সকাল থেকে একই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মিটিং রুমে একই আলোচনা চলছে। জনহিতকর এক প্রকল্পের কাজের রিপোর্ট বারবার করে পড়া হচ্ছে আর কর্তাব্যক্তিরা লাল পেন দিয়ে দাগিয়ে চলেছেন এপাতা-ওপাতা। এর মানে হল, রিপোর্টটি আবার লিখতে হবে, আবার মিটিং হবে। সকাল ও বিকেলে দুধ চা এবং কুকিজ-কাজু ইত্যাদি। লাঞ্চ ক্যান্টিনে কিংবা রাস্তার দোকানে। এরকমই এক মিটিংজর্জর দিনে পোস্ট লাঞ্চ সেশন। বাইরে হালকা রোদ। ভরা পেটে ঢুলুনি আসছে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ফ্রেশ এয়ারের জন্য কয়েকটি জানলা খুলে রাখা হয়েছে। বাঁদরটি সেই তালে একটি জানলার গ্রিল পাকড়ে বসে বোধহয় রগড় দেখছিল। হঠাৎ ফাঁক দিয়ে হাত (বা পা) বাড়িয়ে, জানলার পাশের টেবিলে রাখা একটি রিমোট নিয়ে চম্পট।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য় চৌধুরী
মিটিং করেছিলাম বটে এক বহুজাতিক সংস্থায়। ১২ ঘণ্টা লাগাতার। আর্থিক বছরের শেষে লাভ-ক্ষতির হিসেব নিকেশ আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অ্যানুয়াল অ্যাপ্রাইজাল। কে কত কাজ করেছে, সেই খতিয়ান দেখে (বা না-দেখেও) তাদের রেটিং দাও। আমরা কয়েকজন মেজবাবু। আমাদের রেটিং দেবেন বড়বাবুরা, সে অন্য মিটিং! যাই হোক, আমার মিটিং শুরু হল সকাল ন’টায়। মোবাইল থেকে লগইন করেছি, ভিডিও অফ করে, মিউট বাটন দাবিয়ে চান আর ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। তখন আমার শুধু শোনার কাজ। গাড়িতে অফিস যেতে যেতে দু’-একটা বক্তব্য পেশ করলাম। নিজের টিমের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ দেখতে হবে তো!
এরপর অফিসে গিয়ে ফোন ছেড়ে ভিডিও কনফারেন্সে জয়েন করলাম। কনফারেন্স রুমেই লাঞ্চ। এইসব দিনে খাওয়া-দাওয়া ভালো হয়। প্রকৃতির ডাকের জন্য মিনি ব্রেক ছাড়া আর কোনও সময়ই চেয়ার থেকে ওঠা যাবে না। কলকাতা, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি– সব একই সময়ে ছোট বাইরে করতে যাচ্ছে। বিবিধের মাঝে মহান মিলন। এইভাবে সময় গড়ায় এবং বোঝা যায়, আরও কয়েক ঘণ্টা চালাতে হবে। কারণ যাদের কাজে চিনি বা অন্তত মুখের আদলে, তাদের রেটিং ও ইনক্রিমেন্ট ঝটপট দেওয়া যাচ্ছে– ও মা, কী ভালো ছেলে বা মেয়ে, ফাটিয়ে দিয়েছে ইত্যাদি, কিন্তু যাদের চেনে না কেউ তাদের জন্যে এদিক-ওদিক ফোন করতে হচ্ছে। ফলে সময় লাগছে বেশ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। আবার গাড়িতে ওঠ। ভিসি থেকে মোবাইল। বাড়ি ফিরে মোবাইল থেকে ল্যাপটপ। মিটিং কিন্তু চলছে। যে ছেলে বা মেয়েদের কেউই ঠিক চিনে উঠতে পারল না তাদের একটা গড়পরতা রেটিং দেওয়া গেল। এরপর আসল খেল। ইনক্রিমেন্টের ধাক্কায় বাজেট বেড়ে যায়। তখন বাজেট ধরে নিচের দিকে নামতে হয়। এবং ইনক্রিমেন্ট কমে। ক্ষেত্রবিশেষে রেটিংয়ে হাত পড়ে। ডিনার চলাকালীন একটি চমৎকার বেল কার্ভ আঁকা হয়ে যায় যাতে যাবতীয় অঙ্ক মেলে– নরমালাইজেশন। ভেবেছিলাম নিশ্চিন্ত ঘুম হবে এই বারো ঘণ্টার ধকলের পর, বেশ গর্বিত একটা ভাবও এসেছিল মনে। হঠাৎ একটি ই-মেইলে সব ঘেঁটে যায়। এক অচেনা পাবলিক, যাকে এলেবেলে রেটিং দেওয়া হয়েছিল, সে এক ব্যাপক কাজ করে বসে আছে তার প্রজেক্টে। ক্লায়েন্ট ভূয়সি প্রশংসা করে মেইল পাঠিয়েছে তার বাবু-কে এবং তার বাবুর বাবুকে। ব্যস্… রেটিং-এ পরিবর্তন, বেল কার্ভ টালমাটাল। ইশ, এই পারফর্মারকে আমরা চিনতে পারিনি, ছি ছি, ইত্যাদি বলে আমরা আবার পরদিন ন’টায় মিটিং করার সিদ্ধান্ত নিই। হাই তুলতে তুলতে ভাবি হতচ্ছাড়া কাজ দেখানোর আর সময় পেল না! যত বাঁদরামি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ভেবেছিলাম নিশ্চিন্ত ঘুম হবে এই বারো ঘণ্টার ধকলের পর, বেশ গর্বিত একটা ভাবও এসেছিল মনে। হঠাৎ একটি ই-মেইলে সব ঘেঁটে যায়। এক অচেনা পাবলিক, যাকে এলেবেলে রেটিং দেওয়া হয়েছিল, সে এক ব্যাপক কাজ করে বসে আছে তার প্রজেক্টে। ক্লায়েন্ট ভূয়সি প্রশংসা করে মেইল পাঠিয়েছে তার বাবু-কে এবং তার বাবুর বাবুকে। ব্যস্… রেটিং-এ পরিবর্তন, বেল কার্ভ টালমাটাল। ইশ, এই পারফর্মারকে আমরা চিনতে পারিনি, ছি ছি, ইত্যাদি বলে আমরা আবার পরদিন ন’টায় মিটিং করার সিদ্ধান্ত নিই। হাই তুলতে তুলতে ভাবি হতচ্ছাড়া কাজ দেখানোর আর সময় পেল না!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এক সত্যিকারের বাঁদর অবিশ্যি কাজের কাজ করেছিল দিল্লিতে, এক সরকারি ভবনে, মিটিং চলাকালীন। সকাল থেকে একই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মিটিং রুমে একই আলোচনা চলছে। জনহিতকর এক প্রকল্পের কাজের রিপোর্ট বারবার করে পড়া হচ্ছে আর কর্তাব্যক্তিরা লাল পেন দিয়ে দাগিয়ে চলেছেন এপাতা-ওপাতা। এর মানে হল, রিপোর্টটি আবার লিখতে হবে, আবার মিটিং হবে। সকাল ও বিকেলে দুধ চা এবং কুকিজ-কাজু ইত্যাদি। লাঞ্চ ক্যান্টিনে কিংবা রাস্তার দোকানে। এরকমই এক মিটিং-জর্জর দিনে পোস্ট লাঞ্চ সেশন। বাইরে হালকা রোদ। ভরা পেটে ঢুলুনি আসছে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ফ্রেশ এয়ারের জন্য কয়েকটি জানলা খুলে রাখা হয়েছে। বাঁদরটি সেই তালে একটি জানলার গ্রিল পাকড়ে বসে বোধহয় রগড় দেখছিল। হঠাৎ ফাঁক দিয়ে হাত (বা পা) বাড়িয়ে, জানলার পাশের টেবিলে রাখা একটি রিমোট নিয়ে চম্পট। একেবারে গাছে। হইহই, ধর ধর। গাছে উঠে বাঁদরকে ধরতে আরেকটা বাঁদর-ই লাগে। তাকে পাওয়া গেল না। এদিকে কনফারেন্স রুমে মিটিং-এর মূল উদ্দেশ্যও গাছে উঠেছে। সরকার ও নাগরিকের মধ্যে সেতুবন্ধের জন্য যে প্রকল্পের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছিল এতক্ষণ, তার তাল কেটে গেছে। দিল্লিতে বাঁদরের উৎপাত কেন বেড়ে চলেছে এবং সেটা ঠেকাতে আশু কর্তব্য কী, সে ব্যাপারে তর্কাতর্কি শুরু হয়েছে। তবে বাঁদরের রিমোটে যে কোনও উৎসাহ নেই, তা কিছুক্ষণ পরই বোঝা গেল। সে একই পথে এসে যন্ত্রটি ঘরে ছুড়ে গাছে ফিরে গেল। এবার তাহলে মূল মিটিং-এ ফিরতে হয়। কিন্তু সবাই বেশ বিরক্ত। এক্ষেত্রেও ঠিক করা হল আধাখ্যাঁচড়া মিটিংটি পরের দিন আবার হবে। বাঁদরের এপিসোডটি ‘মিনিটস অব দ্য মিটিং’ থেকে বাদ দেওয়া হল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: ‘হেলথ ড্রিংক’ মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এই বাঁদরটির মতো বাইরে থেকে মিটিং দেখার ইচ্ছে অনেক দিন পুষে রেখেছি মনে। লকডাউন সেই সুযোগ এনে দিয়েছিল। তখন বিছানায় বসেই মিটিং করা যেত নির্দ্বিধায়। কানে ইয়ারফোন গুঁজে ভিডিও অন না করে যা ইচ্ছে করো। মাঝে মাঝে, ‘সাউন্ডস গ্রেট’ বা ‘আই এগ্রি’ বলে দিলেই হল। জানলা দিয়ে পাঁচিলের বাইরের গাছের দিকে খামোকা তাকিয়ে আছি এক বিকেলে। তখন, কাছেই এক লেকে বেড়াতে আসা, পরিযায়ী পাখিদের দেশে ফেরার সময়। লম্বা যাত্রার আগের কয়েকটি বিকেলে তারা ওই গাছে বসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেরে নিত। কিছুক্ষণ কিচিরমিচির চলার পরই কয়েকটা কাক এসে ডানা ঝাপটিয়ে তাদের ভাগিয়ে দিত। এটা যেন অলিখিত নিয়ম। অনেকটা ইউনাইটেড নেশন্স-এর মিটিংগুলোর মতো। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরা, ঝকমকে কিছু নেতা বা আমলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে বক্তব্য রেখে চলেছেন। টেবিলে চাপড় মারা হাততালিও জুটছে। মিটিং-এর শেষদিকে গুরুগম্ভীর রেজোলিউশন পরিবেশিত হবে, যেটা কোন বড়বাবু দেশ ভেটো দিয়ে উড়িয়ে দেবেন। তাঁরাই আবার পরদিন অন্য রেজোলিউশন পাড়বেন। সেটারও ভবিষ্যৎ একই। তবে ইতিহাসের স্বার্থে সেই মিটিংগুলোর মিনিটস যত্ন করে আর্কাইভ করা হবে। ওদিকে, ওই ঝাঁ-চকচকে ঠান্ডা ঘরের বাইরে কয়েকটা দেশ একে অপরের দিকে মিসাইল ছুড়ে যাবে বিন্দাস, দিন-রাতের হিসেব গুলিয়ে দিয়ে। হামাগুড়ি দেওয়া থেকে হাতে লাঠিঅলা মানুষ মরে ভূত হবে। তারাও মিটিং করবে নিশ্চিত। তবে আমাদের তাতে কিছু এসে যাবে না। কারণ, ভূতেদের মিটিং-এর মিনিটস লেখা হয় না।