‘গরম হাওয়া’ সময়ের দলিল। আক্রোশ ও মনুষ্যত্বহীনতার ছবি। যে ইতিহাস তৈরি হয় স্বৈরাচারের কাজে, সেই ইতিহাস অগোচরে থেকে যায়। তাদের বিপক্ষে যাবে এমন সময়কে তারা ইতিহাস থেকে মুছে দেয়। কিন্তু ‘গরম হওয়া’র মতো সিনেমা ডকুমেন্ট করে রাখে সময়কে। মনে হয় না, দেশভাগের বিষয় নিয়ে আর কোনও সিনেমা এই ছবির কাছে পৌঁছতে পেরেছে।
কিছু সিনেমা হয় উত্তপ্ত, যার তাপপ্রবাহ অনেকদূর অবধি পৌঁছয়, ভেতরে এসে আঘাত করে। সেই আঘাত আপনাকে কীভাবে আহত করবে, সেটা অবশ্য আপনার মস্তিষ্কের এবং হৃৎপিণ্ডের চরাচর ঠিক করে দেবে। আর আহত আপনি ঠিক করবেন আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে– নিথর থাকবেন, মাঠে নামবেন, না কলম ধরবেন, নাকি অন্য উপায়ে নিজের চিকিৎসা নিজে করবেন। এমএস সাথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ তেমনই এক সিনেমা। এই সিনেমা আজ ৫০ বছর পরে আপনাকে মানসিকভাবে কতটা আঘাত করবে, কীভাবে আপনি চিকিৎসা করাবেন– আদৌ করাবেন কি না সেই ভাবনায় একটু ফুঁ দেওয়া যাক।
‘গরম হওয়া’ ইসমত চুঘতাই-এর অপ্রকাশিত ছোটগল্প, কাইফি আজমি এবং সামা জাইদির চিত্রনাট্য, বাহাদুর খান-এর সংগীত, যিনি ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-র সংগীত পরিচালক। বলরাজ সাহানি, সেলিম মির্জা। এর আগে পাঞ্জাব ভাগ হওয়া নিয়ে ছবি তৈরি হলেও আগ্রার পটভূমিকায় দেশভাগের অভিঘাত নিয়ে ছবি হয়নি। আগ্রা, মূলত করাচি থেকে আসা হিন্দু ও মুসলিম অধ্যুষিত জায়গা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ, ১৯৪৮ সালে গান্ধীজি হত্যা, দেশজুড়ে তৈরি হওয়া এক ভয়াবহ পরিবেশে মুসলিমরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে লাগল লাহোর, করাচি। উল্লেখ্য, গরম হওয়াতে করাচি যাওয়ার কথাই বলা হয়েছে বারবার, লাহোর নয়। সেই আগ্রাতেই সেলিম মির্জা এবং ভাই হালিম মির্জা (দীননাথ জুটসি) এক জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থা চালায়। সেলিম মির্জার দুই ছেলের বড় ছেলে বাকার মির্জা (আবু সিয়ানি) তাকে ব্যবসায় সাহায্য করে আর ছোট ছেলে সিকান্দার মির্জা (ফারুক শেখ), চাকরির সন্ধানে ব্যস্ত থাকে। ফারুখ শেখ-এর এই ছবিতে আত্মপ্রকাশ। সেলিম মির্জার মেয়ে তার খুড়তুতো দাদা কাজিম (জামাল হাসমি), হালিম মির্জার ছেলের প্রেমে মজে থাকে। সেলিমের বৃদ্ধা মা (বদর বেগম) বংশের হাভেলিতে এককোণে পড়ে থাকলেও সেই হাভেলি তার প্রাণভোমরা, আর আছে সেলিমের স্ত্রী, এই পরিবার নিয়েই তৈরি ‘গরম হাওয়া’।
শিকড়ের টানে থেকে যাওয়ার লড়াই, অতীতকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই, পদে পদে মুসলিম হওয়ার বিপন্নতা, ভারতবর্ষে থাকা যাবে না পাকিস্তান চলে যেতে হবে– এই মানসিক দ্বন্দ্বে ভর করে এগিয়ে যেতে থাকে এই ছবি, সেখান থেকেই ৫০ বছর আগের ভারত আর আজকের ভারতবাসী হিসেবে অগ্রগতির দৌড়ে, অন্তত ধর্মীয় এবং সামাজিকভাবে অবিচ্ছেদ্য মিল– ছবিকে অন্য মাত্রা দেয়। পদে পদে প্রত্যাখ্যান বা বিশ্বাসঘাতকের তকমা নিয়ে গুটিয়ে আসা মানুষ লড়াই করে ভেতর থেকে শিকড় উপড়ে পাকিস্থান চলে যাওয়ার। কোথায় কতটা লড়াই লড়তে হবে– সেটাও অন্ধকারে থাকে।
কালকে যা নিজের ছিল, আজ তার প্রায় কিছুই নেই, ঠিক কতটা মানসিক শক্তি নিয়ে কীভাবে এগোলে আবার নিজের অধিকারে নিজের ভিটেতে থেকে যাওয়া যাবে– তার আভাস পাওয়া দুষ্কর। একে একে সব হারালে মন হার মেনে নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়। অতীত ধূসর হয়, ভবিষ্যৎ অন্ধকার লাগে। ভেতরের শক্তি নিঃশেষ হয়। তখন কেউ মেনে নিয়ে ছেড়ে চলে যায়, কেউ ধামাধারী দাসত্ব গ্রহণ করে। অল্প কেউ স্তিমিত শক্তি নিয়ে নতুন করে চেষ্টা করে। সেলিম মির্জা সেই চেষ্টাই করে।
সেলিম মির্জার মা বাড়ি ছেড়ে যেতে পারে না, খিলান, ঘর, বারান্দা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে, বাড়ি ছেড়ে গিয়ে প্রায় মৃত্যুর কোলে পৌঁছে গেলে তাকে আবার পুরনো বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। তখন সেই বাড়ি অন্য কারও, আজমানির (এ. কে. হাঙ্গেল)। সেলিমের বৃদ্ধা মার মৃত্যু হয় এখানে ফিরিয়ে আনার পরে। যেখানে শুধু ঘর ছাড়ার যন্ত্রণার কারণে মৃত্যু হয়, সেইখানে এক পরিবারের ভয় হতে থাকে, তাকে ঘর ছাড়া, দেশ ছাড়া হতে হবে, অথবা দেশে থেকে বারবার ধর্মের নামে প্রতারিত হওয়ার অমোঘ যন্ত্রণাকে সহ্য করে যেতে হবে, হয়তো আমৃত্যু। এই যন্ত্রণার বিস্তার ‘গরম হাওয়া’র পরতে পরতে। সেলিম মির্জার পরিবার থেকে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিকাঠামোর ভয়াবহতা, সেই ভয়াবহতায় এক মুসলিম পরিবারের শুধুমাত্র ধর্মের কারণে দৈনন্দিন সামাজিক যন্ত্রণাকে ‘হিউম্যান হরর ফিল্ম’ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
যেহেতু ধর্ম, যেহেতু লাহোর, করাচি, আগ্রা, লখনউ সেহেতু সেনসেশন, ফলে সিবিএফসি সার্টিফিকেট বাতিল। ছবি নাকি চরম সেনসেশন তৈরি করবে। দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ভেঙে পড়বে। কিন্তু তাও ‘গরম হাওয়া’কে আটকানো যায়নি। ইন্দিরা গান্ধীর বদান্যতায় আনকাট সেন্সর পেয়ে ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় এই সিনেমা। যদিও মুসলিম ভালো, হিন্দু খারাপ– এই সহজ ন্যারেটিভ নিয়ে ভাবতে হয়নি পরিচালক কিংবা দর্শককে।
এই ছবিতে কোনও ভিলেন নেই, কেউ খারাপ, কেউ ভালো নয়, সবাই পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বলরাজ সাহানি নিজে এসেছিলেন লাহোর থেকে আর এ. কে. হ্যাংগল ছিলেন কাশ্মীরি পণ্ডিত, স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি করাচিতে তিন বছর জেল খেটে ভারতে আসেন ১৯৪৯ সালে এবং সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন। এই দু’জনের যখন দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে এক অদ্ভুত রসায়ন এদের মধ্যে এসেছে– শান্তির, স্বস্তির।
‘গরম হাওয়া’ সময়ের দলিল। আক্রোশ ও মনুষ্যত্বহীনতার ছবি। যে ইতিহাস তৈরি হয় স্বৈরাচারের কাজে, সেই ইতিহাস অগোচরে থেকে যায়। তাদের বিপক্ষে যাবে এমন সময়কে তারা ইতিহাস থেকে মুছে দেয়। কিন্তু ‘গরম হওয়া’র মতো সিনেমা ডকুমেন্ট করে রাখে সময়কে। মনে হয় না, দেশভাগের বিষয় নিয়ে আর কোনও ছবি এই ছবির কাছে পৌঁছতে পেরেছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
যেহেতু ধর্ম, যেহেতু লাহোর, করাচি, আগ্রা, লখনউ সেহেতু সেনসেশন, ফলে সিবিএফসি সার্টিফিকেট বাতিল। ছবি নাকি চরম সেনসেশন তৈরি করবে। দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ভেঙে পড়বে। কিন্তু তাও ‘গরম হাওয়া’কে আটকানো যায়নি। ইন্দিরা গান্ধীর বদান্যতায় আনকাট সেন্সর পেয়ে ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় এই সিনেমা। যদিও মুসলিম ভালো, হিন্দু খারাপ– এই সহজ ন্যারেটিভ নিয়ে ভাবতে হয়নি পরিচালক কিংবা দর্শককে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সেলিম মির্জা ব্যবসা থেকে শুরু করে পরিবার সমস্ত দিক থেকে বিপর্যস্ত একজন মানুষ। দু’বার প্রেমে ব্যর্থ হওয়া সেলিম মির্জার মেয়ে আমিনা মির্জা (গীতা সিদ্ধার্থ) চরম পথ বেছে নেয়। যে দু’জনের প্রেমে সে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিল, তারা দু’জনেই তার কাকার ছেলে, অর্থাৎ ইন্সেস্টিয়াল সম্পর্কের মাধ্যমে হয়তো ধর্মীয় গোঁড়ামির একটা বার্তাও ছবিতে কোথাও ধরা দেয়। সেলিমের মেয়ের হয়তো বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। সে যাই হোক, আমিনার ওই পরিণতি সহ্য করতে হয় সেলিম আর তার স্ত্রীকে। বড় ছেলে জীবনের সঙ্গে আর আপস না করে চলে যায় পাকিস্তান। ছোট ছেলে সিকান্দার কোনওভাবেই চাকরি জোগাড় করতে পারেন না। উল্লেখযোগ্য, সেলিমের পোশাক সম্পূর্ণ উর্দু ঘরানার হলেও, সিকান্দারের পোশাক সাহেবি।
শেষপর্যন্ত নিঃসঙ্গ হয়ে সেলিম ও তার ছোট ছেলে আর স্ত্রী-কে নিয়ে করাচি আসবে, ঠিক করে। কিন্তু পথে দেখা যায়, মুসলিমদের ওপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ রাস্তা জুড়ে। নেমে পড়ে সিকান্দার, নেমে পড়ে সেলিম, মিশে যায় প্রতিবাদে। প্রতিবাদ করে পরিচালকের বা গল্পকারের চরিত্ররা, দিনের পর দিন তৈরি হওয়া মানসিক যন্ত্রণা থেকে প্রতিবাদে পা মেলানো অবধি গল্পের ব্যাপ্তি। কিন্তু বাস্তবে জীবন হয়তো সেই প্রতিবাদের ভরসা বা সুযোগ পায় না, সেলিম মির্জারা হয় আত্মহত্যা করে, নইলে মারা যায় বা দাসত্ব গ্রহণ করে। হাজার হাজার অজানা, অচেনা ঘটনা জীবনকে তলিয়ে দেয়, সেই জীবন প্রতিবাদের সীমানা অবধি আসতে পারে না, সিনেমায় আসতে পারে, পরিচালক নিয়ে আসেন বলে। হয়তো বাস্তবেও কেউ কেউ আসেন। তবুও…
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: বিপুল মহানগরীর বুকে শান্তির খোঁজে ঘুরে বেড়ায় কত নিঃসঙ্গ মারিয়া আর অ্যালবার্টের দল
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দেশ বা রাষ্ট্র কখন নিজের হয়, সেইখানে জন্মালে? অথবা পূর্বপুরুষের ভিটে বা জন্মানোর রেকর্ড থাকলে? নাকি যে বাড়িতে রোজ তালা দিয়ে বেরিয়ে এসে আবার রাত্রে তালা খুলে ঢুকে আস্তানার প্রমাণ রাখতে হয় তার জোরে? উত্তর সোজা হলেও জানা যায় না, বা খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশ আমায় সীমানা নির্দেশ করে দেয়, কতদূর গেলে আমার পাসপোর্ট লাগবে অথবা লাগবে না। তাই কাজিম যে সেলিম মির্জার মেয়ের প্রথম প্রেমিক, পাকিস্থান থেকে আবার আগ্রায় আসে সেলিমের মেয়েকে দেওয়া কথা রাখতে, বিয়ে করতে, কিন্তু কথা রাখার আগে পুলিশের হাতে পড়তে হয় তাকে, পাসপোর্ট নেই বলে। অথচ কাজিম তো এখানেই ছিল, এটাই তো তার দেশ ছিল, অন্তত সে তো তাই জানত। কিন্তু সেইদিন সে জেনেছিল সে এখন শত্রুপক্ষে দেশের বাসিন্দা। কোনও দোষ না করে, কোনও বিশ্বাসঘাতকতা না করেও কাজিম সেইদিনই হারিয়ে গিয়েছিল বরাবরের জন্য। তার খবর কেউ নেয়নি আর।
‘গরম হওয়া’র প্রাসঙ্গিকতা এরপরে আলাদা ভাবে বলাটা বোকামি। ধর্ম মাত্রই ফ্যানাটিক কিছু মানুষের আঁতুর, আর এদের থেকে বাড়তেই থাকে ফ্যানাটিসম, যার উৎস ধর্মান্ধতা, কিন্তু সত্যিই কি ধর্মান্ধতা নাকি মানসিক বিকারগ্রস্ত কিছু মানুষ আর সত্যি কিছু ধর্মান্ধ মানুষের হাতিয়ার হয়ে ওঠে এই ধর্ম?
রাষ্ট্রের নেতা-নেত্রীদের কাজ হল, দেশের fundamentalist এবং ফ্যানটিদের থেকে দেশ, ঘর, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের একটা দূরত্ব রেখে অশান্তির পরিবেশ অর্থাৎ ‘ডিগ্রি অফ ক্যাওস’ কমানো। সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ ধর্মীয় বা বিধর্মী নিশ্চিন্তে যাতে কারুর ক্ষতি না করে থাকতে পারে, সেই দায় বর্তায় রাষ্ট্র সঞ্চালকের। কিন্তু সেটাই যখন কারওর অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়, তখন দুর্মতি, মাসেল পাওয়ার, হিংস্রতা, পাশবিকতা একসঙ্গে ওপরে উঠে আসে। তৈরি হয় সভ্যতা সংকট। হাজার হাজার মিত্র, মুখার্জি, ডি’সুজা, মির্জা, খান, সিং-রা আতান্তরে পড়েন। নিজের শিকড় জমে ওঠা বাড়িতে শেষবারের মতো তালা লাগিয়ে দিতে হয় নইলে চোখের সামনে পুড়ে যেতে দেখতে হয়। ৫০ বছর আগে হয়ে যাওয়া এক সিনেমার পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি নিন্দনীয়, যন্ত্রণার। তবু ভরসা থাকে এবং সথ্যু এখনও বলেন, ভারতীয় সেকুলার গঠনতন্ত্রের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায়। নিশ্চয়ই যায়…
তবু অশান্তি, তবু দুঃখ, তবু ধর্ম জাগে। টেকনোলজি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, একইসঙ্গে তাল মেলাচ্ছে ধর্মান্ধতা, দূরত্ব বাড়ছে উচ্চবিত্ত নিম্নবিত্তের মধ্যে, ধর্মীয় গোঁড়ামি সেই অবধি সীমাবদ্ধ নয়। এই দূরত্বে যে পার্থক্যের সৃষ্টি হচ্ছে, তা এমন জায়গায় যাচ্ছে যে বিপন্ন মানুষ কোনও একটা দোহাই দিয়ে নিজের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে চাইছে, কিছু হলেই অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসছে। মানুষ মানুষকে চিহ্নিত করছে তার পোশাকে, তার খাবারে, তার বহিরাভূষণে। চরম অশিক্ষিতরা সামাজিক পাঠ পড়াচ্ছেন পণ্ডিতকে। অর্থাৎ, আমাকে দখল করতে হবে আমার আইডেন্টিটি। সেখানে আমি কাকে কী বলছি, সেটা আর মুখ্য থাকে না, আমিত্ব সর্বস্ব হয়ে ওঠে। ধর্মই হয়ে ওঠে এখানে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেই পার্থক্য একটা সীমা অতিক্রম করলে ইলেকট্রিক স্পার্ক তৈরি হয়, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই, সেই স্পার্ক হল– লুম্পেন রাজের দৌরাত্ম্যের লাইসেন্স।অশিক্ষা যেখানে পৌঁছয় অথবা যে অন্ধকারে নামে, শিক্ষা তার ধারে কাছে পৌঁছতে পারে না।
সারা ছবি জুড়ে পাকিস্তানের উল্লেখ থাকলেও পাকিস্থানকে কোথাও দেখা যায় না। যেমন দেখা যায় না, প্রায়ই উল্টোদিকে কে কথা বলছেন সিনেমায়। যেখানে আমরা ডাবল পার্সপেক্টিভ দেখি, এখানে সেটা সিঙ্গেল। পিএনবি-তে (পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক) যখন সেলিম মির্জা লোনের জন্য যান, বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে লোন দেওয়া হবে না জানতে পারেন, এই সময় যিনি কথাটা সেলিম মির্জাকে জানান, তাকে দেখা যায় না। এইরকম সিঙ্গেল পার্সপেক্টিভ মাঝে-মধ্যেই এসেছে সিনেমায়। সেলিমের দ্বিতীয় বাসস্থানের ফাঁকা জায়গায় কয়েদখানার মত রড দিয়ে প্রথম আর দ্বিতীয় তলা ভাগ করা, প্রায়ই ক্যামেরা উঁকি দিয়ে গেলে ওই মানুষগুলোকে যেন কয়েদখানায় আটক বলে মনে হয়।
একদিকে সেলিমের ভারতবর্ষ না ছাড়ার লড়াই, উল্টো দিকে নিজেকে বাঁচাতে সেলিমের দাদা যিনি মুসলিম লিগের কর্ণধার, হালিম মির্জার পরিবার নিয়ে পাকিস্তান চলে যাবার সুবিধাবাদী মানসিকতা, প্রচুর চেনা এখনকার সময়ের কথা বলে, অর্থাৎ পরিচালকের নিউট্রালিটি প্রমাণ হয় এই চরিত্রের মাধ্যমে। মুসলিম সমাজ যখন দ্বিধা বিভক্ত, যেখানে নিজেরাও fundamentalism-এর দায় অস্বীকার করতে পারে না, তখন তাদের স্থাপত্য তুলে ধরে ব্যবহার করেন ফতেপুর সিক্রি, তাজ মহলের মত শিল্প। ব্যাকগ্রাউন্ডে চলে চমৎকার কাওয়ালি ‘মৌলা সেলিম চিস্তি’ কাইফি আজমির-এর লেখা, ওয়ারসি ব্রাদার্স-এর গাওয়া। প্রমাণ হয় তাদের হাজার বছরের অস্তিত্ব। স্থাপত্যে,সংস্কৃতি– আবহমান।
বলরাজ সাহানির যন্ত্রণার তীব্রতা যেমন আছে, আবার আছে ইস্পাত কঠিন মানসিকতা ও যুক্তিহীন ভাবনাও, যা কিছুই ঘটুক না কেন আল্লা দেখে নেবেন এর মতো। এগুলো মিলিয়ে সাংঘাতিক বিশ্বাস যোগ্যতা তৈরি করেছিলেন এমএস সাথ্যু, প্রতিটি চরিত্র স্বাভাবিকভাবে ধূসর, বড্ড বাস্তব।
বড় ছেলে বাবার অন্ধ বিশ্বাসের ওপর আঘাত এনে যুগের প্রয়োজনে বিশ্বাসের, কাজের পরিবর্তন আনতে বলে, কিন্তু বাবা মানতে পারে না। এই মানসিকতার জন্য ব্যবসায় বড় ডামাডোল তৈরি হয়, ব্যবসা প্রায় বন্ধের জায়গায় চলে যায়, সেলিম মির্জাকে নিজে বেরতে হয় জুতো বিক্রির জন্য, সেখানেও রাস্তায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্থানের চর হিসেবে। প্রায় শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে যায় মির্জা পরিবারের লড়াই করার মানসিকতায়।
সময় পছন্দ হোক বা না হোক, তার নিজস্ব গতি বা ছন্দ থাকে। সেই ছন্দ কেটে যায়, গতি শ্লথ হয়ে যায় সময়ের, আবার ঝড় আসে, সেইখানে নিজেকে সামলে চলাই জীবন, বাঁধা হয়ে অথবা সুবিধে হয়ে দাঁড়ায় ছোট থেকে পাওয়া শিক্ষা, ধর্মশিক্ষা, প্রগতির শিক্ষা, মনের শিক্ষা। লড়াই চলে অভাবে সঙ্গেও।
প্রাচুর্য মানুষকে ভাঙে অথবা উত্তীর্ণ করে। সংখ্যালঘু হলে ক্রমাগত দলগতভাবে আঘাত পেতে থাকলে, নিজের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে যে শব্দ বারবার মাথায় ঘুরপাক খায়, তা হল– প্রতিবাদ আর বিপ্লব। শয়তান যেমন সংখ্যায় বাড়ে, প্রতিবাদও বাড়ে, তাই একদিন বিশাল সাম্রাজ্যও ভেঙে পড়ে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা ফকির হয়, নায়কের ওপর থেকে আলো সরে যায়। কাল কার ভবিষ্যৎ অন্ধকার সেটাও বলা যায় না, তবে অভিঘাত বা আক্রমণ এমনই অতর্কিতে হয় যে, সাবধান হওয়াই ভালো। রক্ত ঝরবে, দুঃখ হবে, মৃত্যুও আসবে। তবুও বিশ্বাস বেঁচে থাকবে, স্বপ্ন তৈরি হবে।
তবু অনন্ত জাগবে।