Robbar

দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 22, 2025 8:01 pm
  • Updated:October 22, 2025 8:32 pm  

সেই গতির দেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, মাত্র আড়াই-দশক যেতে না যেতেই, করে ফেলল তাদের চরিত্রবিরোধী এক ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। বাংলাদেশের সঙ্গে একদিনের ম্যাচে ৫০ ওভারই বল করলেন ক্যারিবিয়ান স্পিন বোলাররা! তবে ঠিক ৫০ ওভারও নয়, বলতে হবে ৫১ ওভার; কেননা ম্যাচ টাই হয়ে যাওয়ার ফলে খেলা গড়ায় সুপার ওভারে, আর সেই একমাত্র ওভারটিও করেন একজন স্পিন বোলার!

ঋত্বিক মল্লিক

কিছুদিন আগেই স্মৃতিচারণ করতে বসে রবি শাস্ত্রী তুলে আনছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ব্যাট করার অভিজ্ঞতা– শুরু থেকেই আক্রমণ শানাতেন চার দুর্ধর্ষ ফাস্ট বোলার, প্রায় সারাক্ষণই তাঁদের হাত থেকে বেরিয়ে-আসা গোলাগুলি চলতেই থাকত। প্রায় ৬০-৬৫ ওভার কেটে যাওয়ার পর সামান্য কিছুক্ষণের স্বস্তি  হয়তো পাওয়া যেত, যদি ল্যারি গোমস বা রজার হার্পার আসতেন স্পিন বল করতে, কিংবা বড়জোর কয়েক ওভারের জন্য আসরে নামতেন ভিভ রিচার্ডস।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস আক্রমণের চার মূর্তি: (বাঁ-দিক থেকে) অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, কলিন ক্রফ্ট ও জোয়েল গার্নার

কিন্তু সে আর কতটুকু! অচিরেই ঘনিয়ে আসত নতুন বল নেওয়ার সময়, আর আবার শুরু হয়ে যেত ভয়ংকর গতিবেগে শরীর তাক ছুটে আসা ‘পারফিউমড বল’। না, শাস্ত্রী অবশ্য উল্লেখ করেননি এই বিশেষ শব্দবন্ধটি। যিনি বলেছিলেন একথা, সারা পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র তাঁর হাতেই জব্দ হয়েছিল ক্যারিবিয়ান পেস-অ্যাটাক, অন্য দেশের খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে ভালোবেসে গান বেঁধেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট-পাগল দর্শক। রূপকথার সেই নায়ক সুনীল গাভাসকার ব্যাখ্যা করেছিলেন এমন নামকরণের হেতু।

সুনীল গাভাসকর

নাকের একেবারে পাশ দিয়ে সাপের মতো হিসহিস শব্দ তুলে বেরিয়ে যাওয়া বলই ‘পারফিউমড বল’, নাকের এতটাই কাছ দিয়ে সেসব গোলা ছুটে যেত যে ব্যাটাররা রীতিমতো বলের গন্ধও শুঁকে ফেলতে পারতেন! ভিভ অবশ্য স্লিপে দাঁড়িয়ে অন্য নামে ডাকতেন এমন সব বলকে, অ্যান্ডি রবার্টসকে চিৎকার করে বলতেন ‘পাস দ্য নোজ’।

আউট লিটল মাস্টার, উচ্ছ্বসিত ভিভ রিচার্ডস

উত্তর অতলান্তিক মহাসাগর আর ক্যারিবিয়ান সাগরের এই দ্বীপপুঞ্জের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝোড়ো হাওয়ার মতোই যেন এখানকার মানুষের রক্তের মধ্যে রয়ে গিয়েছে গতির প্রতি এক অদৃশ্য পক্ষপাত। তাই জোরে বল করাই যেন হানা দেয় তাদের স্বপ্নের মধ্যে। আর সেই স্বপ্নই অবিকল বাস্তবে রূপ পেয়েছিল ক্লাইভ লয়েডের হাতে। চারজন দ্রুত গতির বোলার নিয়ে খেলার পরিকল্পনা প্রথম আসে তাঁর মাথায়। অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিংয়ের মতো ‘নিঃশব্দ ঘাতক’দের নিয়েই সাজানো ছিল তাঁর আক্রমণভাগ।

ক্যারিবিয়ান পেস-ব্যাটারি

এই তিনজনের সঙ্গে প্রথমে ছিলেন কলিন ক্রফট, আর তারপরে এলেন ম্যালকম মার্শাল। ষোলো কলা পূর্ণ হল যেন। বিশ্বক্রিকেট শাসন করার ক্ষেত্রে এমন ভয়াবহ অস্ত্রের সমাহার আর কখনও দেখা যায়নি। এই ধারা তারপরেও বয়ে চলেছিল গত শতকের শেষ অবধি প্যাট্রিক প্যাটারসন, কোর্টনি ওয়ালস, কার্টলে অ্যামব্রোজ আর ইয়ান বিশপের হাত ধরে।

ম্যালকম মার্শাল

সেই গতির দেশ, মাত্র আড়াই-দশক যেতে না যেতেই, করে ফেলল তাদের চরিত্রবিরোধী এক ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। বাংলাদেশের সঙ্গে একদিনের ম্যাচে ৫০ ওভারই বল করলেন ক্যারিবিয়ান স্পিন বোলাররা! তবে ঠিক ৫০ ওভারও নয়, বলতে হবে ৫১ ওভার; কেননা ম্যাচ টাই হয়ে যাওয়ার ফলে খেলা গড়ায় সুপার ওভারে, আর সেই একমাত্র ওভারটিও করেন একজন স্পিন বোলার!

অবাক হয়ে গিয়েছে সারা পৃথিবী। এ যেন লেখালিখি ছেড়ে নিয়মিত র‍্যাম্পে হাঁটছেন সলমন রুশদি, যেন তবলা বাজানো ছেড়ে পায়রা পুষছেন জাকির হোসেন!

যে ম্যাচ নিয়ে তোলপাড় ক্রিকেটবিশ্ব

যাঁরা এতটা অবাক হননি তাঁদের যুক্তি হল, পরিস্থিতির চাপে আসলে এমনটাই করতে হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। মীরপুরের এমন অদ্ভুত ‘ধানখেতের মতো’ পিচে স্পিন বোলিং-ই হতে পারে একমাত্র অস্ত্র, তাই এ হেন নজির গড়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তা বলে এতটা! বাংলাদেশ পর্যন্ত সব মিলিয়ে নয় ওভার বল করিয়েছে দ্রুত গতির বোলার মুস্তাফিজুর রহমানকে দিয়ে। অথচ, ফাস্ট বোলিং আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেখানে সমার্থক, সেখানে এই এত বৈপরীত্য কী করে ঘটে গেল মাত্র আড়াই-দশকের মধ্যে!

খুব ছোটবেলায় দু’-খানি লেখা পড়েছিলাম ক্রিকেট নিয়ে। ‘আনন্দমেলা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত পঙ্কজ রায়ের লেখা আত্মজীবনী ‘ব্যাটে বলে’। আর প্রায় একই সময়ে পড়েছিলাম শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বই ‘দুরন্ত দুর্জয়’। সেখানে ছিল ওয়েস হল আর ক্লাইভ লয়েডের জীবনী। ছেলেবেলা থেকেই পড়েছি রয় গিলক্রিস্ট, চার্লস গ্রিফিথ আর ওয়েসলি হলকে নিয়ে মাতামাতির কথা। পরে সাদা-কালো টেলিভিশনে দেখেছি ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে চার পেসারের দৌরাত্ম্য। তবু ওয়েস্ট ইন্ডিজ বললেই যে শুধু দ্রুত গতির বোলার– এ-কথা মেনে নিতে খুব প্রস্তুত নই আমি।

বাইশ গজে বিধ্বংসী ওয়েসলি হল

ক্রিকেটের ইতিহাস খেয়াল করলে দেখা যাবে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে প্রথম ৩০০ উইকেট পেয়েছিলেন এক অফ স্পিনার, লয়েডের তুতোদাদা ল্যান্স গিবস। মাত্র ৭৯টি টেস্ট খেলে তিনি একসময় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর বিরল নজির সৃষ্টি করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, তাঁর সমকালেই ছিলেন এই ওয়েস হল-গিলক্রিস্টরা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের খ্যাতনামা স্পিনার ল্যান্স গিবস

উইকেট পাওয়ার দিক থেকে ল্যান্স গিবস-এর খুব কাছাকাছি ছিলেন স্যর গারফিল্ড সোবার্স, কিন্তু তিনিও সেই অর্থে ফাস্ট বোলার ছিলেন না, মিডিয়াম পেস থেকে স্পিন, সবই ছিল তাঁর অস্ত্রের ভাঁড়ারে। আর একটি ম্যাচের কথাও না বললেই নয়। ১৯৬১-’৬২ সালে ভারতের সঙ্গে ব্রিজটাউনে এক ইনিংসে তিনি বল করলেন ১৫.৩ ওভার, রান দিলেন মাত্র ছয়, তুলে নিলেন ৮ উইকেট। ভারতের রান ছিল একসময় ১৪৯/২, সেখান থেকে গিবস-এর স্পিনের দাপটে শেষ হয়ে যায় ১৮৭ রানে। তাঁর মতো কৃপণ বোলার আর এসেছে কি না সন্দেহ!

তাঁর অনেক পরে ম্যালকম মার্শাল তাঁকে প্রথম টপকে যান। আজ পর্যন্ত মাত্র তিনজন আছেন তাঁর আগে– মার্শাল ছাড়া, ওয়ালস আর অ্যামব্রোজ। নেভিল কার্ডাস স্কোরবোর্ডকে যতই গাধা বলুন না কেন, আপনি পরিসংখ্যানকে যদি নেহাত গাধার বুলি বলে অবজ্ঞা না করেন, ল্যান্স গিবসকে ভুলে যাওয়া যায় না কোনও মতেই।

ল্যান্স গিবস-এর কথা যখন উঠলই তাহলে অবশ্যই বলতে হবে ডান হাতি অফ ব্রেক বোলার সোনি রামাধীন আর তাঁর জুড়িদার বাঁ-হাতি স্পিনার আল্‌ফ (আলফ্রেড) ভ্যালেনটাইন-এর কথাও। দু’-জনের উইকেট সংখ্যা যথাক্রমে ১৫৮ (৪৩টি টেস্টে) এবং ১৩৯ (৩৬টি টেস্টে), তাঁদের আগে এত উইকেট ছিল না কারও ঝুলিতে। ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম জেতার ক্ষেত্রে এই দু’জনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সোনি রামাধীন যখন বল করতেন, তখন হামেশাই দেখা যেত ক্লোজ-ইন ফিল্ডারের আধিক্য এবং শর্ট লেগ অঞ্চলে দাঁড় করাতেন তিনজন ফিল্ডারকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই জয় আজও স্মরণীয় হয়ে আছে ‘ভিক্টরি ক্যালিপসো’ গানের মধ্যে। গানটি তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত ক্যালিপসো গায়ক লর্ড কিটচেনার।

এখানে একটি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটি টিপ্পনি যোগ করছি। গাভাসকারকে নিয়েও ‘গাভাসকার ক্যালিপসো’ গানটি বাঁধেন লর্ড রিলেটর (ওরফে, উইলার্ড হ্যারিস) এবং গত শতকের শ্রেষ্ঠ ক্যালিপসোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে এই গানটি।

We couldn't out Gavaskar at all': The calypso sounds as fresh as ever
লর্ড রিলেটর, ‘গাভাসকর ক্যালিপসো’র স্রষ্টা

যাই হোক, ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিন বোলিংয়ের এই ধারা। তবে ২০০১ সালেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটি একদিনের ম্যাচে স্পিনারদের দিয়ে ৩৪ ওভার বল করানোর নজিরও কিন্তু ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। তবে মীরপুরে যা ঘটল, স্পিন বোলিংয়ের পক্ষে সেই রেকর্ড রয়ে গেল চিরকালের মতো, এই রেকর্ড ছোঁয়া যেতে পারে, কিন্তু ভাঙা সম্ভব নয় কোনও মতেই।

এই লেখাটির ক্ষেত্রে ধন্যবাদ জানাতেই হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বর্তমান অধিনায়ক শাই হোপ-কে এবং তাঁদের টিম ম্যানেজমেন্টকে। তাঁরা এই রকম কাণ্ড ঘটালেন বলেই একবার ফিরে দেখা গেল তাঁদের দেশের স্পিন বোলিংয়ের ঐতিহ্য, ভয়ংকর সব পেস বোলারদের ভিড়ে যা হয়তো চোখে পড়ে না আর, প্রায় হারিয়েই গিয়েছে ক্রিকেটের মানচিত্র থেকে।

…………………………

রোববার.ইন-এ পড়ুন ঋত্বিক মল্লিক-এর আরও লেখা

…………………………