হয়তো সর্বকালের সেরা বাঁ-হাতি স্পিনার তিনি, হেডলি ভ্যারিটি বা ডেরেক আন্ডারউডের মতো স্যাঁতসেঁতে পিচ বা বর্তমানের ভারতীয় স্পিনারদের মতো শুকনো খাটালে নয়। ছয় ও সাতের দশকের পাটা উইকেটেই বেদি কবিতা লিখে গেছেন তিনি। রানআপে হালকা দুলে দুলে এসে বাঁ-পাটিকে বোলিং ক্রিজের সমান্তরাল রাখা ডান-পা প্রথম স্লিপের দিকে, ডান হাতের কনুই মাথার সমান, তার আগের অংশ কবজি পর্যন্ত ধীরে ধীরে রাডারের মতো উঠছে, বাঁ-হাতের তালুতে বুড়ো আঙুল ছাড়া চার আঙুলের স্পর্শে মমতায় বলকে সিমের দিক থেকে জড়িয়ে আছে, গোখরোর ফণা।
এই গল্পটা একটা সময় নর্দাম্পটনশায়ারে প্রচলিত ছিল। ভারতে ফেরার সময় একটা ক্যানেল থেকে বিষাণ সিং বেদি দু’টি কুকুর নিয়ে ফিরেছিলেন। নাম রেখেছিলেন, ‘চার্লস’ ও ‘ডায়না’। হিথরো বিমানবন্দরে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের মুখে পড়েন, ‘আপনি কি আমাদের রাজতন্ত্রের খিল্লি করছেন!’ চটজলদি উত্তর দেন বিষাণ, ‘না, না, আমি ব্রিটিশ রাজকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি!’
ব্রিটিশরা ক্রিকেটকে ভারতে নিয়ে আসে। ক্রিকেটের ওপর অদ্ভুত রাজকীয়তা, সততা, শুদ্ধতার মোড়ক জুড়ে দেয়। জুড়ে দেয় ন্যায়-অন্যায়, রীতি-নীতি ইত্যাদি শব্দবন্ধনী। বানিয়ে দেয় ‘ভদ্রলোকের খেলা’।
ভদ্রলোক! শুধুমাত্র একটা শব্দ নয়, একটা সম্পূর্ণ যাপন, এক জীবন বোধ। সেই সাবেকি জীবন বোধ আর তাকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা এক তীব্র প্রতিরোধী বলয়। ব্রিটিশ রাজত্বে জন্মানো শেষ ভারতীয় অধিনায়ককে এক বাক্যে সংজ্ঞাত করতে গেলে উপরোক্ত বাক্যবন্ধনীটিই ব্যবহার করতে হয়।
ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটকে বাঁচানোর জন্য তিনি একবার নয়, দু’-দু’বার অধিনায়ক হিসাবে প্রতিবাদে মাঠ ছেড়ে চলে এসেছিলেন। প্রথমবার ১৯৭৬-এ জামাইকার সাবিনা পার্কে। সিরিজ ১-১ করে ফেলেছেন ভারতীয়রা। তার আগেই অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে লিলি- টমসনের পেস আক্রমণের সামনে ৫-১ স্কোরে নাস্তানাবুদ হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিজের অধিনায়কত্ব বাঁচাতেই বোধহয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড চার ফাস্ট বোলারকে লেলিয়ে দেন। বাউন্সারের বন্যা, উগ্র আক্রমণত্মক বোলিং। পেসাররা ব্যাটারের শরীর লক্ষ্য করে ক্রমাগত বোমা ছুড়ে চলেছেন। প্রথম ইনিংসে আহত হয়েছেন অংশুমান গায়কোয়াড় ও ব্রিজেশ প্যাটেল। দ্বিতীয় ইনিংসে মহিন্দার অমরনাথ বুক চিতিয়ে কিছুটা লড়ার পর যখন আউট হলেন তখন টেল এন্ডারদের বিরুদ্ধেও বোমাবর্ষণ বন্ধ করেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রতিবাদে অধিনায়ক বেদি তৃতীয় ইনিংসে মাত্র ১২ রানে এগিয়ে থাকা অবস্থায় পাঁচ উইকেট হাতে নিয়েই ইনিংসের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে দেন।
আরেকবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সীমিত ওভারের সিরিজ ১-১ করার পর শেষ ম্যাচে ভারত জয়ের থেকে মাত্র ২৩ রান দূরে। এই অবস্থায় সরফরাজ নওয়াজ পরপর চারটি বাউন্সার দেন যা মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। আম্পায়ার ওয়াইড ডাকেননি। প্রতিবাদে বেদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের জন্য, ম্যাচে ছেড়ে দেন। যেখানে খেলোয়াড়োচিত মনোভাব নেই, সেখানে বেদি খেলবেন না।
এভাবেই বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন বেদি, তাঁর অনমনীয় আপসহীন মনোভাবের জন্য। টনি গ্রেগের শেষ সিরিজে ভারতে ঘাম চোখের ওপর থেকে পড়া রোধ করার জন্য ইংরেজরা ভেসলিন প্যাচ কপালে লাগাচ্ছিলেন। সেই সিরিজে অভিষেককারী বাঁহাতি পেসার জন লিভারের বল মাত্রারিক্ত সুইং করায় বেদি বলে বসেন যে, অন্যায্যভাবে ভেসলিনের সাহায্য নিয়ে লিভার সুইং করাচ্ছেন।
১৯৭৮-’৭৯ পাকিস্তান সিরিজের পর অধিনায়কত্ব থেকে অপসারণও মেনে নিতে পারেননি। গাভাসকরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। পরে, ১৯৯০-এ গাভাসকারকে চিনতে না পেরে যখন লর্ডসের নিরাপত্তা কর্মী ঢুকতে না দিলে সারা পৃথিবী গাভাসকরের সমর্থনে দাঁড়ালেও বেদি বলেছিলেন, পরিচয়পত্র না নিয়ে গিয়ে ভুলটা সানিই করেছেন। অথচ নিজের প্রথম সন্তানের নাম রেখেছেন গাভাসিন্দর।
১৯৯০-এ লর্ডস টেস্টে টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্তকে দলের ম্যানেজার হিসাবে স্বচ্ছন্দে বলে দিয়েছেন যে, তাঁর সমর্থন ছিল না। নিউজিল্যান্ডে দল বাজে পারফর্ম করলে সমগ্র দলকেই প্রশান্ত মহাসাগরে নিক্ষেপ করতে চেয়েছেন।
মুরলীধরন বা শোয়েব বিরুদ্ধে বল ছোড়ার অভিযোগ বারবার তুলেছেন বিশুদ্ধবাদী বেদি। তেমনই টি-২০ ক্রিকেটকে হজম করতে পারেননি তিনি। আসলে আধুনিক ক্রিকেটকে বেদি গ্রহণ করতে পারেননি। টেস্ট ক্রিকেট, সাদা পোশাক, লাল বল, নান্দনিকতা। বিষাণ সিং বেদির পৃথিবীটাই সেপিয়ায় আঁকা ।
হয়তো সর্বকালের সেরা বাঁ-হাতি স্পিনার তিনি, হেডলি ভ্যারিটি বা ডেরেক আন্ডারউডের মতো স্যাঁতসেঁতে পিচ বা বর্তমানের ভারতীয় স্পিনারদের মতো শুকনো খাটালে নয়। ছয় ও সাতের দশকের পাটা উইকেটেই বেদি কবিতা লিখে গেছেন তিনি। রানআপে হালকা দুলে দুলে এসে বাঁ-পাটিকে বোলিং ক্রিজের সমান্তরাল রাখা ডান-পা প্রথম স্লিপের দিকে, ডান হাতের কনুই মাথার সমান, তার আগের অংশ কবজি পর্যন্ত ধীরে ধীরে রাডারের মতো উঠছে, বাঁ-হাতের তালুতে বুড়ো আঙুল ছাড়া চার আঙুলের স্পর্শে মমতায় বলকে সিমের দিক থেকে জড়িয়ে আছে, গোখরোর ফণা। সেই হাতটা ডান হাতের রাডারের সঙ্গে সঙ্গেই বুকের কাছ থেকে নিচে নেমে আবার সোজা কানের পাশ দিয়ে উঠে আসছে। বল হাত থেকে ছাড়ার পর ডান হাতের রাডার ডান জানু পেরিয়ে পিছনে ঠাঁই, বাঁ-হাত তার পিছে পিছে, কোমরের মোচড়। বল ব্যাটারের চোখের স্তরের ওপরে উঠেছে, তার উড়াল শুরু হয়েছে, ব্যাটার লোভে পড়ে এগিয়ে আসছেন। অদৃশ্য সুতোর টানে বলটিকে স্বাভাবিকের থেকে আগে ল্যান্ড করিয়ে তার পথ পরিবর্তন করিয়ে উইকেট কিপারের দস্তানায় আশ্রয় নেওয়ালেন বিষাণ। ক্রিজ থেকে দূরে ব্যাটার হতভম্ব, তাঁর প্রতিরোধ ভেঙে ফেলেছেন উইকেট কিপার বল দস্তানায় নিয়ে। এই হল বিষাণ বেদি, বিষাণ সিং বেদি। সয়ার গ্যারফিল্ড সোবার্স বলেছিলেন, ‘কোন অজানা কায়দায় বিষাণ বলের ওজন পালকের মতো করে দিতেন, ভেসে বেরিয়ে যেত ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে।’ সৈয়দ কিরমানি বলেছিলেন, ‘‘একই রকম গ্রিপে বিষাণ এক ওভারে ছ’রকম বল করতে পারতেন!’’ স্পিন চতুষ্টয়ে তাঁর সহযোদ্ধা এরাপল্লি প্রসন্ন বলেছিলেন, ‘আধুনিক ক্রিকেটের এক রকমের বল বিষেণ পারতেন না। বল লেগস্টাম্পের বাইরে ফেলা।’
বস্তুত নিয়ন্ত্রণের পরকাষ্ঠা ছিলেন তিনি। ঐতিহ্যবাহী ক্রিকেটের আজন্ম ধারকের নামে আজও কিন্তু নতুন জমানার সীমিত ওভারের ক্রিকেটের কৃপণতম বোলিং-এর রেকর্ড রয়ে গেছে।
বিষাণ সিং বেদি, ভারতে আগত প্রতিপক্ষ বা নিজের দেশের কেউ, নতুনদের সাহায্য করার জন্য তাঁর দরজা সবসময়ই খোলা ছিল। এইজন্য তিনি প্রেস, বিসিসিআই বা সতীর্থদের বিরাগভাজনও হয়েছেন। আবার ভারতীয় ক্রিকেটারদের কম ম্যাচ ফি নিয়ে সরবও হয়েছেন তিনি।
রাজকীয় খেলাটির রাজকীয় জমানার শেষ প্রতিভূ হিসাবে শেষ প্রতিবাদ করেন তিনি যখন দিল্লির ফিরজো শাহ কোটলার নামকরণ প্রয়াত প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির নামে করা হল। দিল্লি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনকে চিঠি দিয়ে কোটলার স্ট্যান্ড থেকে নিজের নাম সরিয়ে নেবার আর্জি রাখেন।
বিষাণ সিং বেদি, এক বিতর্কিত, মেরুদণ্ডযুক্ত, একলষেঁড়ে, অমিতপ্রতিভাধর শিল্পী। আধুনিক পৃথিবীতে যাঁরা অপ্রতুল।