রবিবার পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে অপগত বিভাবরীতে একবার খোলা আকাশের নীচে এসে একাকী দাঁড়াবেন না রাহুল শরদ দ্রাবিড়? নীল ধ্রুবতারাকে সাক্ষী রেখে আত্মমগ্ন চিত্তে স্মরণ করবেন না ২০০৭-এ পোর্ট অফ স্পেনে বিশ্বকাপ বিসর্জনের কালরাত্রিকে? গ্রেগ চ্যাপেলের অবিমৃশ্যকারিতা আর কাপ-যুদ্ধের গ্রুপপর্ব থেকে লজ্জার বিদায়ে যে কলঙ্কের দাগ লেগেছিল অধিনায়ক দ্রাবিড়ের কেরিয়ারে। ১৬ বছরের ব্যবধানে সেই ব্যর্থ-নেতার দোসর হল ব্যর্থ-কোচ। দ্বৈত সত্তায় মানুষটা সেই এক– রাহুল দ্রাবিড়।
রাহুল শরদ দ্রাবিড়। হ্যাঁ ‘মিস্টার ডিপেন্ডবল’, আপনাকেই বলছি।
বড় আশা করেই আমরা এসেছিলাম আপনার কাছে। আমরা যারা ক্রিকেট ভালোবেসে বছরের পর বছর তাকিয়ে থেকেছি চিরহরিৎ ক্ষেত্রে, আর দেখেছি আপনিই সেই অসামান্য কৃষক, যাঁর আবাদে সোনা ফলেছে। জেনেছিলাম, পারলে আপনিই পারবেন। শাস্ত্রীয় জমানা যখন নিরুদ্দেশের উদ্দেশে, তখন আপনার আগমনী ঘোষণায় আমাদের মনে ছড়িয়ে পড়েছিল শরতের সোনা রোদ। উৎসবের ঘ্রাণ প্রাণ ভরিয়ে দিয়েছিল আমাদের। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, আপনিই আমাদের সেই মতি নন্দীর বেহুলার ভেলা, শত ঝঞ্ঝাতেও যা ডোবে না। বরং মৃত স্বপ্নকে ফিরিয়ে আনতে পারে জীবনের কাছে।
বিশ্বকাপ ফাইনালের পরিসমাপ্তিতে ওই যে শ্মশান-নীরবতা। বিরাট, রোহিত, জাদেজাদের কাতর বিধ্বস্ত অবয়ব, সেসব কি আপনাকে যন্ত্রণাদগ্ধ করছে না? মন কি চাইছে না, সকলের অলক্ষ্যে নিজের অতীত আর বর্তমানকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে?
কোচ রাহুলের যে নীরব সাধনা, যা ক্রিকেটার রাহুল দ্রাবিড়, ব্যাটার রাহুল দ্রাবিড় থেকে সঞ্জাত। তাঁর দেখার পর স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল গোটা দেশ। কিন্তু আপনি আমাদের ইচ্ছেনদীতে পানসি ভাসিয়ে যে করুণ পরিণতি উপহার দিলেন, তাতে পারাপার তো আর সম্ভবপর হয়ে উঠল না, বরং নৌকাডুবিই স্থির নিয়তি। এ তো দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার চেনা ছবি! যাঁর নিরলস পরিশ্রম, অবিচল অধ্যবসায়কে ক্রিকেট বিধাতা অগ্রাহ্য করেছেন। উপেক্ষার মানদণ্ডে বসিয়ে দিয়েছেন দ্বিতীয় সারিতে। ’৯৬-এর লর্ডসে অভিষেক টেস্টে শতরানকারী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো শতক সমীপে থাকা আর পাঁচটা রান কি প্রাপ্য ছিল না রাহুল শরদ দ্রাবিড়ের? ২০০১-এ ইডেনে স্টিভ ওয়া শাসিত অস্ট্রেলিয়ার জয়রথ থামিয়ে দেওয়া ভারতের সেই ব্যাটিং বিপ্লব, সেটা কি শুধুই ভিভিএস লক্ষ্মণের ২৮১-র অমরত্বের ফসল? অফফর্মের রাহুগ্রাস কাটিয়ে রাহুলের ১৮০ কি স্রেফ অকিঞ্চিৎকর? সেঞ্চুরিয়নে শচীনের রূপকথার ৯৮ এখনও ক্রিকেটপ্রেমী জনতার স্মৃতিতে জাগরিত। শুধু মুছে গিয়েছে দ্রাবিড়ের জয়সূচক অপরাজিত ৪৪-এর অবিচল লড়াইটুকু। কখনও শচীন, কখনও সৌরভ, কখনও বা লক্ষ্মণের ব্যাটিং ঔজ্জ্বল্যের সামনে মেঘে ঢাকা তারা হয়েই রয়ে গিয়েছেন তিনি। আক্ষেপকে আত্মস্থ করে তাঁর অবস্থান যেন শরৎ-সাহিত্যে বঞ্চিতের আত্মক্রন্দনের মতো– ‘সংসারে তারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই।’
রবিবার পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে অপগত বিভাবরীতে একবার খোলা আকাশের নীচে এসে একাকী দাঁড়াবেন না রাহুল শরদ দ্রাবিড়? নীল ধ্রুবতারাকে সাক্ষী রেখে আত্মমগ্ন চিত্তে স্মরণ করবেন না ২০০৭-এ পোর্ট অফ স্পেনে বিশ্বকাপ বিসর্জনের কালরাত্রিকে? গ্রেগ চ্যাপেলের অবিমৃশ্যকারিতা আর কাপ-যুদ্ধের গ্রুপপর্ব থেকে লজ্জার বিদায়ে যে কলঙ্কের দাগ লেগেছিল অধিনায়ক দ্রাবিড়ের কেরিয়ারে। ১৬ বছরের ব্যবধানে সেই ব্যর্থ-নেতার দোসর হল ব্যর্থ-কোচ। দ্বৈত সত্তায় মানুষটা সেই এক– রাহুল দ্রাবিড়।
ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার অনেক ঊর্ধ্বে দলগত প্রাপ্তিকে বরাবর গুরুত্ব দেওয়া কোচ রাহুলের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেন একজন– সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ২০০৩-এ বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল সৌরভের টিম ইন্ডিয়াকে। সেদিনের সেই পরাভূত দলের শরিক ছিলেন দ্রাবিড়। ২০ বছর আগে স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটানো সেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে, হিসাবের পাঠ চুকিয়ে বিশ্বজয়ের সুযোগ ছিল দ্রাবিড়সভ্যতার সামনে, কিন্তু তীরে এসে সেই ডুবল তরী। নিষ্পলক চিত্তে ’০৩-এর দুঃস্বপ্নের রাতের ফিরে আসা দেখলেন ‘দ্য ওয়াল’।
রাহুল দ্রাবিড়, এখন আপনি আমাদের কাছে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস, বিষাদযোগের অর্জুন।