Robbar

সঙ্গে থাকো, সঙ্গে থাকো, সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থাকো

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 18, 2025 7:48 pm
  • Updated:March 18, 2025 7:48 pm  

বন্ধুত্ব– আমাদের মৃতসঞ্জীবনী। বন্ধুত্ব– বিকেলবেলার ছোট্ট গলির ভেতর থেকে ভেসে আসা গান,  বিপ্লবের নতুন স্লোগান, ছেড়ে দেওয়া ট্রেনের দূরপাল্লার হাতল। বন্ধুত্ব এমন এক স্বপ্ন, যা একখানা মেরি বিস্কুটকে ভাগ করে ফেলতে পারে ৬ টুকরোয়। বন্ধুত্ব– বিকেলবেলায় নিজেকে লাটাইছেঁড়া ঘুড়ির মতো সমর্পণ করা। সবই কি সুখস্মৃতি? তা নয়। নইলে ভাস্কর চক্রবর্তী কেনই বা লিখেছিলেন, ‘বন্ধুত্ব দিয়ে আমাদের সম্পর্ক শুরু হয়/ শেষ হয় খিস্তিখেউড়ে’? তবুও, তাঁর কবিতাতেই ছিল: ‘এই চাপাকান্নার পৃথিবীতে, তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই’। বন্ধুত্বে বিশ্বাস ফিরে এসেছে সাম্প্রতিক এক ঘটনায়। তারই কথা আপনাদের, রোববার.ইন-এর বন্ধু-পাঠকদের জানানো। 

সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

বিদঘুটে পরিস্থিতি চিরকালই ভয়ংকর। তা স্থান-কাল-পাত্রের পরোয়া করে না। ঠিক যেন টি-টোয়েন্টির সুপার ওভার। উতরে গেলে তুমি রাজা, নয়তো গজা! ত্রিকোণ প্রেম তেমনই বিদঘুটে বিলকুল, একটু এদিক-ওদিক হলেই চেকমেট! তেমনই এক পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম একবার। পাঠক, আপনাদের হিতার্থে একটা কথা আগেই বলে রাখি, রসের আভাস পেয়ে যদি ভনভনিয়ে ওঠার কথা ভেবে থাকেন, তাহলে নিরাশ হবেন! এই ত্রিকোণে, আমি নেহাতই চতুর্ভুজ, মানে পার্শ্বচরিত্র। গপ্পের সূচনা থেকে উপসংহারের নীরব দর্শক বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই।

তো যে কথা বলছিলাম। কলেজ লাইফ, একটা কোচিং, দো মালি এক ফুল। তিনজনেই আমার বন্ধু। এক বন্ধুর সঙ্গে বান্ধবীর প্রেম যখন ঘনীভূত, সেই সময় দ্বিতীয়ের প্রবেশ। ছলে-বলে-কৌশলে নয়, বরং ভালোবাসার আগুন জ্বেলেই সে হৃদয়হরণ করল। প্রথমের প্রেম শুকিয়ে গেল অচিরে। সেই মুড়িয়ে যাওয়া নটেগাছের শাখায় শাখায় জন্ম নিল অবসাদের বিষকরবী, তিলে তিলে শেষের অভিলাষে।

আমাদের চপল হৃদয় তখনও আয়ত্ত করতে শেখেনি শোক-ভোলানো তরল গরল। মুখস্থ করেনি কবির চেনা লব্জ– ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?’-র ভরসার সুর। শুধু জানতাম, বন্ধুর বিপদে-আপদে বন্ধুই সহায়। সেই সঞ্জীবনী মন্ত্র বিশল্যকরণীর কাজ হয়েছিল! ম্যাজিকের মতো।

বন্ধুত্বের এমন চেনা গল্প আমরা বহু যুগ ধরে বন্ধক রেখেছি মনের বন্ধ জানলার ওপাশে। চেনা পথ ভুলে গেলে সেখানে বিস্মৃতির ধুলো জমে। মশগুল রোয়াক ভরে ওঠে নিঃস্তব্ধ আগাছায়। স্মৃতির জীর্ণ পাতায় দমকা হাওয়া লাগলে, তা আচমকা ভেসে যায় ঝরাপালকের মতো। সেই উতলা বাতাসে কখনও মনে পড়ে যায় সত্যজিতের ‘জুটি’ গল্পের ‘বিশু-শিবু’কে, কখনও মনে আসে ‘ক্লাস ফ্রেন্ড’-এর মোহিত-জয়দেবের স্মৃতি। ভেসে ওঠে মতি নন্দীর ‘জীবন-অনন্ত। মনে পড়ে টিনটিনকে, বন্ধু ‘চ্যাং’-কে ফিরিয়ে আনার তাগিদে যে আবিষ্কার করেছিল ইয়েতির মধ্যে দয়া-মায়া, স্নেহ-মমতা ভরা এক বন্ধুত্ব।

Forrest Gump - HubPages
‘ফরেস্ট গাম্প’ সিনেমার একটি দৃশ্য

মনে পড়ে ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর কথা। যার সারল্য আর বন্ধুত্বের আগল জীবনের চেনা ছন্দে ফিরিয়ে এনেছিল যুদ্ধে দু’পা হারানো লেফ্টেন্যান্ট ড্যানকে, অবসাদের মৃত্যুকূপ থেকে। মনে কি পড়ে না ‘উইলসন’-কে, ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’র সেই পরিত্যক্ত বাস্কেটবল, নীরব উপস্থিতিতে যে হয়ে উঠেছিল নির্জন জনমানবশূন্য দ্বীপে একাকি চাক নোল্যান্ডের একমাত্র সহচর। হোক না রুপোলি পর্দা, বন্ধুত্বের সহজতায় সেও তো জীবন্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের চেনা পৃথিবীতে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর মতোই।

Tom Hanks' Cast Away Friendship With Wilson Made Us Cry
‘কাস্ট অ্যাওয়ে’ সিনেমার দৃশ্য

বাংলা কবিতায় এমন দুই বন্ধু– শক্তি-সুনীল। প্রায় প্রবাদ হয়ে যাওয়া সেই বাক্য: ‘শক্তি-সুনীল যুগলবন্দি/ পাঠক টানার নতুন ফন্দি’।

বন্ধুত্বের গভীরতা কত বিশুদ্ধ, সেই অনুভব জানতে ইচ্ছে করে মার্ভ হিউসের কাছে।

রোদ ঝলমলে এমনই একদিনে ‘মারিব মৎস্য, খাইব সুখে’র অভিলাষে প্রাক্তন অজি ক্রিকেটার পানসি ভাসিয়ে ছিলেন মোয়ি নদীতে। সঙ্গী হয়েছিলেন বন্ধু। মাঝ-দরিয়া যেতে হয়নি, টলমল বোট থেকে আচমকাই নদীতে পড়ে যান হিউজ! মোয়ি নদীর ‘সুখ্যাতি’ তার পেটে গিজগিজ করা কুমীরের জন্য। হিউস তা বিলক্ষণ জানতেন। জানতেন তাঁর বন্ধুও। মৃত্যুর কবলে পড়া বন্ধুকে উদ্ধার করতে জলে ঝাঁপ দিতে দ্বিধা করেনি হিউসের সেই চিরসখা। নিজের প্রাণ বিপন্ন করেই উদ্ধার করেছিলেন হিউসকে।

Sir Ian Botham RESCUED By Merv Hughes After Falling Into Crocodile-Infested  Waters, England Cricket Legend Suffers Bruises
মার্ভ হিউসের (বাঁ-দিকে প্রথম) সঙ্গে ইয়ান বোথাম

সেই বন্ধুর নাম ইয়ান বোথাম! অ্যাসেজের যুদ্ধকে ম্লান করে ফিনিক্স হয়ে বেঁচে থাক এমন বন্ধুত্ব।

বেঁচে থাক সবুজ ঘাসে ডেলে আলি-কাইল ওয়াকারের ‘দোস্তি-কি-দস্তান’। কয়েক দিন আগে সিরি আ-তে এসি মিলানের বিরুদ্ধে কোমোর হয়ে মাঠে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল ডেলে আলির, প্রায় দু’বছর পর। কিন্তু বিধি বাম! মাঠে নামার ১০ মিনিটের মধ্যে জঘন্য ফাউল করে লাল কার্ড দেখেন ইংল্যান্ডের তারকা ফুটবলার। বিপক্ষ টিমে ছিলেন কাইল ওয়াকার। আলির সঙ্গে দীর্ঘদিন টটেনহ্যামে খেলেছেন এই ইংরেজ সাইডব্যাক। দু’জনেই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। আলির বিগত দু’বছরের লড়াই তাঁর জানা। ঘন ঘন স্লিপিং পিল, মানসিক অবসাদ ফুটবল থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল ডেলে আলিকে। হয়তো হেরে যাওয়া মন নিয়ে অবসরের পৃথিবীতে তাঁর ঠাঁই হত। হয়নি, আলির ফেরার জেদের নাছোড় মনোভাবে। যবনিকা টানার আগে শেষ চেষ্টা করেছেন। ফুটবলের টানে ফিরেছেন মাঠে।

Dele Alli sent off 10 minutes into Serie A debut – despite Kyle Walker's  protests - Yahoo Sports
এসি মিলান-কোমো ম্যাচে দুই বন্ধু: কাইল ওয়াকার ও ডেলে আলি

সেই প্রত্যাবর্তন শেষমেশ অভিশপ্ত হোক, চাননি ওয়াকার। পেশাদারিত্বের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চেপে ধরেছিলেন রেফারির হাতে। জুড়ে ছিলেন তর্ক। যাতে রেফারি লাল কার্ড না দেখান বন্ধু আলিকে। শেষরক্ষা হয়নি। আলিকে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু জিতে গিয়েছিল বন্ধুত্ব। জয়-পরাজয়ের চেনা সমীকরণ, ছকবাঁধা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে হারিয়ে।

বন্ধুত্ব আসলে এমনই, চেনাছকের অঙ্ক ভেঙে আশ্চর্যের ইমারত গড়ে। সেখানে বিস্ময়ের বুদ্বুদ জন্মায়। মিলিয়েও যায়। আবার জন্মায়। আর আত্মকেন্দ্রিক পৃথিবীর উল্টোমেরুতে দাঁড়িয়ে সমষ্টির জয়গান করে, নিঃস্বার্থের সুর তুলে।

Don't p*ss me off!' - Dele Alli shares hilarious text exchange with Ruben  Loftus-Cheek after picking up red card for foul on AC Milan midfielder  during Como debut | Goal.com
বন্ধু যখন প্রতিদ্বন্দ্বী: ম্যাচে ডেলে আলির সঙ্গে কাইল ওয়াকার

আমাদের স্মৃতিকথায় এইসব বন্ধুত্বের ছোট ছোট ঘুপচি ঘর। মনের সুতোয় টান না পড়লে তার দরজা খোলে না। খুললে দেখা যাবে সেই ধুলোমাখা ঘরে বিছিয়ে আছে কত শিশিরভেজা ঘাস, ভাঙা ব্যাট, আমসি-আচার, কাদামাখা ফুটবল, লড়ঝড়ে সাইকেল। আর উপসংহারহীন কিছু অসমাপ্ত গল্প।

কাইল ওয়াকার সেই বন্ধ ঘরে আলো জ্বাললেন। পড়ন্ত বিকেলের মিঠেকড়া রোদের মতো।

…………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………..