মতি নন্দীর উপন্যাসে জীবন নামে চরিত্রটি, তার ক্রিকেট-স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলেছিল এক রাতের অন্ধকারে। ঋষভও হারিয়ে ফেলতে বসেছিলেন। নিশুতি রাতে নিস্তব্ধ হাইওয়ে-তে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া তার গাড়িতে বসেও জীবনের মতো তিনিও কি হাহাকার করছিলেন? সংশয় ব্যাকুল হয়ে অন্তরাত্মাকে প্রশ্ন করছিলেন– আবার খেলার মাঠে ফিরতে পারবেন তো? উপন্যাসে জীবনের স্বপ্ন থেমে গিয়েছিল এক হ্যাঁচকা টানে। ঋষভ থামতে দেননি তাঁর স্বপ্নকে। তফাত এখানেই। জীবন যা পারেনি, সেই না-পারা জগৎটাকে জয় করে নিয়েছেন পন্থ, বাস্তবে।
দুই বন্ধু। হরিহর একাত্মা। ক্রিকেটার। একজন বোলার। অপরজন ব্যাটার। দু’জনের চোখে স্বপ্ন। স্বপ্ন দেশের হয়ে টেস্ট খেলা। ক্লাব ক্রিকেটে দু’জনেই সম্ভাবনাময়।
সিএবির নকআউটের শেষ ম্যাচ। বোলার ছেলেটির ঝুলিতে প্রাপ্তি বলতে এক উইকেট। আর মিড উইকেট থেকে তার থ্রোয়ে একটা রান আউট। পিঠ চাপড়ানি জুটেছে। তবে নামমাত্র। সিংহভাগ পেয়েছে তার ব্যাটার-বন্ধু। শেষ বলে ছয় মেরে জিতিয়েছে টিমকে। সঙ্গে সেঞ্চুরি। ইডেন তার সাক্ষী। বোলার-বন্ধুর গলায় উচ্ছ্বাস– ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ুক। তার নয়, বন্ধুর। গত বছর আটটা, এ-বছর এগারোটা। উনিশটা সেঞ্চুরি। দু’বছরে। সামনের মরশুমে বাংলার হয়ে খেলার সুযোগ পাক তার সোলমেট। তারপর দেশ। দেশের হয়ে টেস্ট।
শুনশান ইডেন। নিঃস্তব্ধ ক্লাবহাউস। ক্লাবহাউসে দু’টো প্রাণী। দুই বন্ধু। সঙ্গে তাদের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের ফাঁক গলে মন ভিজিয়ে যায় কালবোশেখির ঠান্ডা বাতাস। তারপর এলোমেলো হাওয়ায় মিশে যায় বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। ক্লাবহাউসের দোতলা সিঁড়ি ভেঙে তরতরিয়ে মাঠে নেমে আসে ম্যাচ-উইনার। বোলার-বন্ধুটি তখন ক্লাবহাউসের ব্যালকনিতে, প্রত্যক্ষদর্শীর ভূমিকায়। দেখে, পুলকে আত্মহারা বন্ধু গড়াগড়ি দিচ্ছে ইডেনের সবুজ ঘাসে। সে জানে, তার বন্ধু বেপরোয়া। নিন্দুকরা বলে, বিগ ম্যাচ টেম্পারামেন্ট নেই তার বন্ধুর ব্যাটিংয়ে। নেই ব্যাটিংয়ের ব্যাকরণ-জ্ঞান। বন্ধু অবশ্য ফুৎকারে ওড়ায় সে-সব। বলে, ‘ব্যাটিংটাকে আমি সহজ-সরলভাবে বুঝি মারার বল পেলেই মারো। যেটা মারতে পারবে না সেটা ছেড়ে দাও বা আটকাও।’
ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে যায়। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যায় সন্ধে-নামা শহর। রাত গাঢ় থেকে গভীর হয়। দুই বন্ধু এখন স্কুটারে। বোলার চালকের আসনে, পিছনে ব্যাটার। তারও পিছনে এক বিরাট ট্রাক। স্কুটারের দুই আরোহীকে ভাসিয়ে দেয় হেডলাইটের আলোয়। কান-ফাটানো হর্নে কেঁপে ওঠে চালকের মন। রেগে যায় স্কুটারে সওয়ার বন্ধু। পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে স্কুটারের হ্যান্ডেলে রাখা চালকের হাতে টান দেয়। টলে যায় স্কুটার। ডান দিকে ছিটকে রাস্তায় কাত হয়ে পড়ে দ্বিচক্রযান। ঠিক ওলটানো আরশোলার মতো। পিছন থেকে ছুটে আসা ট্রাক কর্কশ আর্তনাদে ব্রেক কষে। তারপর মিলিয়ে যায় গভীর অন্ধকারে। ফুটপাতে ছিটকে পড়া স্কুটারের সেই চালক, সেই বোলার-বন্ধুটি দেখে উলটোদিক থেকে ছুটে আসছে একটা মোটরগাড়ি। সেই মোটরগাড়ির আলোয় চারপাশ স্পষ্ট হয়। দেখে, স্কুটারের একটু দূরে বন্ধু, বাঁ-হাতে ভর করে উঠে বসার চেষ্টা করছে তার বন্ধু। মোটরগাড়ির আলো আরও তীব্র হয়। বোলার দেখে, তার বন্ধুর ডান হাতের আঙুলের ডগা থেকে কবজি পর্যন্ত মাংস, হাড় থেঁতলে চটকে লাল একটা কাগজের মতো দেখাচ্ছে…।
……………………………………………..
শনিবাসরীয় চিপকে তাঁর ব্যাট থেকে লব্ধ শতরান তাই বাংলাদেশ নামক কোনও ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের বিরুদ্ধে অর্জিত সাফল্য নয়, বরং তা প্রতিকূলতা নামক এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জয়ের স্বীকৃতি। জীবন ও ক্রিকেট– দ্বৈত-যুদ্ধে সাফল্যময় এমন ব্যক্তিত্বই তো বিপক্ষকে নির্দেশ দেবেন তাঁর বিরুদ্ধে ‘ফিল্ড সেটিং’-এর চক্রব্যূহ রচনায়। যা নিয়ে চর্চা হবে ক্রিকেটমহলে, তুলনায় জুড়ে যাবে বীরেন্দ্র শেহবাগের বীরত্বব্যঞ্জক গল্পগাথা, এমনকী ডব্লু. জি. গ্রেসকে ঘিরে গড়া ওঠা কিংবদন্তি।
……………………………………………..
মতি নন্দীর ‘জীবন অনন্ত’ উপন্যাসে এভাবেই তলিয়ে গিয়েছিল আস্ত একটা সম্ভাবনা। একটা প্রতিভা। একটা স্বপ্ন। আচমকাই। উপন্যাসে জীবন সেই ভেসে যাওয়া, খানখান হওয়া মানুষ, যার আর কখনও টেস্ট খেলা হয়নি, ফেরা হয়নি সাধের ২২ গজে, ইডেনের ক্লাবহাউসের ব্যালকনিতে ভাসিয়ে রাখা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে।
২৫ বছর আগের এক উপন্যাস। পাঠক ভাবতেই পারেন, এতবছর পর হঠাৎ উপন্যাসের সেই চরিত্রকে ফিরে দেখার প্রয়োজন কি? স্মৃতি হাতড়ে মনে করার কি কোনও বিশেষ কারণ আছে? আছে বইকি! কারণ একটাই। ঋষভ পন্থ।
মতি নন্দীর উপন্যাসে জীবন তার ক্রিকেট-স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলেছিল এক রাতের অন্ধকারে। ঋষভও হারিয়ে ফেলতে বসেছিলেন। নিশুতি রাতে নিস্তব্ধ হাইওয়ে-তে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া তার গাড়িতে বসেও জীবনের মতো তিনিও কি হাহাকার করছিলেন? সংশয় ব্যাকুল হয়ে অন্তরাত্মাকে প্রশ্ন করছিলেন– আবার খেলার মাঠে ফিরতে পারবেন তো? উপন্যাসে জীবনের স্বপ্ন থেমে গিয়েছিল এক হ্যাঁচকা টানে। ঋষভ থামতে দেননি তাঁর স্বপ্নকে। তফাত এখানেই। জীবন যা পারেনি, সেই না-পারা জগৎটাকে জয় করে নিয়েছেন পন্থ, বাস্তবে।
উপন্যাসের জীবনের মতোই ঋষভ অকুতোভয়, দস্যি-দামাল। বেপরোয়া বলেই চাপের মুখে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে নিজেকে মেলে ধরার প্রয়াস তাঁর সহজাত। চেন্নাইয়ে প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও যখন টপঅর্ডার ভাঙনে দিশেহারা ভারতীয় ব্যাটিং, তখন শুভমান গিলকে সঙ্গী করে দলকে দিশা দেখিয়েছেন পন্থ। শনিবাসরীয় চিপকে তাঁর ব্যাট থেকে লব্ধ শতরান তাই বাংলাদেশ নামক কোনও ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের বিরুদ্ধে অর্জিত সাফল্য নয়, বরং তা প্রতিকূলতা নামক এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জয়ের স্বীকৃতি। জীবন ও ক্রিকেট– দ্বৈত-যুদ্ধে সাফল্যময় এমন ব্যক্তিত্বই তো বিপক্ষকে নির্দেশ দেবেন তাঁর বিরুদ্ধে ‘ফিল্ড সেটিং’-এর চক্রব্যূহ রচনায়। যা নিয়ে চর্চা হবে ক্রিকেটমহলে, তুলনায় জুড়ে যাবে বীরেন্দ্র শেহবাগের বীরত্বব্যঞ্জক গল্পগাথা, এমনকী ডব্লু. জি. গ্রেসকে ঘিরে গড়া ওঠা কিংবদন্তি। এসবের ফাঁকেই টেস্ট শতরানের পরিসংখ্যানে জায়গা করে নেবেন ভারতীয় ক্রিকেটের অদ্বিতীয় ‘ফিনিশার’ এমএস ধোনির বেদীমঞ্চে, সসম্মানে। এসব পন্থের পক্ষেই সম্ভব।
নিঃসন্দেহে ৬৩২ দিন পর ভারতের হয়ে টেস্ট ফরম্যাটে নামা ঋষভ নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। ‘কামব্যাক’-এর স্বপ্ন দেখা প্লেয়ারমাত্রই চাইবেন তাঁর প্রত্যাবর্তনের মঞ্চকে পারফরম্যান্সের আলোয় ঝলমল করে তুলতে। তবু পন্থ ব্যতিক্রম। কেন? কারণ, তাঁর প্রত্যাবর্তনের পথ কামব্যাকের চেনা সমীকরণ মেনে কখনও এগোয়নি। সেই পরিক্রমা সহজ ছিল না মোটেই। ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর। গভীর রাতে বীভৎস গাড়ি-দুর্ঘটনা ওলট-পালট করে দিয়েছিল দিল্লির বাঁ-হাতির জীবন। ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত যে ঋষভকে সেদিন দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, সেই পরিস্থিতিতে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটাই ছিল আসল চ্যালেঞ্জ, ক্রিকেট সেখানে গৌণ। সেই ক্ষত সামলে ঋষভ সব চ্যালেঞ্জ জিতেছেন। সঙ্গে জিতেছেন ক্রিকেটকে। দীর্ঘ শুশ্রুষা-পর্ব পেরিয়ে মোক্ষলাভ হয়েছে পন্থের।
…………………………………………….
পড়ুন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়-এর লেখা: ক্রিকেট নেই, ‘জঙ্গ’ আছে
…………………………………………….
ঘরের মাঠে ওডিআই বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি ঋষভ। গ্যালারির কোণে রোদচশমার আড়ালে লুকিয়ে রাখা বিবর্ণ তাঁর মুখ সহ্য করেছে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ হারের ত্রাহ্যস্পর্শ, সেই হেরে-যাওয়া পন্থ ক্যাবিবিয়ান উপকূলে অর্জন করেছেন দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের তাজ। কিন্তু টেস্ট অন্য মঞ্চ, অন্য লড়াই। ক্রিকেটের সর্বোত্তম রণভূমি কঠিন পরীক্ষা কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেয় ক্রিকেট-যোদ্ধার শস্ত্র-বোধকে। চিপক সাক্ষী, সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ দিল্লির বাঁ-হাতি।
দুর্ঘটনার অভিঘাত সামলে প্রত্যাবর্তনে পন্থ প্রমাণ করেছেন বাইশ গজ আসলে ছোট্ট দুনিয়া। ব্যাট ও বলের নিয়ত সংগ্রাম দিয়ে শুধু ক্রিকেটের ব্যাখ্যা চলে না। ক্রিকেট সেই নির্দিষ্ট সীমানা-ঘেরা চৌহদ্দিকে ছাপিয়ে যায়, সেই বৃহত্তর পরিসরে মিশে যায় জীবনের স্রোতধারা। ব্যাট-বলের যুদ্ধ ছাপিয়ে তখন মান্যতা পায় ক্রিকেট-যোদ্ধার জীবন সংগ্রাম, প্রতিকূলতার পাহাড় ভেঙে লক্ষ্যে পৌঁছনোর সংকল্প।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………