বহিরাবরণটুকুই চোখে দেখা যায়। তখন স্টাইলখানা ঝলকায়। কিন্তু তার অন্তরে যে ঘাম-রক্তের ইতিহাস আছে, একাগ্র হওয়ার একটেরে সাধনা আছে, তাও বুঝতে হবে। তা অবশ্যই চোখে দেখা যায় না। যাকে ক্যাজুয়াল বলছি, তার মধ্যে অনেকখানি আত্মবিশ্বাস ঢুকে বসে আছে। সেই বিশ্বাস উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় না। অর্জন করে নিতে হয়। একজন খেলোয়াড়, যিনি দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁর রেলা থাকতেই পারে, কিন্তু রেলাচর্চার পাশে, সেই আত্মবিশ্বাস অর্জনের পথটুকুর কথাও স্মরণ করা হোক।
তিনি ক্যাজুয়াল। যেন সন্ধেবেলায় গুল দিচ্ছেন। ঘনাদা অবতার।
–তোরা জানিস, একবার গিয়েছিলাম প্যারিস অলিম্পিক্সে! বলেই সিগারেটের ধোঁয়া ফস করে মেসের ঘরে ছেড়ে দিলেন।
–বলো কী, অলিম্পিক্সে! তাও প্যারিসে!
–হ্যাঁ হ্যাঁ! তোরা আর জানবি কী, সেদিনের ছোকরা।
–তাপ্পর?
–আরে কিছু না, বাঁ-হাত পকেটে দিয়ে বন্দুকবাজি। এয়ার পিস্তল। দশ মিটার। তেমন কোনও প্রোটেকশন নেই। সটান পদকজয়!
স্বাভাবিক যে ক্যাবলা, হাবুল, প্যালারা তেমন বিশ্বাস-টিশ্বাস করবে না একথায়। কিন্তু এ যে ঘটল, তা তো একেবারে ছবি-ভিডিও-সহ সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। টেনিদা আছে প্রমাণিত, টেনিদার অবতারও আছে– প্রমাণিত, একমাত্র ইয়েতি আছে কি না, এখনও জানি না। কেউ বললেন, এ যেন হিমশীতল মস্তিষ্কের কোনও সিরিয়াল কিলার। প্রত্যুত্তরে কেউ বললেন, মুখে-চোখে মোটে ভায়োলেন্স নেই মশাই! বরং বিকেলবেলা হাঁটতে বেরিয়ে, ঘুম ঘুম দুপুরের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মনে হয়েছে, যাই, দুটো গুলি ছুড়ে আসি। সক্কলের অনুসন্ধিৎসু মন কেন্দ্রীভূত হয়েছে সেই মানুষে, সেই ঘনাদারূপীতে যাঁর নাম– ইউসুফ দিকেচ। বয়স ৫১। তুরস্কের শ্যুটার। রুপো জিতেছেন। চলতি প্যারিস অলিম্পিক্সে। ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের মিক্সট টিম ইভেন্টে। ইউসুফের সহযোদ্ধা, সেভভাল ইলিয়াদা তারহান।
এই সেই ইভেন্ট, যেখানে মানু ভাকের এবং সরবজ্যোত সিং ব্রোঞ্জ জিতেছেন। ভারতের ক্রীড়া-দুনিয়ায় সে-ও এক নতুন ইতিহাস! দেশজুড়ে সাময়িক উৎসব হয়েছে। পলে-অনুপলে থিতিয়েছে। এখন, এই মুহূর্তে, সোশাল মিডিয়ায়, মুচমুচে হেডলাইনে কিংবা চমৎকার মিম টেমপ্লেটে একা ইউসুফ দিকেচ। কেন? কোন ম্যাজিকে? বাহ্যিকভাবে ইউসুফ বড় উদাসীন। যেন আমাদের ‘কমন ম্যান’! অটোর লাইনে মিশে যায় অনায়াসে। প্রত্যহ মাছবাজারে দেখা হয়ে যায়। অলিম্পিক্সের জেল্লা, জৌলুস অথবা জেদ– একটিও তাঁর বহিরঙ্গে নেই। নেই কোনও শ্যুটিং স্পেক্ট্যাকল। ফ্রন্ট ব্লাইন্ডার। বিশেষ কোনও লেন্স। মাথায় নেই ভাইজার, অর্থাৎ শ্যুটিং ক্যাপ! চোখে শুধুমাত্র চশমা। কানে অতিক্ষুদ্র ইয়ারপ্লাগ। বাঁ-হাতটি ভীষণ কেত-সহকারে পকেটে। সামান্য ভুঁড়ি আর চুলে বয়সোচিত পাক।
৫১ বছর বয়স। একটা রুপোর মেডেল। নিবিড় অনুশীলন। কিচ্ছু না। এ-হেন রেলা আসলে ভাইরাল। অমন আড়ম্বরহীনতায় আমরা জাস্ট চমকে গিয়েছি! অমন সোয়্যাগের অভিলাষ যে আমাদের বহুদিনের! এই মোক্ষম মুহূর্তেই যে প্রশ্নটি অবধারিত, যদি ইউসুফ দিকেচ হেরে যেতেন? যদি শূন্য হাতে তুরস্কে পৌঁছতেন? সম্ভাবনা দু’টি। হয় পৃথিবীর স্পটলাইট পাত্তাই দিত না। অথবা, তৈরি হত কুরুচিকর মিম। খিল্লির উপাদান। যে ইহজনমে ঢিল ছুড়ে আম পাড়েনি, সে-ও জ্ঞানের পশরা সাজিয়ে বলত, এত্ত ক্যাজুয়াল হলে চলে না! তুমি একটা দেশের প্রতিনিধি, অথচ বিশৃঙ্খল কেন? অলিম্পিক্স কি চ্যাংড়ামির জায়গা মশাই? পাড়ার রক? ক্রীড়া যে অসীম সাধনার, তা বোঝাবেটা কে? যত্তসব!
যেমন মানু ভাকের ভগবদগীতায় খুঁজে পেয়েছেন শৃঙ্খলা! কেউ যদি ডেথ মেটাল শুনে নিজেকে শৃঙ্খলিত করে, পরিণত করতে পারে নিষ্ঠাবান একজন ক্রীড়াবিদ, তাহলে আপত্তি কী! ইউসুফ বলছেন, ‘যখন শ্যুটিং করি, দুটো চোখই খোলা রাখলে আমার সুবিধে। দৃষ্টি বিস্তারিত হয়।’
অতএব, উপকরণের প্রয়োজন নেই। মতি নন্দী যখন লিখতেন, মাথার ওপর ঘুরছে একটি ফ্যান। ঘটাং ঘটাং। তিনি বসেছেন মেঝেতে। কাঠের চেয়ারের ওপর খাতা। ঘামছেন। প্রতিনিয়ত। অথচ ভ্রুক্ষেপ নেই। একাগ্রতার জোর এতখানি! একজন লেখকের ঘর বলতে যে বস্তাপচা ধারণা, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন মতি নন্দী। ফোকাস যেন অন্তরাত্মায়। মনে। মনেরও গভীর কোনও মনে।
ভিভিয়ান রিচার্ডসের কথাই বলি। হেলমেট ছাড়া ব্যাট করতেন। সামনে ডেনিস লিলি। জেফ থম্পসন। একেকটি অগ্নিপিণ্ড। তবু রিচার্ডস টুপি পরেই খেলছেন। কারণ, টুপিতেই স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পেয়েছেন। ওই টুপি যেন রিচার্ডসের প্রতিবিম্ব। টুপি পরে আছেন বলেই, খেলার প্রতি অত্যধিক সতর্ক। প্রগাঢ় তাঁর মন ও শরীর। একজন ধ্যানীর মতো।
বলতে চাইছি, সমস্তটাই বহিরাবরণের দাঁড়িপাল্লায় মাপা চলে না, হে পাঠক। যে বহিরঙ্গে সুন্দর, অনুগত, পরিপাটি– অন্তরও তার সুসজ্জিত এবং সে-ই স্বর্ণপদকের যোগ্য, এ ধারণা সেকেলে। এ-আই যুগে চলে না। শৃঙ্খলতার অনুশীলন চলে অন্দরে। জয়ের অনুশীলন চলে রক্তে। শিরায়। ধমনিতে। বাইরের উপকরণ দিয়ে ছোঁয়া যায় না তাকে।
তাই বলে কি অপরিহার্য উপকরণগুলি প্রত্যাখ্যান করেছেন ইউসুফ? উঁহু। মোটেই তা নয়। বহির্জগৎ থেকে একা করে নিয়েছিলেন। আর একা হয়ে যাওয়ার প্র্যাকটিসে শুধু আলাদা তিনি। বহিরঙ্গের থেকে মুক্তি আসলে অন্তরে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই বলে। ইন্সটাগ্রাম রিলস তখন আর বিহ্বল করে না। তখনই সে প্রাজ্ঞ। তখনই সে অর্জুন। যেন সে একা হতেছে আলাদা।
শৃঙ্খলা বাঁচুক ভেতর ঘরে। যে শৃঙ্খলায় দেওয়ালে আঁকা খয়েরি রঙের তিনটে দাগ হয়ে উঠতে পারে উইকেট। অথবা শৃঙ্খলা বাঁচুক ইউসুফ দিকেচ-এর ঢঙে। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন তো আম্বানি পরিবারের বিয়েতেও হয়!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved