কোচ নাগেলসম্যান তাঁর খেলোয়াড়দের নিয়ে উঠেছেন হারজোগেনাউরাখে আদিদাসের ক্যাম্পে, ইউরো চলাকালীন এ-ই আপাতত জার্মানদের আস্তানা। এলাহি ব্যবস্থা, থাকা-খাওয়া-মনোরঞ্জন– কোনও কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু মূল সমস্যাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে মশা। ভাবুন, দুঁদে প্রতিপক্ষ নয়, খেলার কোনো আঙ্গিক নয়– এত বড় প্রতিযোগিতা চলাকালীন জার্মানদের আপাতত সব থেকে বড় মাথাব্যথা আদি-অকৃত্রিম মশা। সে-এলাকায় মশার এমনই উপদ্রব, জার্মান খেলোয়াড়রা নাকি ঘরের বাইরে দু’-দণ্ড তিষ্ঠোতেই পারছেন না। গ্রাফিক্স অর্ঘ্য চৌধুরী।
‘নো মি মলেস্তে মসকিটো/ লেট মি ইট মাই বুরিটো/ হোয়াই ডোন্ট ইউ গো হোম?’– লিখেছিল রক ব্যান্ড ‘দ্য ডোরস’, আজ থেকে ৫২ বছর আগে, গেয়েছিলেন রবি ক্রিগার। শব্দগুলো পাতি অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: মশা, আমায় খাবার খেতে দে, বিরক্ত করিস না। তা, ইউরো কাপে জার্মান শিবিরে যদি এরকম বিভিন্ন মশকবিরোধী গান ঘুরেফিরে বাজে, তাহলে বিস্মিত হবেন না। ব্যাপারটা একটু খুলে বলি। কোচ নাগেলসম্যান তাঁর খেলোয়াড়দের নিয়ে উঠেছেন হারজোগেনাউরাখে আদিদাসের ক্যাম্পে, ইউরো চলাকালীন এ-ই আপাতত জার্মানদের আস্তানা। এলাহি ব্যবস্থা, থাকা-খাওয়া-মনোরঞ্জন– কোনও কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু মূল সমস্যাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে মশা। ভাবুন, দুঁদে প্রতিপক্ষ নয়, খেলার কোনও আঙ্গিক নয়– এত বড় প্রতিযোগিতা চলাকালীন জার্মানদের আপাতত সব থেকে বড় মাথাব্যথা আদি-অকৃত্রিম মশা।
সে-এলাকায় মশার এমনই উপদ্রব, জার্মান খেলোয়াড়রা নাকি ঘরের বাইরে দু’-দণ্ড তিষ্ঠোতেই পারছেন না। সুইমিং পুলের ধারে সকলে জড়ো হলেই সে-জমায়েতে শামিল হতে আসছে মশাবাহিনী। ভরসা এখন কীটনিরোধক স্প্রে আর মশারি। ক্যাম্পটা বনাঞ্চলে। জার্মানিতে বন্যার প্রকোপে হু-হু করে বেড়েছে মশার সংখ্যা; পাশাপাশি সে-দেশের তাপমাত্রাও ক্রমবর্ধমান। ফলে, তৈরি হয়েছে ‘মসকিটো প্লেগ’-এর আদর্শ পরিবেশ। নাগেলসম্যান বলেছেন, ‘যদি একটু হাওয়া বয়, তাহলে আমরা বাইরে জড়ো হই, মশার উৎপাত খানিক কম থাকে। নাহলে সকলকে অফিসঘরেই আসতে হয়।’ প্রতিপক্ষের দলবদ্ধ আক্রমণ না-হয় অঙ্ক কষে, ক্ষুরধার ফুটবল খেলে থামানো যাবে; মশকবাহিনীর সম্মিলিত হামলা সামলানোর মন্ত্র জানে কে? জটিল প্রশ্ন।
……………………………………………………………………………………………………………………..
ম্যালেরিয়া বরাবরই এ-দেশে ছিল, কিন্তু বাড়বাড়ন্তের কারণ হিসেবে অনেকে ব্রিটিশদেরই দায়ী করেন। ব্রিটিশরা রেলের বন্দোবস্ত করার সময়ে, সেচ-সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করার সময়ে নিকাশিব্যবস্থার দিকে তেমন মনোযোগ দেয়নি। এ-দেশের বেশিরভাগ অংশে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি এবং অবরে-সবরের বন্যার জল বেরনোর তেমন জায়গা থাকত না।
……………………………………………………………………………………………………………………….
তা, ক্রীড়া-ইতিহাসে এ-পরিস্থিতি বিরল হলেও মশাদের জ্বালায় ইউরোপীয়দের নাজেহাল হওয়া অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয়। আমরা যখন ইতিহাসে আমাদের উপনিবেশিত পর্যায়ের দিকে তাকাই, সেখানে ঘুরেফিরে আসে ম্যালেরিয়া প্রসঙ্গ। দুর্দমনীয় এই রোগ যে ঔপনিবেশিক সময়ে প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার সপক্ষে ভূরি-ভূরি লেখা আছে। মনে পড়ে যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সুবিখ্যাত খেদোক্তি: ‘রেতে মশা দিনে মাছি/ এই নিয়ে কলকাতায় আছি’। বাংলার বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস-নাটকেও ফিরে আসে ম্যালেরিয়ার প্রসঙ্গ। মনে করুন, টেনিদার নাটক ‘পরের উপকার করিও না’। সেখানে পরোপকারের নেশায় মত্ত টেনি মুখুজ্যে কুইনাইনের বোতল হাতে বাংলার গাঁয়ে গিয়ে লোককে জোর করে কুইনাইন খাওয়াতে শুরু করে। মজাচ্ছলে লেখা হলেও এই গল্পে বাংলার গঞ্জের প্রাচীন চিত্রটা ফুটে উঠেছিল। ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়ে যেত গ্রামের পর গ্রাম– সুচিকিৎসা নেই, প্রতিকার নেই, ম্যালেরিয়া আটকানোর কোনও পথ নেই। টেনিদার জোর করে কুইনাইন খাওয়ানো থেকে মনে পড়ে যায় সরকারি উদ্যোগের কথা: উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ার কয়েকবছর অবধি কুইনাইন একপ্রকার বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন দেব রায়-এর লেখা: লিক কুনাট্য রঙ্গে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………
‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’-এ এমন এক গ্রামের ছবি রচনা করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, যে গ্রামের ডোবায় কিলবিল করছে ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশার ঝাঁক। মৃণাল সেন সেই গল্পকে পর্দায় অনুবাদ করলেন যখন, জুড়ে দিলেন ম্যালেরিয়া হয়ে যামিনীর বংশ উজাড় হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। ঘনাদার ‘মশা’ গল্পেও যে ম্যালেরিয়া-আতঙ্ক উঁকি মেরে যায়নি, এমন জোর দিয়ে বলা যায় না। ১৮৮০ সালে ‘পাবলিক হেলথ কমিশনার অফ ইন্ডিয়া’ ভারতের একটি ম্যালেরিয়া-মানচিত্র প্রকাশ করে। তাতে দেখা যাচ্ছে, উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রায় গোটা ভারতেই কমবেশি ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল; সব থেকে বেশি ভুগেছে মধ্য এবং পূর্ব ভারত, যার মধ্যে রয়েছে অধুনা বাংলাদেশও। সেই সময়কার হিসেব মোতাবেক, ১৮০০ সাল থেকে ১৯২১ অবধি প্রায় দু’-কোটি মানুষ নিহত হয়েছেন ভারতে। ম্যালেরিয়া বরাবরই এ-দেশে ছিল, কিন্তু বাড়বাড়ন্তের কারণ হিসেবে অনেকে ব্রিটিশদেরই দায়ী করেন। ব্রিটিশরা রেলের বন্দোবস্ত করার সময়ে, সেচ-সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করার সময়ে নিকাশিব্যবস্থার দিকে তেমন মনোযোগ দেয়নি। এ-দেশের বেশিরভাগ অংশে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি এবং অবরে-সবরের বন্যার জল বেরনোর তেমন জায়গা থাকত না।
অতএব, সেই জমা জলে যুগপৎ রমরমিয়ে মশাদের বংশবৃদ্ধি এবং মনুষ্যকুল ধ্বংস হওয়া শুরু হল। ব্রিটিশ সরকার পড়ল ফাঁপরে। দেশের বিভিন্ন অংশে সরকারি প্রতিনিধিরা কাজ করছে, তারাও যে মশার উৎপাতে জেরবার! ১৮২০ সাল নাগাদ ফরাসি বিজ্ঞানীরা কুইনাইন আবিষ্কার করলেন, ব্রিটিশরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তবে, এখানে দুই উপনিবেশের মধ্যে শুরু হল দড়ি-টানাটানি। দক্ষিণ আমেরিকায় সিঙ্কোনা গাছের জঙ্গল– যে-গাছ এই মহার্ঘ্য ওষুধের উৎস– ছিল ওলন্দাজদের অধীনে। তারা তখন ওষুধের পরিবর্তে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতে শুরু করল। ব্রিটিশরা নিরুপায়। কাজেই, উপায় থাকলেও দু’টি সাম্রাজ্যের মধ্যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দড়ি টানাটানির ফলে প্রাণ গেল এই অভাগা দেশের বহু মানুষের– ইতিহাস এইসব ঘটনার নীরব সাক্ষী থেকে গিয়েছে। এর দীর্ঘ সময় পরে রোনাল্ড রস ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন, ১৮৯৭ সালের আগস্টে অ্যানোফিলিস মশা নিয়ে তাঁর কাজকর্ম ভবিষ্যতে ম্যালেরিয়া-গবেষণার কক্ষপথটিই পাল্টে দেয়। ১৮৯৮ সালে তাঁর গবেষণা থেকেই প্রথম জানা যায়, অ্যানোফিলিস মশাই হচ্ছে ম্যালেরিয়া রোগের বাহক।
প্রায় সওয়া দুশো বছর ধরে (ইতিহাসগতভাবে আরও বেশি অবশ্য) নীরব ঘাতকের মতো এ-দেশে উপদ্রব চালিয়ে গেছে মশা– একের পর এক লেখায়, রিপোর্টে ম্যালেরিয়ার ভয়াল পরিণতির কথা উল্লিখিত রয়েছে। ব্রিটিশ সরকার এ-দেশের ম্যালেরিয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত, প্রমাণ রয়েছে তারও। এ-ঘটনা খানিক পরিহাসেরই বটে। ব্রিটিশরা প্রায় দুই শতক ধরে এ-দেশের মানুষের রক্ত চুষে গেছে, তারই যেন প্রতিশোধ নিয়েছিল এখানকার খাল-বিলের মশারা। তারা আক্ষরিক অর্থেই রক্ত চুষে সরকারের শিরায়-ধমনীতে মশাতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছে।
চা-এর সঙ্গে ‘টা’ না-হলে বাঙালির চলে না। সেই ‘টা’ কখনও বিস্কুট, কখনও বাপুজী কেক। কখনও আবার স্রেফ পাউরুটি থেকে এক গাল মুড়ি। চা খেতে খেতে আড্ডা, রাজা-উজির মারা বাঙালির চিরকেলে অভ্যাস। চায়ের গেলাসে প্রথম চুমুকে বিপ্লবের শুরু, শেষ চুমুকে বিপ্লব অস্তমিত। মাঝেমাঝে যখন চায়ের আরেক রাউন্ড এসে যায় তখন বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয়।
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved