প্রচারের আলোয় পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরগুলো যখন ঝলমলে হয়ে ওঠে, ইতিহাসের তথ্য হিসাবে তা জিইয়ে থেকে যায় গণমনে। অথচ প্রত্যাখ্যান এবং তার প্রেক্ষিতের ইতিবৃত্ত তুলনায় রয়ে যায় অনালোচিত। ডায়েরির পাতায় নিভৃত কলমের আঁচড়ে সেই দাগটুকু কিন্তু থেকেই যায়।
ঋত্বিকের মতো বন্ধুর বোহেমিয়ান জীবনচর্চার অনিবার্য পরিণতির দৃষ্টান্ত তো ১৯৮৮-তে টাটকা স্মৃতির দগদগে ঘা। আর নিজের অভ্যন্তরের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি আরও জমাট বেঁধে উঠেছে তখন, সমস্যাসংকুল শরীরের তরফে দেওয়া বিবিধ ইঙ্গিতে। তাই প্রয়াণের বছর সাতেক আগে সলিল চৌধুরী ধূমপান বর্জনের উপলব্ধিতেই ক্রমশ জারিত হচ্ছেন।
“সেই মদ্যপানই ঋত্বিকের জীবনের অভিশাপ হয়ে দেখা দিল এবং আমার জীবনেরও বহু অমূল্য মুহূর্তের জলীয় সমাধি ঘটাল। ১৯৪৭ সাল থেকেই ঋত্বিক, মৃণাল (সেন) এবং আমি ছিলাম অবিচ্ছেদ্য বন্ধু।… উত্তর-জীবনে আমি আর ঋত্বিক দু’জনেই বয়ে গেলাম– মৃণালটাই কী করে জানি সচ্চরিত্র রয়ে গেল। মদ ছুঁল না জীবনে।…”
১৯৮৮-র জুন মাসের ২ তারিখে রাজ কাপুরের প্রয়াণের সংবাদ খবরের কাগজে পাঠের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যা লিখিত। ১৯৫৩-তে পরিচালক বিমল রায়ের আহ্বানে ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির সুরকার হিসাবে সলিলের প্রথমবার প্রবেশ বোম্বের বাণিজ্যিক সিনেমা জগতে। এবং তারপরেই ইন্ডাস্ট্রিতে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত পরিচালক-নায়ক রাজ কাপুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সূত্রপাত দু’জনের ‘কমনফ্রেন্ড’ পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জির মাধ্যমে।
১৯৪৩-এর নোটবইয়ের বিবর্ণ একটি পৃষ্ঠায় পাওয়া যাচ্ছে যৌবনের চৌকাঠে সদ্য পা-দেওয়া সলিল চৌধুরীর লেখালেখির এমন একটি ছোট্ট অংশ।
দেশীয় রাজনীতি-দুর্ভিক্ষ-আন্তর্জাতিক যুদ্ধ– সব মিলিয়ে সলিল-সুহৃদ মৃণাল সেনের ভাষায় যা ছিল এক ‘মেটামরফসিস’, তেমন ঘনঘটার ভেতর দিয়ে চোখ-কান খোলা রেখে সলিলেরও প্রহরবৃত্তের ঢেউয়ে সন্তরণ, জাপানি আগ্রাসনের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাও যেখানে সমমাত্রাতেই শামিল।
রবীন্দ্র-উত্তর পর্বের একদম গোড়ার দিকে শিল্প-সাহিত্যের সৃজনবোধে জারিত তরুণ বঙ্গমননে তাঁর মোহাচ্ছন্নতা একরকম স্বাভাবিক নিয়মেই এসে দাঁড়িয়েছিল। সলিল চৌধুরীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ‘পরমাত্মীয়’ মেনে ‘অশৌচ’ পালন হয়তো খানিক ব্যতিক্রমীই।
‘ভুল সবই ভুল’– গানটির ভেতর এক নীরব সন্ধ্যা আছে। কোনও শহরের ফাঁকা রাস্তায় একাকী পুরনো ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে ওঠে, আর তার নিচে একজন দাঁড়িয়ে থাকে নিজের হৃদয়ের ভুল ভুলে যাওয়ার চেষ্টা নিয়ে।
আজও যখন সেই ছবির গান বাজে, মনে হয় জেগে ওঠে জলের জীবন। ‘ও গঙ্গা’ শোনা মানে নদীর বুক ছুঁয়ে যাওয়া। যেন জীবনকেই ডাকছে এ-গান।
ক্রাইটেরিয়ান কালেকশন, জেনাস ফিল্মস এবং ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ডিজিটাল উপায়ে রিস্টোর করা ‘দো বিঘা জমিন’-এর প্রিমিয়ার হতে চলেছে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। সেই উপলক্ষেই এই বিশেষ নিবন্ধ।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved