বিদায় স্মিভ স্মিথ। আপনি চ্যাম্পিয়ন থেকে গেলেন আত্মবিশ্বাসে। লেগস্পিনার হিসেবে ক্রিকেটীয় দুনিয়ায় এসে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটারদের তালিকায় আপনার নাম থেকে গেল। একজন লেগস্পিনার থেকে অসামান্য এক ব্যাটার হয়ে ওঠাও একটা অপূর্ব লেগস্পিনর সঙ্গে তুলনীয়, যা আপনি জীবনের সঙ্গে করলেন।
স্টিভ স্মিথকে দেখলে আমাদের স্কুলের পাপাইকে মনে পড়ে খুব। ক্লাসে স্যর যখন জিজ্ঞেস করত কে কী হতে চায় পাপাই হাত তুলে বলত ক্রিকেটার! আমরা যারা বাবা-মায়ের চাপে কিংবা অনুকরণের তীব্র নেশায় কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই বলে গলা ফাটাতাম– আমাদের মতো অনেকের মনের কথা মুখে বলে দিত ও। দিনকয়েক আগে দেখা হতে জানলাম ও ইউএসএ-তে একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার উঁচু পদের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। দেশে ফেরে বছরে একবার। নাহ! ক্রিকেটার হওয়া হয়নি পাপাইয়ের; আবার ও যা হতে পেরেছে, তা ওর হতে চাওয়ার তালিকাতেই ছিল না!
মনে আছে ক্লাস নাইনের বাংলা বইতে লেখা শেক্সপিয়ারের ‘কমেডি অফ এররস’-এর সেই লাইন– ফ্লোটিং স্ট্রেইট ওবেডিয়েন্ট টু দ্যা স্ট্রিম? স্রোতের অনুকূলে ভেসে যাওয়া– তিনটে দশক আগে ঠিক এভাবে ভেসেছিলেন স্টিভ স্মিথ– অস্ট্রেলিয়ায় শেন ওয়ার্নের প্রভাব যে কতখানি, তা অজি ফার্স্টক্লাস খেলা দলগুলোর দেওয়ালে কান পাতলেই বোঝা যায়– অস্ট্রেলিয়ার বাজার তখন খুঁজছে নতুন ওয়ার্নি– স্মিথ এসেছিলেন সেই সম্ভাবনা হয়ে– আট নাম্বার ব্যাট– আর লেগস্পিনার– সোনালি চুল, খানিক কাছাকাছি বোলিং অ্যাকশান– ওয়ার্নের উত্তরসূরি হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়েও স্মিথ হয়ে গেলেন ব্র্যাডম্যানের উত্তরসূরি!
কেবল উত্তরসূরীই না, ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ টেস্ট ব্যাট হয়ে থেকে গেলেন ইতিহাসে। মজার না? আসলে স্টিভ স্মিথের ক্রিকেট কেরিয়ার একটা বিস্ময়, ব্রিলিয়ান্সের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা…স্মিথ-বিরাট-উইলিয়ামসন-রুটের যে ফ্যাব ফোর লব্জ, বাজারের চাহিদা মেনে যাকে ইচ্ছেমতো বিপননযোগ্য করে তোলা হয়েছে, এই চারজনের যে তুলনা ক্রমাগত চলে তার নিরানব্বইভাগই হয়, রান-গড়-সেঞ্চুরির সংখ্যাতত্ত্বে। কিন্তু স্মিথের কেরিয়ারের মূল তার বাঁধা অন্য একটি শব্দে- ‘ইমপ্যাক্ট’, বাংলা তর্জমায়- ‘প্রভাব’! অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের পর ভারতীয় দলের কোচ গৌতম গম্ভীর প্রেস কনফারেন্সে একটি অত্যন্ত জরুরি কথা বলে গেলেন সাংবাদিকদের। তিনি বললেন- ‘আপনি প্লেয়ারকে জাজ করেন রান,ব্যাটিং অ্যাভারেজ দিয়ে, আমি করি ইমপ্যাক্ট দিয়ে’।
স্টিভ স্মিথ টেস্ট ক্রিকেটে অতিমানবিক। সমসাময়িক বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীরা আসেন না তাঁর টেস্ট রেকর্ডের সামনে। ওয়ান ডে-তে আপাত সফল। টি-টোয়েন্টিতে সেভাবে সফল নন– এই মোটামুটি স্মিথ; বাজারের বানিয়ে দেয়া চেকবক্সে টিক করলে এই দাঁড়ায়। কিন্তু স্মিথের টি-টোয়েন্টি প্রসঙ্গে সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় এক প্রিয় বন্ধু উসকে দিয়েছেন পুনা ওয়ারিয়র্সের হয়ে আইপিএলের স্মৃতি। ভারতীয় উপমহাদেশে স্টিভ স্মিথ প্রথম বিস্ময় হয়ে ধরা দিল ওই নীল জার্সিতে– অসামান্য সব ক্যাচ নিলেন, এমন ফিল্ডিং করলেন যে, কমেন্ট্রেটররা কমেন্ট্রি পাঞ্চে বলতে বাধ্য হলেন, ‘দেয়ার ইজ স্মিথ ইন বিটুইন স্কোরবোর্ড অ্যান্ড সিক্স রান’; সঙ্গে তুমুল ব্যাটিং! ঝড়ের মতো এলেন– টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। অজি মিডিয়া গ্রেগ চ্যাপেল ঘরানায় অদ্ভুত বিশ্বাস করে, লালবলের ক্রিকেটে ব্যাটিং টেকনিকই হল আসল। অর্থোডক্স টেকনিক যে যত রপ্ত করতে পারে, সে তত সমাদর পায়। চ্যাপেল ব্রাদার্স থেকে শুরু করে পন্টিং-ওয়-হেডেন- এ তালিকায় স্মিথ আসবেনই না। অমন আন-অর্থোডক্স টেকনিক নিয়ে ফাটকা টি-টোয়েন্টি চলতে পারে কিন্তু টেস্ট? নৈব নৈব চ। এই মিথ ভেঙে দিতে স্মিথের লেগেছিল ঠিক কয়েকটা বছর। ২০১৫ সালের মধ্যে এমন টেস্ট ব্যাটিংয়ের নজির রাখলেন যে, বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার হয়ে গেলেন। পরপর চার বছর টেস্টে হাজারের ওপর রান। একটা আস্ত দশক টেস্ট ক্রিকেটের ‘বিশ্বসেরা’ হয়ে উঠলেন স্মিথ।
স্মিথের ক্রিকেটীয় প্রতিভাকে এক কথায় বলা যেতে পারে, কাঁচা সোনা। যেভাবে ইচ্ছে তিনি গড়ে পিটে নিয়েছেন, অথচ প্রত্যেকটি ভূমিকাতেই থেকে গেছে ঝলক। ওয়ান ডে ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার সময়ে স্মিথের ওয়ান ডে ইনিংসগুলো উল্টে পাল্টে দেখছিলাম, ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে ওয়াহাব রিয়াজের সামনে তিন উইকেট পড়ে যাওয়ার পর স্মিথের ইনিংসটা লক্ষ করলে দেখা যায়, কী অদ্ভুত দক্ষতায় নিজেকে ক্রিজে নিংড়ে দিচ্ছেন তিনি, শেষ অবধি অস্ট্রেলিয়াকে পৌঁছে দেবেন ভরসাযোগ্য স্থানে, সেমিফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে ফিঞ্চকে সঙ্গে নিয়ে তো সেঞ্চুরিই করে গেলেন। একের পর এক ওয়ান ডে ইনিংস স্মিথ খেলেছেন যার ইমপ্যাক্ট নিয়ে ভাবতে বসলে বিস্মিত হতে হয়!
যদি স্মিথ সত্যিই লেগস্পিনার হয়ে থেকে যেতেন? কী হত? তাঁর ক্রিকেটীয় ক্ষমতায় বিশ্বাস রেখে বলতে পারি তিনি সফল হতেন। কিংবা যদি সেদিনের পুনা ওয়ারিয়র্সের টি-টোয়েন্টি সেনসেশান হয়ে টি-টোয়েন্টিতেই রাজত্ব করতেন? এই সমস্ত সম্ভাবনার বিপ্রতীপে দাঁড়ানো স্টিভেন স্মিথ একটি সারসত্যকেই সমস্ত কেরিয়ার জুড়ে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন– নিজের প্রতিভার ওপর বিশ্বাস থাকলে পরিস্থিতি মোতাবেক যে কোনও ভূমিকাতেই শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠা যায়– পারিপার্শ্ব সেখানে কেবলই দর্শক; উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেওয়া ছাড়া যার বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই…
বাংলা ভাষা সেই পাঁচের দশকে যদি বারীন ঘোষের ‘ছিন্নমূল’, সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’-এর (যেহেতু ‘নাগরিক’-এর মুক্তি পরে) জন্ম দিয়ে থাকে, তাহলে ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ ভারতীয় নববসন্তের অস্তিত্ব জানান দিল।