ভারতীয় কুস্তিকে ব্রিজভূষণ-মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। পারেননি। সর্বভারতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি নির্বাচনে ব্রিজভূষণ-ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় সিং জিততেই প্রতিবাদে তাই অবসর ঘোষণা করে দিয়েছেন সাক্ষী মালিক। চোখের জলে। একদম আচমকাই। একরাশ ক্ষোভ-হতাশা যে বাধ্য করল এহেন কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে, ‘রোববার.ইন’-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তা স্পষ্ট করলেন রিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী ভারতীয় মহিলা কুস্তিগির। সাক্ষাৎকার নিলেন অরিঞ্জয় বোস।
আচমকাই অবসরের কথা ঘোষণা করে দিলেন। জানি, মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছেন। তবু এতটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা কঠিন ছিল?
সাক্ষী: দেখুন, কুস্তি আমাদের ভালোবাসার জায়গা। সেখানে অন্যায় হলে চুপ থাকতে পারব না। আমরা প্রত্যেকেই (প্রতিবাদী কুস্তিগিররা) অন্যায়ের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলাম। হৃদয় দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু তার প্রতিফলন সর্বভারতীয় কুস্তি সংস্থার নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়নি। এই ফলাফল আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত! বিশ্বাস করুন, মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম একজন মহিলা ফেডারেশনের সভাপতি হোক। (কেন্দ্র) সরকারও তেমনটাই আশ্বাস দিয়েছিল আমাদের। কিন্তু ফলাফলে প্রমাণিত সেই প্রতিশ্রুতি পালন করা হয়নি।
আজ যদি কোনও মহিলা সভাপতি পদে জয় পেতেন, কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু পুরো গর্ভনিং বডিতে একজনও মহিলা নেই। পুরো নির্বাচনটাই একটা প্রহসন ছিল। ধোঁকা ছাড়া কী বলব একে বলুন? উপরন্তু সভাপতি পদে যিনি জিতেছেন, তিনি ব্রিজভূষণের ব্যবসায়িক-বন্ধু। ওর সহযোগী। এর চেয়ে লজ্জার, অপমানের আর কিছু হয় না। ওর (সঞ্জয় সিং) মতো লোক ফেডারেশনে থাকলে আমি কুস্তি করব না। তাই কুস্তি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঠিক করেছি, আর ম্যাটে নামব না। এত লড়াই করার পরেও যদি ন্যায্য বিচার না পাই, সেই ব্রিজভূষণ এবং ওর অনুগামীদের সামনে কুস্তি করতে হয়, তা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ভীষণ আবেগপ্রবণ এবং স্পর্শকাতর মানুষ। কুস্তিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি। চিরকাল সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। তাই অন্যায় আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। চোখের সামনে অন্যায় হতে দেখলে প্রতিবাদ করবই। যেমনটা বরাবর করেছি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আপনি বলছেন, সরকার আশ্বাস দিয়েছিল। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সরকারের কারও সঙ্গে কি আপনাদের কথা হয়েছে?
সাক্ষী: পাঁচ-ছয় দিন আগেই কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, সরকারের তরফে যে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা পূরণ করা হবে। কিন্তু গভর্মেন্ট কথা রাখেনি। রাখলে ব্রিজভূষণ ঘনিষ্ট সঞ্জয় সিং ভোটে লড়তে পারতেন না। ব্রিজভূষণের ছেলে সবার সামনে জোর গলায় প্রচার করছে– ‘ক্ষমতায় ছিলাম, আছি, থাকব’। সোশাল মিডিয়ায় খেয়াল করে দেখুন, সঞ্জয় সিং জেতার পর সবাই ব্রিজভূষণকে মালা পরাচ্ছে। যেন ভোটে ব্রিজভূষণই জিতেছে। একটা ব্যাপার দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, সঞ্জয় সিং আসলে ব্রিজভূষণের হাতের পুতুল। ও যেমন বলবে, তেমনভাবে চলবে সঞ্জয় সিং। তাই সঞ্জয় সিংয়ের মতো লোক ক্ষমতায় থাকলে মহিলা কুস্তিগিররা কখনও ন্যায়বিচার পাবে না। বরং অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে আরও ঘুরে বেড়াবে। আরও অপরাধের ঘটনা ঘটবে। ভারতীয় কুস্তির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সে’সব চোখের সামনে সহ্য করতে পারব না বলেই সরে যাচ্ছি।
এই লড়াইয়ে আপনার সঙ্গে তো বজরং পুনিয়া, ভিনেশ ফোগতরাও ছিলেন। আরও অনেকে আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বজরং ইতিমধ্যে পদ্মশ্রী পদক ফিরিয়েছেন। আপনাদের আন্দোলনের কী হবে?
সাক্ষী: দেখুন, একটা কঠিন পরিস্থিতির মুখে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। জানি না, লড়াইটা বজরংরা চালিয়ে যেতে পারবে কি না। পরের প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। গত এক বছর ধরে পথে নেমে যে প্রতিবাদ আমরা করেছি, তার বিনিময়ে অনেক লাঞ্ছনা আমাদের সহ্য করতে হয়েছে। আমাদের জেলে ভরা হয়েছে। পুলিশি-নিগ্রহ হয়েছে। দিদি-বোনদের মুখের দিকে তাকিয়ে ন্যায়বিচারের আশায় সব সহ্য করেছি। এত কিছুর পরেও সরকার উদাসীন থাকল। কার কাছে তাহলে ন্যায়বিচার চাইব, বলতে পারেন? মানসিকভাবে বজরং শক্ত ধাতের। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ও হয়তো কুস্তি চালিয়ে যাবে। কিন্তু আমি পারব না। আগেও বলেছি, আমি স্পর্শকাতর মানুষ। অন্যায় মুখ বুজে মেনে নিতে শিখিনি। কখনও তার সঙ্গে আপোস করতে পারব না।
এরপর কী করবেন, ঠিক করেছেন কিছু?
সাক্ষী: জানি না। প্রায় এক বছর ধরে আমরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছি। তার কোনও প্রতিকার পেলাম না। এর লড়াইয়ের পরেও সেই অপরাধীরাই জিতে গেল। আমরা ন্যায়বিচার চেয়েছিলাম। সরকার সব জেনেও হাত গুটিয়ে নিল। সঞ্জয় সিংয়ের জয় মানে ব্রিজভূষণের জয়। এই যন্ত্রণা সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্ষমতায় যারা এসেছে, প্রতিপদে তাদের বাধার সম্মুখীন হব। এভাবে কুস্তি চালিয়ে যাওয়া আমার দ্বারা হবে না।না