সময় বিশেষে মনে হয়, ভারত-ভূমিতে বিশ্বকাপ কভার করতে নেমে ম্যাচের পর ম্যাচ রোহিতের মায়া-ব্যাটিং দর্শন, অতুলনীয় অধিনায়কত্বে টানা দশ ম্যাচ জয়, দেশকে বিশ্বকাপ ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার চেয়েও অধিকতর প্রাপ্তি বোধহয় দেশনায়কের বেড়ে ওঠার দেবভূমি ছুঁয়ে আসা। মহেন্দ্র সিং ধোনির পর এমন ক্রিকেট তপস্বী আর আসেননি, যাঁর গায়ের তারকা জ্যোতিকে হারিয়ে এখনও মাটির বুনো গন্ধ বেরোয়।
‘মাম্মি, মাম্মি, পাপা কো বুলাও। ইন্টারভিউ কে লিয়ে জি ওয়ালে অউর স্টার ওয়ালে একসাথ আয়া!’
কদমছাঁট চুল, খাড়া কান আর তিড়িংবিড়িং লাফের যে অলপ্পেয়ে ছোঁড়া আমাদের এইমাত্র ফাঁসাল, খেয়ালে-বেখেয়ালে তার নামটাই জানা হয়নি! জানা হবেও না কোনও দিন। ভবিষ্যতে মুম্বই যদি বা যাইও, পশ্চিম বোরেভেলির গড়াই যদি বা ঘুরেও আসি, তস্য গলির ঘুপচি ঘরে আর কখনও যাওয়া হবে না কি? ওয়াংখেড়েতে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, ‘শর্মাজি কা বেটা’ ব্যাটিংয়ের নামে ‘বেহদ খুশবু’ ছড়াচ্ছেন, ক্রিকেট সাংবাদিকের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে একফাঁকে ভারত অধিনায়কের শৈশবের বাস্তুভিটে ঘুরে আসা।
তা, রোহিত শর্মার কোচের পিছন-পিছন তাঁর স্কুল-টুল ঘুরে সে পর্ব সমাধা যখন প্রায়, এক উৎসাহী উপযাজক সন্ধান দিলেন যে রাস্তার মোড় থেকে বাঁদিক গেলে রোহিতের কাকার বাড়ি পড়বে। ছোটবেলায় যে বাড়ি থেকে ‘অলস সম্রাট’ স্বামী বিবেকানন্দ স্কুলে নিত্য যাতায়াত করতেন। আনা-নেওয়া করতেন কাকা। ক্রিকেট তীর্থ করতে বেরিয়ে এহেন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা ছেড়ে দেওয়া ঘোর অনুচিত। তা, পেশাগত মিত্রকে নিয়ে খোঁজ চালিয়ে, পাড়ার বিচ্ছুদের পাকড়াও করে, বাড়ি একখানা খুঁজেও পাওয়া গেল বটে। কিন্তু কে জানত, বোরেভেলি জুড়ে অমন শ’য়ে-শ’য়ে কাকা রোহিত শর্মা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছেন! কেউ বড়া-পাও কাকা, কেউ ভেলপুরি কাকা, কেউ আবার ওই ছোট্ট ঘরের গর্বিত মালিক– ড্রাইভার কাকা!
নাও এবার, ঠেলা সামলাও। দশচক্রে ভগবান ভূতের মতো!
বাংলার দুই খবরওয়ালা পাকেচক্রে এখন ‘জি ওয়ালে’ আর ‘স্টার ওয়ালে’! এবং ‘ইন্টারভিউ কে লিয়ে একসাথ আয়া!’
বেশ বুঝতে পারছিলাম, বেকুব হয়েছি। এক কাকার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে আর এক কাকার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়েছি! রোহিত যে এককালে কাকার স্কুটার ছেড়ে স্কুল বাসও নিয়েছিলেন, জানব কী করে? মানে-মানে কেটে পড়ার আগেই দেখি, সরু সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন এক বিশালবপু, ফচকে ছেলের হাঁকডাক শুনে (যার মাথায় পরপর চাঁটি মেরে আর এক কিশোর ক্ষিপ্তভাবে বলছিল, তুমলোগ স্টার বন গ্যয়া), সাদর আপ্যায়নের আমন্ত্রণ নিয়ে। মহাশয় রোহিতের ড্রাইভার কাকা, যিনি জোড়া সাংবাদিকের ওজর-আপত্তিতে কর্ণপাত না করে এখন, এই মুহূর্তে একরত্তি রোহিতের সমস্ত কাহিনি শোনাতে চান! স্কুল বাসে সে কতটা ‘শরারতি’ করত, জানালার ধারে বসত না মাঝে, ক’বার গাল চুলকাত– সব এবং যথাযোগ্য ‘চায়-পানি’ সহযোগে!
সময় বিশেষে মনে হয়, ভারত-ভূমিতে বিশ্বকাপ কভার করতে নেমে ম্যাচের পর ম্যাচ রোহিতের মায়া-ব্যাটিং দর্শন, অতুলনীয় অধিনায়কত্বে টানা দশ ম্যাচ জয়, দেশকে বিশ্বকাপ ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার চেয়েও অধিকতর প্রাপ্তি বোধহয় দেশনায়কের বেড়ে ওঠার দেবভূমি ছুঁয়ে আসা। মহেন্দ্র সিং ধোনির পর এমন ক্রিকেট তপস্বী আর আসেননি, যাঁর গায়ের তারকা জ্যোতিকে হারিয়ে এখনও মাটির বুনো গন্ধ বেরোয়। বিরাট কোহলি নিজগুণে অবশ্যই বিরাট। কিন্তু তাঁর ব্যাটের ব্যারিটোনে, ক্রিকেটীয় আস্ফালনে, কোথাও গিয়ে একটা উচ্চবিত্ত ঠাঁটবাট আছে। রোহিতের মতো যত্রতত্র সারা শরীরে নিজের পুরনো মহল্লার অদৃশ্য জলছবি নিয়ে ঘোরা বিরাটের অভ্যেস নয়। তিনি বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে, এক গ্রহান্তরের ক্রিকেট বিগ্রহ, সময় থাকতে থাকতে দু’চোখ ভরে দেখে নিতে হয় যাঁকে, ভাল সিনেমা দেখার মতো। রোহিত সেখানে অনেক বেশি মানুষ-মানুষ, সাধারণের আয়ত্তের মধ্যে। ছোঁয়া যায় যাঁকে, আবদার করা যায় যাঁর কাছে। পৌনে তিনশো টাকার জন্য এক সময় যাঁর স্কুলে ভর্তি হওয়া আটকে যাচ্ছিল। যিনি আমিষ খাওয়ার তাড়নায় দৌড়োতেন কোচের বাড়িতে, বাড়ির নিরামিষ খাবারের হাত থেকে বাঁচতে। যাঁর ঈষৎ স্থুল শরীর, ভুলো মন, হেলেদুলে হাঁটা, জিমের বদলে জিভকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় নিজেকে। আজও।
নইলে পানের ছোপ ধরা লাল দাঁত কেনই বা ঝিকিয়ে উঠবে রোহিতের নাম শুনে (এঁর সঙ্গেও বোরেভেলির মহল্লাতেই আলাপ), কেনই বা সাংবাদিককে বলে বসবে, ‘উসকে সাথ বচপন মে তো হম ঘুমতে থে’। কেনই বা স্বামী বিবেকানন্দ স্কুলের বাসচালক বলে ফেলবেন, ‘উয়ো রোহিত শর্মা বননে কে বাদ ভি ম্যায় উসকে লিয়ে কাকা হি রহ গ্যয়া।’ কেনই বা কষদাঁতে খিদে লেগে থাকা বোরেভেলির খুদে নির্দ্বিধায় বলবে, ‘মুঝে ভি রোহিত ভাইয়া বননা হ্যায়।’ কেনই তাঁর কোচ দীনেশ লাড বলবেন, ‘বিশ্বজয়ী হলে স্কুলের গেট রোহিতের নামে করব। ও থাকবে সেদিন।’
বিশ্বজয়ী হননি রোহিত। কিন্তু হৃদয়জয়ী হয়েছেন নিশ্চিত। এবং সে অর্থে ভুবনজয়ীও।
সবার ওপরে আজও যে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই!