প্যারিস অলিম্পিক শেষ। অপেক্ষা আবার চার বছরের। ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এর পরের পর্ব অনুষ্ঠিত হবে লস অ্যাঞ্জেলসে। আশা করা যায়, আবারও পদক জয়ের বৃহৎ সম্ভাবনা নিয়ে অলিম্পিকে অংশ নেবে ভারতীয় দল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য চাই সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আর তা করতে গেলে পরিকাঠামোকে যেমন ঢেলে সাজাতে হবে, তেমনই গেমসে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। প্রসঙ্গত, ২০৩৬-এ অলিম্পিক আয়োজনের ভাবনাচিন্তা ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে ভারত। কেন্দ্রীয় সরকারও গোটা ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়েছে। কিন্তু অলিম্পিক আয়োজনের আগে অলিম্পিক মঞ্চে পদক-জয়ের যোগ্য দাবিদার হয়ে ওঠা বেশি প্রয়োজন। সেটা হলেই অলিম্পিক আসরে গৌরব বৃদ্ধি বেশি হবে ভারতের।
অলিম্পিকের মঞ্চে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা বরাবর পিছু নিয়েছে ভারতের। সে-অর্থে এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি প্যারিসে। ‘কবিতার শহর’, ‘প্রেমের শহর’ থেকে হতাশা আর পদকভ্রষ্টের যন্ত্রণা নিয়ে ফিরছেন একঝাঁক ভারতীয় অলিম্পিয়ান। এবারও। মিলখা সিং থেকে পিটি ঊষা, জয়দীপ কর্মকার থেকে দীপা কর্মকার– অতীত এমন অনেক হতাশামাখা মুখ আমরা দেখেছি অলিম্পিক থেকে ফিরে আসতে। গত অলিম্পিকে টোকিও-র মাটিতে দেশকে সাফল্যের সূর্য দেখিয়েছিলেন নীরজ চোপড়া নামে এক উঠতি প্রতিভা। টোকিও থেকে প্যারিস– মাঝের এই সময় পর্বে প্রতিভা থেকে তারকা হয়েছেন নীরজ। বিন্দু বিন্দু করে সিন্ধু দর্শনের মতো তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদও চড়েছে। শুধু তিনি নন, ভারতীয় হকি দল থেকে শুটিং টিম, ভারোত্তোলন থেকে কুস্তির মঞ্চ– ভারতের পদক জয়ের সংখ্যা টোকিয়োর পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে যাবে, এই বুকভরা স্বপ্ন নিয়েই পথচলা শুরু হয়েছিল ভারতের, প্যারিস অলিম্পিকে। কিন্তু সেই প্রত্যাশার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি ভারত। বরং বিতর্কবিদ্ধ প্যারিস অলিম্পিকে নামমাত্র পদক জয়ের সন্তুষ্টি নিয়ে দেশের বিমান ধরেছেন নীরজ, মনু ভাকেররা।
এমন কেন হল? অলিম্পিকের শুরু থেকেই পদক জয়ের সংখ্যা দশের গণ্ডি পার হবে, এমনটাই ধরে নিয়েছিল ভারতীয় ক্রীড়ামহল। বাস্তবে দেখা গেল, দিল্লি বহুদূর। আদপে, প্যারিস অলিম্পিক থেকে খারাপও নয়, ভালোও নয়– এমন একটা অম্লমধুর স্মৃতি নিয়ে ফিরছেন ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা। দিনের শেষে সেই একইরকম অনুভূতি দেশ ও দশের। ১১৭ জন ক্রীড়াবিদ গিয়েও পদক সংখ্যা দশ পার হচ্ছে না, এই ব্যর্থতা নিয়ে ময়নাতদন্ত হবে। পর্যালোচনা, সমালোচনার ঢেউও বইবে। তবে সে-সব আবেগসর্বস্ব না হয়ে যুক্তিসম্মত হোক, সেটাই কাম্য।
সবচেয়ে যে জায়গাটিতে আঘাত লেগেছে বেশি করে, তা হল প্যারিস পর্বে সোনা জয়ের স্বপ্ন অধরা থেকে যাওয়া।
যাঁকে ঘিরে সে-স্বপ্ন আবর্তিত হচ্ছিল দিনের দিন পর, সেই নীরজ চোপড়াকে এবার রুপোতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে, পাকিস্তানের আরশাদ নাদিমের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের ফলে। এবং অবশ্যই বিনেশ ফোগত। জাপানের ইউয়ি সুসাকিকে হারানোর পর তাঁকেই মনে হচ্ছিল সোনা জয়ের দাবিদার। সেখান থেকে যে ভাগ্য-বিপর্যয় নেমে এসেছে বিনেশের ওপর, তা অকল্পনীয়। নীরজ, মনু কিংবা বিনেশের কথা থাক। ব্যর্থতার কারণ সন্ধানে আরও গভীরে অনুপ্রবেশ করা যাক বরং। লক্ষণীয় বিষয় হল, এবারের অলিম্পিকে ছয়জন ভারতীয় চতুর্থ স্থানে শেষ করেছেন। অর্থাৎ ভুলচুক না হলে পদক জয়ের সংখ্যাটা দশ পার করত বইকি! এই ‘ফোর্থ’ হওয়াকে মোটেই নিরাশাজনক হিসেবে দেখছেন না দেশের সফলতম অ্যাথলিট নীরজ চোপড়া। একান্ত আলাপচারিতায় নীরজ বলেওছেন, ‘চতুর্থ স্থান পাওয়াটা খুব সহজ নয়। ছয়জন পদক জয়ের খুব কাছে ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই প্রাপ্তি তাঁরা লাভ করতে পারেননি। অর্থাৎ, খারাপ ফল হয়েছে, তা মোটেই নয়।’
এরসঙ্গে যোগ করতে হবে অলিম্পিকে ইন্দ্রপতন কিংবা অঘটনের হারকেও। নিশান্ত দেব, সাত্ত্বিকসাইরাজ-চিরাগ পদক জয়ের দাবিদার ছিলেন। কিংবা লক্ষ্য সেন, পিভি সিন্ধু। তাঁদের পদক না পাওয়াটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলবেন! ভারতের শুটিং টিম, বিশেষ করে দীপিকা কুমারী হতাশাজনক পারফরম্যান্সে নিরাশ করলেও পদক জয়ের সুযোগ ছিল ধীরজ বোম্মাদেবারা, অঙ্কিতা ভকতের সামনে। যেমন পদক জয়ের সহজ সুযোগ ফেলে আসতে দেখা গিয়েছে মীরাবাই চানুকে। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে নীরজকে বাদ দিলে প্রত্যাশার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি কেউ-ই। আশা জাগিয়েও স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন অবিনাশ সাবলে, পারুল চৌধুরিরা।
নীরজ যেমন জ্যাভলিনে, তেমনই শুটিংয়ে সবেধন নীলমণি মনু ভাকের। টোকিও-র ব্যর্থতা ঘুচিয়ে প্যারিসের সাফল্যের আলো জ্বেলেছেন মনু। তাঁর এই উত্তরণ আগামিতেও পথ দেখাবে ভারতীয় ক্রীড়াজগৎকে। কিন্তু বাকি শুটাররা বড় মঞ্চে কেন ফের ব্যর্থ, এ-প্রশ্ন এড়ানো যাবে কি? একদমই নয়। যেরকমভাবে প্রশ্ন উঠবেই অন্তিম পাঙ্গালদের ব্যর্থতা ঘিরে।
প্যারিস অলিম্পিক শেষ। অপেক্ষা আবার চার বছরের। ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এর পরের পর্ব অনুষ্ঠিত হবে লস অ্যাঞ্জেলসে। আশা করা যায়, আবারও পদক জয়ের বৃহৎ সম্ভাবনা নিয়ে অলিম্পিকে অংশ নেবে ভারতীয় দল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য চাই সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আর তা করতে গেলে পরিকাঠামোকে যেমন ঢেলে সাজাতে হবে, তেমনই গেমসে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়াতে হবে।
………………………………………………………………….
আরও পড়ুন বোরিয়া মজুমদার-এর লেখা: অলিম্পিকের মঞ্চে রাজনৈতিক প্রতিবাদ, পথ দেখিয়েছিল ভারতীয়রাই
………………………………………………………………….
প্রসঙ্গত, ২০৩৬-এ অলিম্পিক আয়োজনের ভাবনাচিন্তা ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে ভারত। কেন্দ্রীয় সরকারও গোটা ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়েছে। কিন্তু অলিম্পিক আয়োজনের আগে অলিম্পিক মঞ্চে পদক-জয়ের যোগ্য দাবিদার হয়ে ওঠা বেশি প্রয়োজন। সেটা হলেই অলিম্পিক আসরে গৌরব বৃদ্ধি বেশি হবে ভারতের। দেশের ক্রীড়াপ্রেমী জনতাও অলিম্পিকের আসরে আরও বেশি করে সাফল্য দেখার প্রত্যাশা রাখেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, পদক জয়ের তালিকার শীর্ষ পর্যায়ে লড়াই করেছে যে চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাদের প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক সংখ্যক ভারতীয় ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছেন প্যারিস অলিম্পিকে। সেটাও মাত্র ১১৭। সংখ্যাটা এর তিনগুণ হলে পদক জয়ের সম্ভাবনাও যে কয়েক গুণ বাড়বে, তা বলাই যায়। আর তা বাস্তবায়নে দরকার মানসিকতায় আমূল বদল। সঙ্গে অসীম ধৈর্য। তা না হলে? অরণ্যে রোদন ছাড়া উপায় থাকবে না বরাবরের মতো।
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….