হারকে হাবাস মন থেকে ঘৃণা করেন। আগেই বলেছি কথাটা। ২০২০-’২১-এ লিগে এবং টুর্নামেন্টের ফাইনালে আমরা মুম্বইয়ের কাছে হেরে গিয়েছিলাম। সেই মুম্বইকে গতকাল হারিয়ে লিগ-শিল্ড জিতল মোহনবাগান। শুধু ট্রফি জয় নয়, হাবাসের সাফল্যের মুকুটেও একটা পালক যোগ হল। মুম্বইয়ের কাছে ট্রফি হারের যে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছিলেন এতদিন, সেই ক্ষতেও প্রলেপ পড়ল।
অ্যান্তোনিও লোপেজ হাবাস কেমন কোচ?
স্প্যানিশ এই ফুটবল প্রশিক্ষকের সঙ্গে কাজ করার সূত্রে পথেঘাটে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডায় এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে বহুবার। ২০১৯ থেকে ২০২১– দু’মরশুম হাবাসের সহকারী হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছি মানুষটাকে। হাবাসের মতো দক্ষ কোচের সঙ্গে কাজ করাটা আমার কাছে নিঃসন্দেহে এক দারুণ অভিজ্ঞতা! ২০১৯-’২০-তে হাবাসের প্রশিক্ষণে এটিকে আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তার ঠিক পরের বছর কোভিড অতিমারির কারণে এক গভীর সংকটের মুখে পড়েছিল ভারতীয় ফুটবল। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আইএসএলের পুরো টুর্নামেন্ট হয়েছিল গোয়ায়। সেই সময়ে খুব কাছ থেকে মানুষ এবং প্রশিক্ষক হিসেবে হাবাসকে চিনতে ও বুঝতে সুবিধা হয়েছিল আমার।
প্রশিক্ষক হিসেবে হাবাস মাঠের মধ্যে একরকম মানুষ আর মাঠের বাইরে আরেক রকম। তাই যারা হাবাসকে টেকনিক্যাল এরিয়ায় দেখে তাদের হয়তো মনে হয়, হাবাস প্রচণ্ড রাগী ও বদমেজাজি। আর যারা ওঁর সঙ্গে মাঠের বাইরে মিশেছে, সময় কাটিয়েছে, তাদের কাছে হাবাস হাসিঠাট্টায় ভরা এক অন্য চরিত্র।
এখনকার সাংবাদিক ও ফুটবল বিশারদদের চোখে হাবাস খুবই রক্ষণশীল, মানে ডিফেন্সিভ কোচ। তিনি নাকি টিমের বেশি অ্যাটাকিং ফুটবল পছন্দ করেন না। অতি হিসেবি মানসিকতার, যে কি না বিশ্বাস করে– ‘আগে রক্ষণ সামলাও, পরে আক্রমণে যাও’। আমি বলি, তাই যদি হয়, তাহলে অন্যায়টা কোথায়! ওই দর্শন দিয়েই তো হাবাস নিজেকে ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে সফল বিদেশি কোচ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমার চোখে, হাবাস আসলে ভীষণ বাস্তববাদী এক ফুটবল প্রশিক্ষক। ফুটবলের পরিভাষায় বলতে গেলে, ‘নো ননসেন্স কোচ’। অনুশাসন আর অনুশীলন– এই দুটো ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কড়া, ঋজু স্বভাবের, বিশৃঙ্খলা বিন্দুমাত্র সহ্য করেন না। টিমের তথাকথিত স্টার-প্লেয়ারদের সামলাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ২০১৯-’২০ মরশুমে যেবার আমরা চেন্নাইয়িনকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই, সেবার এডু গার্সিয়া এবং জাভি হার্নান্ডেজকে প্রায়শই অদলবদল করে গেমটাইম দিতেন হাবাস। লিগের একটা ম্যাচে খেলা চলাকালীন এডুকে তুলে নেওয়ায় হাবাসের সিদ্ধান্তে ভীষণ বিরক্ত হয় স্প্যানিশ অ্যাটাকার। এডুর উষ্মা হাবাসের চোখ এড়িয়ে যায়নি, ব্যাপারটাকে মেনে নিতেও পারেনি। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও আলাদা করে ডেকে এডুকে ‘কড়া দাওয়াই’ দিতে দেখেছি অ্যান্তোনিও-কে। তাতে কাজও হয়েছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে এডু ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে নিজের আচরণের কারণে। তাই আমার মনে হয়, দলে অশান্তি থাকলে সাফল্য হওয়া কঠিন।
এই হাবাসকে সরিয়ে গতবার জুয়ান ফেরান্দোকে কোচ হিসেবে নিয়ে এসে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিল সবুজ-মেরুন টিম ম্যানেজমেন্ট। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। টিম আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আবার তেমনই ফেরান্দো ব্যর্থ হতেই চটজলদি অভিজ্ঞ হাবাসকে ফিরিয়ে এনে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিয়েছে ম্যানেজমেন্ট, সেটা সঞ্জীব গোয়েঙ্কার মস্তিষ্কপ্রসূত বলেই মনে করি। তাই আইএসএলের শিল্ড জয় কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। এটা সুপরিকল্পনার ফসল বলা চলে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ফিকরুর কথা নিশ্চয় ভুলে যাননি। সেই ‘অবাধ্য’ ফিকরুকে বসিয়ে কিন্তু দলকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন অ্যান্তোনিও হাবাস। আবার কীভাবে ছেলেদের ভিতর থেকে সেরাটা বের করে আনতে হয়। সেটাও খুব ভালো জানেন অ্যান্তোনিও। উদাহরণ চান? তাহলে লিস্টন কোলাসোকে দেখুন, বুঝতে পারবেন। ম্যাচে হয়তো খেলার গতি স্লথ হয়ে পড়েছে, বিপক্ষ অল্প অল্প করে নিয়ে নিচ্ছে ম্যাচের রাশ। সেই সময় দরকার একজন অ্যাটাকার, যিনি গতিতে ঝড় তুলবেন। দেখবেন, সেই পরিস্থিতি আগাম আঁচ করে হাবাস অনেকক্ষেত্রে নামিয়ে দিয়েছেন জেসন কামিংসকে। ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। এটাই ওঁর ‘স্পেশালিটি’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গুরুদায়িত্ব পাওয়ার পর আস্থার যোগ্য মর্যাদা কীভাবে রাখতে হয়, হাবাস খুব ভালো করে জানেন। দায়িত্ব নেওয়ার আগে স্টেডিয়ামে বসে সুপার কাপে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের কাছে হার দেখেছেন মোহনবাগানের। দায়িত্বে আসার পর প্রথমেই যে মাস্টারস্ট্রোক হাবাস দিয়েছেন, তা হল– হুগো বুমোসকে ছেঁটে ফেলে জনি কাউকোকে নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত, অভিষেক সূর্যবংশী ও কাউকো-কে তিনজন ডিফেন্ডারের সামনে রেখে দুই প্রান্তে লিস্টন ও মনবীর সিংকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন কোচ হাবাস। পাশাপাশি পেত্রাতোসের মতো কুশলী প্লেয়ারকে আরও খোলা মনে খেলার সুযোগ করে দিয়েছেন। এর ফলে মোহনবাগানের আক্রমণ যেমন ক্ষুরধার হয়েছে, তেমনই জমাট বেঁধেছে রক্ষণভাগ। দলের মধ্যে এই ভারসাম্যটাই বদলে দিয়েছে মোহনবাগানকে। পুরোটাই হাবাসের মস্তিষ্কপ্রসূত। আসলে স্প্যানিশ কোচ জানেন, কোন পরিস্থিতিতে টিমের কাকে দরকার। কাকে বসাতে হবে, কিংবা কাকে সুযোগ দিতে হবে।
ফিকরুর কথা নিশ্চয় ভুলে যাননি। সেই ‘অবাধ্য’ ফিকরুকে বসিয়ে কিন্তু দলকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন অ্যান্তোনিও হাবাস। আবার কীভাবে ছেলেদের ভিতর থেকে সেরাটা বের করে আনতে হয়। সেটাও খুব ভালো জানেন অ্যান্তোনিও। উদাহরণ চান? তাহলে লিস্টন কোলাসোকে দেখুন, বুঝতে পারবেন। ম্যাচে হয়তো খেলার গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে, বিপক্ষ অল্প অল্প করে নিয়ে নিচ্ছে ম্যাচের রাশ। সেই সময় দরকার একজন অ্যাটাকার, যিনি গতিতে ঝড় তুলবেন। দেখবেন, সেই পরিস্থিতি আগাম আঁচ করে হাবাস অনেক ক্ষেত্রে নামিয়ে দিয়েছেন জেসন কামিংসকে। ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। এটাই ওঁর ‘স্পেশালিটি’।
খেলায় হার-জিত থাকে। কিন্তু দেখেছি, হারটাকে কখনও হাবাস মেনে নিতে পারেন না। বিশেষ করে, একই দলের কাছে পরপর দু’বার হার তো কখনওই নয়। একজন সফল কোচের সাফল্যের চাবিকাঠি হল, তার ম্যাচরিডিং দক্ষতা এবং খেলার ওপর নিয়ন্ত্রণের নৈপুণ্য । কেউ জাদুকর নয়, যে জিয়নকাঠি ছোঁয়ালেই তা সোনায় পরিণত হবে। প্রশিক্ষণ হল নৈপুণ্য, প্রশিক্ষণ হল বিশ্বাস, সততা এবং অগাধ আস্থার প্রতিফলন। অ্যান্তোনিও লোপেজ হাবাস দক্ষিণ আফ্রিকায় কোচিং করিয়েছেন, বলিভিয়ার জাতীয় দলের প্রশিক্ষক ছিলেন, রাফা বেনিটেজের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী কোচের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। সেই অগাধ অভিজ্ঞতার ডালি নিয়েই তিনি ভারতের মাটিতে সফলতম বিদেশি কোচ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যারা তাঁকে রক্ষণাত্মক কোচের অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তাদের যথাযোগ্য জবাব দিয়েছেন প্রয়োজন সাপেক্ষে মোহনবাগানকে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলিয়ে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: বারপুজোয় সমর্থকদের ভালোবাসার হাত থেকে বাঁচতে দৌড় লাগিয়েছিলাম টেন্টের দিকে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এ-প্রসঙ্গে প্রয়াত পিকে অর্থাৎ প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে। ১৯৮২-তে একটা কথা বলেছিলেন, যা নিয়ে পত্রপত্রিকায় খুব চর্চা হত। প্রদীপদা বলেছিলেন, ‘চচ্চড়ির মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করা যায় না’। একদম ঠিক কথা। হাবাসও পরোক্ষে সেই কথা স্বীকার করে নিয়েছেন, তাঁর আস্তিনে এত ভালো ভালো আক্রমণাত্মক প্লেয়ার থাকার দরুনই তিনি দলটাকে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলাতে পেরেছেন। বলতে চেয়েছেন, দিনের শেষে খেলোয়াড়রাই আসল। তাদের সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে প্রয়োগ করাটাই হল কোচিং।
হারকে হাবাস মন থেকে ঘৃণা করেন। আগেই বলেছি কথাটা। ২০২০-’২১-এ লিগে এবং টুর্নামেন্টের ফাইনালে আমরা মুম্বইয়ের কাছে হেরে গিয়েছিলাম। সেই মুম্বইকে গতকাল হারিয়ে লিগ-শিল্ড জিতল মোহনবাগান। শুধু ট্রফি জয় নয়, হাবাসের সাফল্যের মুকুটেও একটা পালক যোগ হল। মুম্বইয়ের কাছে ট্রফি হারের যে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছিলেন এতদিন, সেই ক্ষতেও প্রলেপ পড়ল। আরও একটা ব্যাপার। বরাবর চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন হাবাস। মোহনবাগানের সামনে এবার আইএসএল ট্রফি জয়ের হাতছানি। অর্থাৎ ‘ডবল’। কোচ হিসেবে এর আগে সার্জিও লোবেরা ও দেস বাকিংহাম সেই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। হাবাসও মনেপ্রাণে চাইবেন, সাফল্যের সেই শৃঙ্গে পা রাখতে।
এত কিছুর পরেও একটা ব্যাপার মনে করিয়ে দিতে চাই, হাবাস যখন পুণে এফসির দায়িত্বে ছিলেন তখন কিন্তু তিনি সেই দলটাকে নিয়ে সাফল্য পাননি আইএসএলে। তাই দিনের শেষে, ‘অ্যা কোচ ইজ অ্যাজ গুড অ্যাজ হিজ প্লেয়ার্স’– কথাটা ষোলাআনা সত্যি।