কলকাতার মোহনবাগান-মহামেডান স্পোর্টিং কিংবা ইস্টবেঙ্গলের মতো কোনও আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি সংশ্লিষ্ট শহরের কোনও সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের গর্ভ থেকে গড়ে ওঠেনি, যার মাধ্যমে তাদের একটা দীর্ঘকালীন সমর্থন ভিত্তি তৈরি হবে। ক্রিকেটের নান্দনিকতা থেকে সমাজ, সর্বত্রই এর প্রভাব নেতিবাচক। ইতিমধ্যেই বেটিং, ম্যাচ ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিং, বেআইনি টাকার লেনদেন-সহ একাধিক অভিযোগ জড়িয়ে গিয়েছে আইপিএলের সঙ্গে। এর কিছু প্রমাণিত হয়েছে, কিছু এখনও ধোঁয়াশা! অভিযুক্ত কেউ কেউ শাস্তিও পেয়েছে। তবে রাঘব-বোয়ালরা এখনও অধরাই। বিসিসিআই-এর বড় কর্তারা এসব নিয়ে বিশেষ ভাবিত হবেন না; ক্রিকেট ও বলিউডের সংমিশ্রণে তারা এমন এক ‘ব্যবসায়িক লাভযন্ত্র’ চালিয়ে যাচ্ছেন, যা বিনোদন দুনিয়ায় সর্বোচ্চ বিক্রীত পণ্যের মধ্যে অন্যতম।
‘স্বপ্ন’-এর জয়ের উৎসবে ততক্ষণে নেমে এসেছে দুঃস্বপ্নের স্তব্ধতা; হাজার ওয়াটের আলো স্তিমিত হয়ে সারা বেঙ্গালুরু মহানগরীকে যেন গ্রাস করেছে আতঙ্কের নিকষ কালো ছায়া। উদ্ভ্রান্তের মতো নিজের ১৪ বছরের আহত মেয়েকে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ছুটতে দেখা গেল এক মধ্যবয়স্ক মহিলাকে! ২০ নম্বর গেটের বাইরে প্রবল ধাক্কাধাক্কির চাপে পড়ে গিয়েছিল ইশকুলছাত্রী দিব্যাংশী শিবকুমার। ভিড়ের জন্য তখন গেটের ধারেকাছে আসতে পারছে না কোনও অ্যাম্বুলেন্স। চিন্নাস্বামীর তিনদিকের সরু রাস্তাগুলোয় তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে অসংখ্য ছেড়া জার্সির টুকরো, হুড়োহুড়িতে খুলে পড়া অজস্র চটি আর জুতোর পাটি। কোথাও বা যন্ত্রণাকাতর কোনও যুবককে পাঁজাকোলা করে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কোনও নিরাপত্তারক্ষী বা তার কোনও সহকর্মী। কোনওক্রমে মেয়েকে একটি অটোতে তুলে ওই মহিলা বাওরিং হাসপাতালে পৌঁছলেন ঠিকই। কিন্তু প্রাণহীন দেহ সাড়া দিল না আর! ডাক্তাররা জানিয়ে দিলেন, দিব্যাংশীর পদপিষ্ট হয়ে মৃত্য হয়েছে, আরও ১০ জন দর্শকের মতোই। দিব্যাংশী ছাড়াও যাদের মধ্যে রয়েছে আরও দু’জন টিনএজার। আহতের সংখ্যা ৩৩। বাইরে যখন মৃত্যুমিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে, তখনও কিন্তু স্টেডিয়ামের মঞ্চে বিরামহীনভাবে চলছে উৎসব! বাইরের হাহাকারের মধ্যেও গ্যালারি থেকে ভেসে আসছে হর্ষধ্বনি, তারকাদের নামে জয়জয়কার– এমনই আইপিএলের ‘মহিমা’! বিসিসিআই-এর ‘টপ বস’-রা কি একবার পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন?
এই ঘটনার কথা জেনে বহু কলকাতাবাসীর স্মৃতিতে প্রথমেই ভেসে উঠবে ১৯৮০-র ১৬ আগস্ট ইডেন গার্ডেনের সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যেদিন কলকাতা লিগের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে দিলীপ পালিত-বিদেশ বসুর মধ্যে লাথালাথির পর গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়া গন্ডগোলের জেরে পদপিষ্ট হয়ে বলি হতে হয় ১৬ জন তরতাজা যুবককে। কিন্তু একটু তলিয়ে ভেবে দেখুন, ইডেনের ওই ঘটনার সঙ্গে চিন্নাস্বামীর ঘটনার মিলের থেকে অমিলই বেশি। বরং গত ১০ দিনের মধ্যে লিভারপুলের এফএ কাপ জয়ের উৎসব, বা প্যারিস সাঁ জাঁ-র চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের উদযাপন চলাকালীন দুর্ঘটনার মিল অনেক বেশি।
গত সপ্তাহে লিভারপুল সমর্থকরা যখন বিজয়-উৎসবে মেতেছিলেন, তখন এক ৫৩ বছর বয়সি ব্যক্তি তাদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেন, যার ফলে ১০৯ জন আহত হন। এরপর, ১ জুন, পিএসজি-র বিজয়মিছিলের সময় সমর্থকদের মধ্যে ঝামেলায় দু’জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ১৯০ জন।
ক্রীড়াঙ্গনে দর্শকরা দু’ধরনের বিপর্যয়ের শিকার হতে পারেন, যেমন মাঠের ভেতরের কোনও সিদ্ধান্ত বা অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে দু’দলের সমর্থকদের মধ্যে হিংসা ছড়িয়ে পড়া, এবং সেই দাঙ্গার জেরে পদপিষ্ট হয়ে গণমৃত্যু। ইডেনের ঘটনাটা এই প্রথম প্রকারের। আর একরকম হল, কোনও দলের বা দেশের কোনও বহু কাঙ্ক্ষিত জয়ের উদযাপনে বাঁধনছাড়া জন জমায়েত, ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কোনও দুর্ঘটনা বা পদপিষ্ট হয়ে একাধিক মানুষের মৃত্যু। ৪ জুন বেঙ্গালুরুর বুকে যে ভয়াবহ রাত্রি নেমে এল, তা এই দ্বিতীয় প্রকারের বিপর্যয়।
ইতিহাস ঘাঁটলে, এই দু’-ধরনের বিপর্যয়েরই বহু উদাহরণ মিলবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে ইতিহাসের উদাহরণগুলো থেকে এও জানা যায়, দু’দলের সমর্থকদের মধ্যে দাঙ্গা জাতীয় ঘটনায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি হয়, নিয়ন্ত্রণহীন উৎসব যাপনের সময়ের দুর্ঘটনার থেকে। এই দ্বিতীয় প্রকার বিপর্যয়ের সবথেকে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৩-এ আলজেরিয়ার রাজধানী আলজেয়ার্সে। বাছাই পর্বের ম্যাচে বুরকিনা ফাসোকে হারিয়ে বিশ্বকাপের মূলপর্বে যোগ্যতা অর্জনের পর স্বতঃস্ফূর্ত উৎসবের জোয়ারে ভাসতে শুরু করে গোটা শহর। রাস্তায় দেদার বাজি ফাটতে থাকে ও যানজট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার দরুন প্রবল বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, যার জন্য পদপিষ্ট হয়ে মারা যায় ১৮ জন; আহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০!
কিন্তু গত বুধবারের বেঙ্গালুরুর মর্মান্তিক দুর্ঘটনাকে দ্বিতীয় প্রকারের বিপর্যয়ের মধ্যে বেশ ওপরের দিকে রাখতে হবে। রাখতে হবে প্রাণহানি ও নিরাপত্তাজনিত অব্যবস্থার নিরিখে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেসব উৎসব-উদযাপন থেকে এ ধরনের গণ-প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কোনও পূর্ব-পরিকল্পিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন নয়, যেখানে গোয়েন্দা রিপোর্ট ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে তা আয়োজনের সরকারি অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে। দুঃখের বিষয়, চিন্নাস্বামীর ক্ষেত্রে সেসব হওয়া সত্ত্বেও ঝরে গেল এতগুলো তাজা প্রাণ! তাই রয়ে যাচ্ছে অসংখ্য প্রশ্ন।
আইপিএলের ১৮তম সংস্করণে এসে প্রথমবার কপালে শিকে ছেঁড়ার মতো চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা উঠল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর (আরসিবি-র) মাথায়। শুধু শহর বেঙ্গালুরু নয়, বিরাট কোহলি-রজত পাতিদারদের প্রবলভাবে সমর্থন ছিল সমগ্র কর্নাটকের ৩১টি জেলার ক্রিকেট অনুরাগীদের। মঙ্গলবার আহমেদাবাদে পাঞ্জাব কিংসকে হারিয়ে আরসিবি ট্রফি জিততেই যেন আবেগের স্রোত বাঁধ ভেঙেছিল ক্রিকেট-পাগল কর্নাটকবাসীর। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে টিমের প্রবল জনপ্রিয়তার লাভাস্রোত দেখে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে আরসিবি ম্যানেজমেন্ট, এমনকী কর্নাটক রাজ্য ক্রিকেট সংস্থা (কেএসসিএ) থেকে রাজ্য সরকারেরও কেষ্টবিষ্টুরাও। তাই পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগ এই বিজয় উদযাপন পিছিয়ে রোববার করার অনুরোধ করলেও, তড়িঘড়ি তা পরের দিনই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে উপরোক্ত তিনপক্ষের আধিকারিকরাই, সরকারি অনুরোধের তোয়াক্কা না করেই। ম্যানেজমেন্টের যুক্তি ছিল, রবিবার বিজয়-উৎসব করলে তার জৌলুস অনেকটাই কমে যাবে, কারণ বিদেশি ক্রিকেটাররা তার আগেই দেশে ফিরে যাবেন!
প্রথমে তিন পর্যায়ের বিজয় উদযাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিধান সৌধে ক্রিকেটারদের নিয়ে গিয়ে উদযাপন, তারপর শোভাযাত্রা, সবশেষে চিন্নাস্বামীর মঞ্চে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা, যার দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘ডিএনএ প্রাইভেট এন্টারটেনমেন্ট লিমিটেড’ নামক এক ইভেন্ট-ম্যানেজমেন্ট সংস্থাকে। কিন্তু অনুষ্ঠানের কয়েক ঘণ্টা আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার বাসভবনে এক উচ্চ-পর্যায়ের মিটিংয়ে শোভাযাত্রা নিয়ে আপত্তি জানান পুলিশ কমিশনার বি. দয়ানন্দ। দু’-পর্যায়ে এত বড় অনুষ্ঠান করা নিয়েও পুলিশ আত্মবিশ্বাসী নয়, জানানো হয়। কিন্তু নানা সূত্র অনুযায়ী, মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব ও রাজ্য বিধান পরিষদের সদস্যকে গোবিন্দরাজ চাপ সৃষ্টি করে দু’-পর্বের বিজয় উৎসবে অনুমোদন করিয়ে নেন। সেখানেই হয়তো তৈরি হয়ে যায় এক ঐতিহাসিক ক্রীড়া-বিপর্যয়ের ব্লু-প্রিন্ট!
গোবিন্দরাজকে শুক্রবারই রাজনৈতিক সচিব পদ থেকে সরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া, যদিও সরকারিভাবে তার অপসারণের কারণ হিসেবে কিছু জানানো হয়নি রাজ্যের তরফ থেকে। অবাক করার বিষয়, তার আগে পুলিশ কমিশনার দয়ানন্দ-সহ পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে সাসপেন্ড করা হয়!
………………………………
গত ১৮ বছরে যিনি আরসিবি-র জার্সি ছাড়েননি, হয়ে উঠেছিলেন সমর্থকদের প্রাণভ্রোমরা! এখন সেই বিরাটও গোটা রাজ্যে জনরোষের মুখে। তাঁর বিরুদ্ধে উঠছে ‘অমানবিকতার’ অভিযোগ। ইতিমধ্যেই কোহলির বিরুদ্ধে কাবুর্ন রোড থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন এক সমাজকর্মী। ওই সমাজকর্মীর অভিযোগ, বিরাটের জন্যই এত জনসমাগম হয়, যা থেকে পদপিষ্ট হয়ে ১১ জনের মৃত্যু; পদপিষ্ট হওয়ার খবর চাউর হওয়ার পরও উৎসব চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগও তোলা হয়েছে। যদিও পুলিশ কোনও এফআইআর দায়ের করেনি।
………………………………
উন্মাদনার পারদ চড়াতে কেন করা হয়েছিল উসকানিমূলক কিছু ঘোষণা? বিপর্যয়ের পর তদন্তর সঙ্গেই যখন চলছে ‘উইচ-হান্ট’ বা ‘অপরাধী কৌন’-এর পালা, ভারপ্রাপ্ত একে-অপরের দিকে বল ঠেলাঠেলির অধ্যায়, তখন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এইসব প্রশ্ন। ইতিমধ্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেছে কর্নাটক হাইকোর্ট; রাজ্য মন্ত্রিসভা বৈঠক করে এক সদস্যের বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জন মাইকেল কুনহাকে দায়িত্ব দিয়েছে। পুলিশের আপত্তি সত্ত্বেও আরসিবি-র তরফ থেকে সমাজমাধ্যমে আগাম ঘোষণা করে দেওয়া হয় ক্রিকেটারদের শোভাযাত্রার কথা, সঙ্গে বলা হয় তারকাখচিত উদযাপনে স্টেডিয়ামে প্রবেশের জন্য বিনামূল্যের পাসও বিলি করা হবে, ৩০ হাজার টিকিট বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও। যার ফলে ৩৩ হাজারের স্টেডিয়ামের আশপাশে ২.৫ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়ে যায়! অথচ স্টেডিয়ামের কয়েকটি গেটে দেখা যায় মাত্র তিনজন করে পুলিশ, কিছু নিরাপত্তারক্ষীকে নিয়ে দায়িত্ব সামলাচ্ছে।
সমাজমাধ্যমে পোস্টের জন্য আরসিবি বিপণন বিভাগের প্রধান নিখিল সোসালেকে শুক্রবার ভোরে কেম্পেগৌডা বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে বেঙ্গালুরু পুলিশ। তার সঙ্গে ডিএনএ-র আরও তিন কর্তা, আইপিএল সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট সুনীল ম্যাথু, সিনিয়র ইভেন্ট-ম্যানেজার কিরণ কুমার ও টিকিট বিষয়ক কর্তা সুমন্তকেও গ্রেফতার করা হয়। এরা সবাই শহর ছেড়ে গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। অভিযুক্তরা আদালতে জামিনের আবেদন করলেও কর্নাটক উচ্চ আদালত তা নাকচ করে দেয়। এছাড়াও সভাপতি রঘুরাম ভাট-সহ কেএসসিএ কর্তাদের বিরুদ্ধেও এফআইআর দায়ের করা হয়, কিন্তু উচ্চ-আদালত থেকে তারা আগাম রক্ষাকবচ আদায় করে নেন এই যুক্তি দিয়ে যে, অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার ছিল না। যদিও সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বিধান সৌধে ডিএনএ-র অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য অনুমতি চেয়ে রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়েছিল রাজ্য ক্রিকেট সংস্থাই। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করলেও, দায় এড়াতে পারে না সরকার পক্ষও; অভিযোগের তীর উপমুখ্যমন্ত্রী শিবকুমারের দিকেও। সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিও-তে দেখা যায়, সংবর্ধনা মঞ্চে উঠে পড়ায় এক সমর্থককে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছেন শিবকুমার।
এবং বিরাট কোহলি।
গত ১৮ বছরে যিনি আরসিবি-র জার্সি ছাড়েননি, হয়ে উঠেছিলেন সমর্থকদের প্রাণভ্রোমরা! এখন সেই বিরাটও গোটা রাজ্যে জনরোষের মুখে। তাঁর বিরুদ্ধে উঠছে ‘অমানবিকতার’ অভিযোগ। ইতিমধ্যেই কোহলির বিরুদ্ধে কাবুর্ন রোড থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন এক সমাজকর্মী। ওই সমাজকর্মীর অভিযোগ, বিরাটের জন্যই এত জনসমাগম হয়, যা থেকে পদপিষ্ট হয়ে ১১ জনের মৃত্যু; পদপিষ্ট হওয়ার খবর চাউর হওয়ার পরও উৎসব চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগও তোলা হয়েছে। যদিও পুলিশ কোনও এফআইআর দায়ের করেনি। সমাজমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ-সহ ‘অ্যারেস্ট বিরাট’ প্রচারের ঝড় ওঠে শুক্রবার থেকে। সমর্থকদের আবেগে আরও ধাক্কা খায়, বিরাট তড়িঘড়ি লন্ডন চলে যাওয়ায়।
প্রথমে উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে ভেসে যাওয়া, পরে শোকে মুহ্যমান– রাজ্য এখনও আবেগ ছেড়ে যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখার পর্যায়ে আসেনি, না-হলে বুঝতে পারত কোনও নিহতের বাড়ি না গিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য নৈতিকভাবে তাদের একনম্বর তারকা অভিযুক্ত হতে পারেন, কিন্তু অনুষ্ঠান আয়োজন বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার দায় কোনও ক্রিকেটারের ওপর আইনিভাবে বর্তায় না।
গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, ভগবত চন্দ্রশেখর, রাহুল দ্রাবিড়, অনিল কুম্বলে, জাভাগল শ্রীনাথদের রাজ্য এ পর্যন্ত আটবার রঞ্জি ট্রফি জিতেছে। মুম্বইয়ের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চবার। ঘরের ছেলেদের নিয়ে বড় ফরম্যাটের এই সাফল্য ক্রিকেটীয় গুণমানে অনেক উচ্চস্তরের। রঞ্জি ও অন্যান্য ঘরোয়া টুর্নামেন্টের মাধ্যমে কর্নাটক দেশকে উপহার দিয়েছে একের পর এক সুপারস্টার। কিন্তু সেই রঞ্জি জয়ের আবেগ-আনন্দ-উদযাপন ছিল রাজ্যের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে সীমিত। রাজ্যের আমজনতার মধ্যে তো কখনও এমন উন্মাদনা দেখা যায়নি? ভারত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও এহেন উন্মাদনার কোনও চিহ্নই দেখা যায়নি!
এখানেই প্রশ্ন, আইপিএল নিয়ে এই চরম উন্মাদনা কি স্বাভাবিক ক্রিকেট-প্রেম থেকে উদ্ভুত, না কি তা স্রেফ গ্ল্যামার-জগৎ আর অতিরিক্ত হাইপের যৌথতায় নির্মিত এক কৃত্রিম উত্তেজনা, যা বুদবুদের মতো সৃষ্টি হয়ে এক সাময়িক গণ-হিস্টিরিয়া তৈরি করে? কলকাতার মোহনবাগান-মহামেডান স্পোর্টিং কিংবা ইস্টবেঙ্গলের মতো কোনও আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি সংশ্লিষ্ট শহরের কোনও সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের গর্ভ থেকে গড়ে ওঠেনি, যার মাধ্যমে তাদের একটা দীর্ঘকালীন সমর্থন ভিত্তি তৈরি হবে। ক্রিকেটের নান্দনিকতা থেকে সমাজ, সর্বত্রই এর প্রভাব নেতিবাচক। ইতিমধ্যেই বেটিং, ম্যাচ ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিং, বেআইনি টাকার লেনদেন-সহ একাধিক অভিযোগ জড়িয়ে গিয়েছে আইপিএলের সঙ্গে। এর কিছু প্রমাণিত হয়েছে, কিছু এখনও ধোঁয়াশা! অভিযুক্ত কেউ কেউ শাস্তিও পেয়েছে। তবে রাঘব-বোয়ালরা এখনও অধরাই।
বিসিসিআই-এর বড়কর্তারা এসব নিয়ে বিশেষ ভাবিত হবেন না; ক্রিকেট ও বলিউডের সংমিশ্রণে তারা এমন এক ‘ব্যবসায়িক লাভযন্ত্র’ চালিয়ে যাচ্ছেন, যা বিনোদন দুনিয়ায় সর্বোচ্চ বিক্রীত পণ্যের মধ্যে অন্যতম। তাই চিন্নাস্বামীর এই মর্মান্তিক পরিণতির পর, আমজনতার ভেবে দেখার সময় এসেছে যে, মানুষকে এই কৃত্রিম উন্মাদনার জোয়ারে ভাসিয়ে আইপিএল কি ভবিষ্যতে আরও বেশি ‘বলি’ চায়?
……………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………..