর ক্যায়তে হ্যায়।’ রশিদরা না হয় ‘বাজিগর’ হয়েই বাঁচুন!
প্রচ্ছদ ছবি: সোমোশ্রী দাস