২৫ জুন ক্রিকেট ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। ৪১ বছর আগে, লর্ডসে এক অপরাহ্নে দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধরাশায়ী করে বিশ্বকাপ জেতে কপিল দেবের ভারত। প্রতিযোগিতায় ‘ডার্ক হর্স’ হিসেবে শুরু করে ভারতের এই বিশ্বজয় ক্রিকেটীয় ক্ষমতার বিন্যাসে এক বিরাট পরিবর্তন আনে। আজ ক্রিকেট-ইতিহাসের এক ভিন্ন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, রশিদ খানদের উত্থান কী নতুন কোনও বার্তা দিচ্ছে বিশ্ব-ক্রিকেটকে?
মাস-ছয়েক আগের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ওই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি নিশ্চয় তাড়া করছিল ইব্রাহিম জাদরান-রহমানুল্লাহ গুরবাজদের। সেন্ট ভিনসেন্টের কিংসটাউনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ডু-অর-ডাই ম্যাচ খেলতে নামার সময়। সুপার-এইটের ওই ম্যাচ জিততে না পারলে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যেতে হত রশিদ খানদের। প্রবল চাপের মুখে টিম আফগানিস্তানকে অক্সিজেন জুগিয়েছিল, এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে ব্রায়ান লারার ভবিষ্যদ্বাণী। প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে এক সাক্ষাৎকারে ক্রিকেটের ‘প্রিন্স’ বলেছিলেন, আফগানিস্তান এই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলবে! আর কোনও বিশেষজ্ঞ অবশ্য রশিদ খানদের ওপর বাজি ধরার সাহস পাননি।
অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক মিচেল মার্শ যখন টস জিতে আফগানদের ব্যাট করতে পাঠালেন, তখন বড় আসরে নিজেদের জাত চেনানোর চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন জাদরান-গুরবাজ জুটি। মুম্বইয়ে জাদরানের দুর্দান্ত শতরানকে ম্লান করে দিয়েছিল অজি তারকা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মহাকাব্যিক ইনিংস। পাকিস্তান, ইংল্যান্ডকে হারিয়েও গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের কাছে হেরে ছিটকে গিয়েছিল আফগানিস্তান।
জাদরান আর গুরবাজ একে অপরের পরিপূরক। জাদরানের কপিবুক-স্টাইলের ব্যাটার, সব রকমের ক্রিকেটীয় শট খেলতে পারেন। আইপিএলে কেকেআরের হয়ে ওপেনিং করা গুরবাজ মূলত স্ট্রোক-প্লেয়ার, পাওয়ার প্লে-তে বিগ-হিট করার ক্ষমতা অসাধারণ। প্রথম উইকেটে এমন একটা শতরানের পার্টনারশিপ উপহার দিলেন দুই আফগান তারকা, যার প্রতিটা স্ট্রোকে ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাসের স্পর্শ। আর একবার বোঝা গেল, আফগান ব্যাটিং এই ওপেনিং জুটির ওপর কতটা নির্ভরশীল। ৬০ রান করে গুরবাজ যখন আউট হলেন, স্কোরবোর্ডে তখন ১১৮ রান। এরপর শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র ৩০ রান যোগ করলেন বাকি আফগান ব্যাটাররা; এবং ওডিআই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী ব্যাটিং-এর সঙ্গে আফগানিস্তান বোলিং-এর টক্কর হয়ে উঠল ম্যাচের নির্ধারক।
নবীন-উল-হক, রশিদ খানরা এবার নার্ভ হারাননি। আহমেদাবাদে বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক ট্রাভিস হেডকে শূন্য রানে একটা লেট-ইনসুইঙ্গারে ক্লিন বোল্ড করে শুরুতেই অস্ট্রেলিয়াকে ঝটকা দেন তরুণ পেসার নবীন। এরপর অধিনায়ক মিচেল মার্শ আর ডেভিড ওয়ার্নারকেও তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেন আফগান বোলাররা। কিন্তু আবার কাঁটা হয়ে দাঁড়ালেন ম্যাক্সওয়েল। ব্যাট করতে লাগলেন স্বমহিমায়। উলটো দিকে উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাক্সওয়েলের ওপর চাপ বাড়ালেন রশিদ খান-গুলবাদিন নাইবরা। অবশেষে গুলবাদিন নাইবের বলে পয়েন্টে দুরন্ত ক্যাচ নিয়ে ম্যাক্সওয়েলের প্যাভেলিয়নে ফেরা নিশ্চিত করলেন নূর আহমেদ। ম্যাক্সওয়েল ফিরতেই অস্ট্রেলিয়া ভেঙে পড়ল, আর এই নার্ভের লড়াইয়ে জিতে আফগানিস্তান প্রমাণ করল– তারা ক্রিকেটের বড় আসরের জন্য পরিণত একটা দল।
শেষ ম্যাচে ছন্দে না থাকা বাংলাদেশকে হারালেই ছিল সেমিফাইনালে গিয়ে ইতিহাস তৈরির করার হাতছানি। কিন্তু আজ ওই একই মাঠে, অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচও কঠিন হয়ে পড়ে, টসে জিতে আগে ব্যাট করে নির্ধারিত ২০ ওভারে আফগানরা মাত্র ১১৫ রান তোলার পর। ওপেনিং জুটি জাদরান-গুরবাজ ফিরে যেতেই চাপে পড়ে যায় আফগান ব্যাটিং। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আবার জ্বলে উঠলেন রশিদ খান, নবীন-উল-হকরা। সঙ্গী ফজল্লাহ ফারুকিকে নিয়ে প্রথম স্পেলেই আগুন ঝড়ালেন নবীন। শুরুতেই তিন উইকেট খুইয়ে চাপে পড়ে গেল বাংলাদেশ। এরপর আর বাংলাদেশ ব্যাটিং-কে মাথা তোলার সুযোগ দেননি রশিদ খানরা। ২৩ রানে চারটি উইকেট নিয়ে আফগানিস্তানকে ইতিহাসের দোরগোড়ায় নিয়ে যান অধিনায়ক রশিদ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভূমিকম্প, তালিবানি শাসনের নাগপাশে জড়িয়ে থাকা দেশবাসীর ক্ষতে বারবার প্রলেপ দিচ্ছেন জাতীয় ক্রিকেটাররা। মাঠ নেই, ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিকাঠামো নেই, স্রেফ ক্রিকেট-প্রেমকে সম্বল করে বড় হয়ে উঠেছেন এই আফগান ক্রিকেটাররা! কিশোর রহমানুল্লাহ গুরবাজ নিজের গ্রামে এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ নিয়েছিলেন, যাতে উপার্জিত টাকায় ক্রিকেট-কিটস কিনতে পারেন! এই নিখাদ প্রেম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই বিবর্তিত হয়ে আজ ইতিহাস রচনা করল সুদূর ওয়েস্ট ইন্ডিজে!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে অন্তিম তুলির টান দেন নবীন, বাংলাদেশের শেষ দুটো উইকেট তুলে নিয়ে। নবীন ফিরলেন ২০ রানে চার উইকেট হাতে। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে রশিদ খানরা আট রানে জিতে সেমিফাইনাল খেলার ছাড়পত্র আদায় করে নিলেন। জয়ের পর টিভি স্ক্রিনে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে দেখা যায় আফগান দলের দুই চাণক্য– জোনাথন ট্রট ও ডোয়েইন ব্রাভোকে। ব্রিটিশ কোচ ট্রট দীর্ঘদিন ধরে রশিদ খানদের দায়িত্বে; আর প্রাক্তন ক্যারিবিয়ান তারকা ব্রাভোকে সাম্প্রতিক বোলিং কোচ হিসেবে নিয়োগ করেছে আফগানিস্তান। ব্রাভো দায়িত্ব নেওয়ার পর এই বিশ্বকাপে আরও ধারালো মনে হয়েছে আফগান বোলিং-বিভাগকে। আর তাই, এখন নিছক ‘জায়ান্ট-কিলার’ থেকে ‘জায়ান্ট’ হয়ে ওঠার দিকে ছুটছে আফগান ক্রিকেট!
‘একমাত্র ব্রায়ান লারা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগে বলেছিলেন, আমরা সেমিফাইনাল খেলব। ওঁর মতো কিংবদন্তির আস্থা আমাদের অনুপ্রাণিত করে ছিল। সেই আস্থার মর্যাদা রাখার চেষ্টা করব, আমরা কথা দিয়েছিলাম লারাকে। সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পেরে আমরা গর্বিত’। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে প্রেস-কনফারেন্সে যখন একথা বলছেন রশিদ খান, তখন তার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে। জালালাবাদে জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখতে ভোররাত থেকেই জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। নবীন-উল-হক শেষ উইকেট নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় উৎসব। ফাটতে থাকে আতশবাজি, বিলি হয় মিঠাই। ঠিক যেমন ভারতের মাটিতে ওডিআই বিশ্বকাপে পাকিস্তান আর ইংল্যান্ডকে হারানোর পর বাজি ফাটিয়ে অকাল দীপাবলি পালিত হয়েছিল আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে!
ভূমিকম্প, তালিবানি শাসনের নাগপাশে জড়িয়ে থাকা দেশবাসীর ক্ষতে বারবার প্রলেপ দিচ্ছেন জাতীয় ক্রিকেটাররা। মাঠ নেই, ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিকাঠামো নেই, স্রেফ ক্রিকেটপ্রেমকে সম্বল করে বড় হয়ে উঠেছেন এই আফগান ক্রিকেটাররা! কিশোর রহমানুল্লাহ গুরবাজ নিজের গ্রামে এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ নিয়েছিলেন, যাতে উপার্জিত টাকায় ক্রিকেট-কিটস কিনতে পারেন! এই নিখাদ প্রেম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই বিবর্তিত হয়ে আজ ইতিহাস রচনা করল সুদূর ওয়েস্ট ইন্ডিজে! কাকতালীয়ভাবে, এই ২৫ জুন ক্রিকেট ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। ৪১ বছর আগে, লর্ডসে এক অপরাহ্নে দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধরাশায়ী করে বিশ্বকাপ জেতে কপিল দেবের ভারত। প্রতিযোগিতায় ‘ডার্ক হর্স’ হিসেবে শুরু করে ভারতের এই বিশ্বজয় ক্রিকেটীয় ক্ষমতার বিন্যাসে এক বিরাট পরিবর্তন আনে। আজ ক্রিকেট-ইতিহাসের এক ভিন্ন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, রশিদ খানদের উত্থান কী নতুন কোনও বার্তা দিচ্ছে বিশ্ব-ক্রিকেটকে?
ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারিয়ে গিয়েছে। পাকিস্তান নানা সমস্যায় বিদীর্ণ। শ্রীলঙ্কা অতীতের ছায়ামাত্র। বাংলাদেশ দু’দশকেও সেভাবে উঠে আসতে ব্যর্থ! ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ড– এই পাঁচ দেশের মধ্য প্রায় সীমিত হয়ে যাওয়া ক্রিকেট মানচিত্রে এক নতুন শক্তি হয়ে উঠে আসতে পারে ইব্রাহিম জাদরান-নবীন-উল-হক-রশিদ খানের আফগানিস্তান! তবে তার জন্য আফগানিস্তান ক্রিকেটকে আরও অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। এই সাফল্য হয়তো তাঁদের বড় দলগুলোর সঙ্গে আরও বেশি ওডিআই ও টেস্ট খেলার সুযোগ করে দিতে পারে। তবে তার জন্য ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিকাঠামো গড়ে তোলাও খুব প্রয়োজনীয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সোমক রায়চৌধুরী-র লেখা: যুদ্ধ আর তালিবানি শাসনের ধ্বংসস্তূপ থেকে মুক্তির বার্তা ক্রিকেট
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আপাতত নজর থাকবে আগামী বৃহস্পতিবারের সেমিফাইনালে। যেখানে রশিদ খানদের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা। একদিনের ব্যবধানে মাঠে নামতে হবে আফগানদের, তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তা বড় সমস্যা নয়। সেমিফাইনালে আফগানিস্তানের তুরুপের তাস হতে পারে, রশিদ-নূর আহমেদ-মহম্মদ নবিদের নিয়ে গড়া স্পিন আক্রমণ– বিশেষ করে স্পিন বোলিংয়ের বিরুদ্ধে যখন প্রোটিয়ারা একেবারেই স্বচ্ছন্দ নন। ২০১০-এ এই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার মাধ্যমে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আলো দেখেছিল আফগানিস্তান, নিছক আইসিসি-র অধিভুক্ত(অ্যাফিলিয়েট) সদস্য হিসেবে। ওই দলের অন্যতম সদস্য মহম্মদ নবি বর্তমান দলের সবথেকে সিনিয়ার ক্রিকেটার। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতেই এখন ফাইনাল খেলার স্বপ্নে বিভোর নবীন-নূর আহমেদরা। খোস্ত, কাবুল, জালালাবাদ সহ ও দেশের নানা প্রান্তে আজ সকাল থেকেই উৎসব চলছে। দেশবাসীর উচ্ছ্বাস দেখে তালিবান সরকারও এই জয়কে স্বীকৃতি দিয়েছে। রশিদ খানরা ফাইনাল খেলুন বা না খেলুন, এই ক্রিকেট-জোয়ার আফগানিস্তানকে আগামী কয়েক বছর ভাসাবে, তা নিশ্চিত করে দিল এই ২৫-এ জুন।
………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………