বেশ কিছুকাল ধরেই টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার কথাটা আমরা শুনেছি। আমরাও আমাদের অযোগ্য ছেলেপুলের জন্য দালাল খোঁজার চেষ্টা করেছি। জমি বিক্রি করে, ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে ঘুষের টাকা জোগাড় করেছি আমরাই। যারা টাকা জোগাড় করতে পারেননি চাকরির অপেক্ষায় বসে না থেকে তাঁতের শাড়ি বিক্রি করছেন বলে তাদের বাহবা দিয়েছি। এই প্রশ্নটা আমাদের মনের ভিতর আসেনি তিনি বাংলায় বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান যা নিয়েই স্নাতকোত্তর করুন, সেটা শাড়ি বা ফুল বিক্রির জন্য নয়।
সবে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হল। যথারীতি বিভিন্ন স্কুলের মাঠে ও বাইরে অকাল হোলি খেলা থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের লাফ দিয়ে ওঠার উল্লাস মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। অনুপ্রেরণামূলক খবর হিসেবে রাজমিস্ত্রি, হকার, ফুটপাতের ফল বিক্রেতা, ছয় বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে সন্তানকে বড় করা প্রান্তিক জীবনের অভিভাবকদের এবং তাদের মুখ উজ্জ্বল করা ছেলেমেয়েদের সহাস্য ছবিতে খবরের কাগজ, সোশাল মিডিয়া ভরে গেল আগের মতোই। ক্রমে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হলেও আরও জোরদার হবে সাফল্য ও আগামী ভবিষ্যতের আলো-মাখা মুখগুলোর গল্প। কেউ হতে চাইবে ডাক্তার, নিজের প্রত্যন্ত এলাকায় ভবিষ্যতে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে দশের কাজে লাগতে চায়। সারা বছর শাড়ি-সালোয়ার-প্যান্ট গুটিয়ে জলধারা, ঝোরা পেরিয়ে স্কুল যেতে হয়েছে যাদের, বর্ষায় আদৌ যেতে পারেনি স্কুলে, সেই নিজের শহর ঘেঁষা গ্রামীণ অঞ্চলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ব্রিজ বানাতে চায় কেউ, কেউ আইআইটি-র শ্রেষ্ঠ স্বপ্নে বিভোর।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
অবশ্যই বাংলা মাধ্যমের অভাবী পরিবারের অতি মেধাবীর পাশে কেউ না কেউ দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু তারপরের স্তরের মেধাবীরা আর সে সুযোগ পাচ্ছে না। ক্যাপিটেশন ফি, ম্যানেজমেন্ট কোটা এখন প্রকাশ্য। নেতা ও প্রভাবশালীদের ছেলে-মেয়ে নিকটাত্মীয়ের ভালো জায়গায় সুযোগ পাওয়া নিয়ে আর কোনও লুকোছাপা নেই। সেখানে সামান্য অর্থ উপার্জনকারী পরিবারের ছেলেপুলেরা লড়বে কীভাবে? আমি রাজ্য হিসেবে খানিকটা লিখলেও সর্বভারতীয় স্তরে এই সমস্যাটি প্রবলভাবে শুরু হয়েছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই অবধি সব সুখ ও আশার গল্প। যে অভিভাবক সারা জীবন তথাকথিত নিচু কাজের গ্লানিতে ভুগেছেন, তিনিও সন্তানের সাফল্যে ফুল-মালা গলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাবুর বাড়ির ছেলে সারাদিন আড্ডা, ফোনে ও বায়নায় ব্যস্ত। কাজের মাসি নিজের মেয়েটির দশে দশ রেজাল্ট দাদা-বউদিকে দেখালেন। ফাটা কাপে সুস্বাদু চায়ের বদলে আজ তার পরিষ্কার প্লেটে মিষ্টি পাওয়ার কথা। উপরি পাওনা বৌদির ঈর্ষাতুর ম্লানমুখ। এর ক’দিন পরেই বেরবে সর্বভারতীয় ইংরেজি বোর্ড ও আরেকটি ইংরেজি বোর্ডের ফলাফল। তারপর সংখ্যাগুরুর আশার ধন জয়েন্ট এন্ট্রান্স ইত্যাদি। ওই মনিব বাড়ির দাদা-বউদিদের ছেলে-মেয়ের রেজাল্ট এই দু’টি বোর্ডের কোনওটার মধ্যে পড়বে। ধরে নেওয়া যাক, কাজের মাসির মেয়ের চেয়ে সে ফলাফল ঢের খারাপই হবে। কিছু বছর আগে হলে এখান থেকে একটা সামাজিক ন্যায়ের কাহিনি শুরু হত।
ডাব বিক্রেতার ছেলেটি জয়েন্টে ভালো স্থান পেয়ে ভর্তি হত সরকারি মেডিকেল কলেজে। কম নম্বর পেলে অবস্থাপন্ন গৃহকর্তার সন্তানটির ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সাধটি অপূর্ণই থেকে যেত। কারণ তখন গুটিকয়েক সরকারি কলেজ ছাড়া অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি কলেজে পড়ার ব্যবস্থা ছিল না। শুধুমাত্র মেধার জোরে নিম্নবিত্ত তার শ্রেণি বদলে ফেলতে পারত। এখনকার মতো তলার দিকে ঠাঁই পেয়ে অর্থের বিনিময়ে রোগীর নাড়ি টেপার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারা যেত না। আর এখন সচ্ছল গিন্নি-কর্তা, পুত্র-কন্যার রেজাল্ট নিয়ে ভাবিত নন আদৌ। মাঝারি অর্থ জোগাড় হলেই সন্তান ইউক্রেন থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে নিদেনপক্ষে বাংলাদেশ গিয়ে ডিগ্রি নিয়ে আসবে। অতি অবস্থাপন্নরা আমেরিকা-ইউরোপ থেকে পড়িয়ে আনবে সন্তানদের। সেটি আগে ব্যবসায়ীরা ভাবতে পারলেও এখন চাকুরীজীবী দম্পতিরা অনেক সময় লোন নিয়ে এই অসাধ্য সাধন করছেন। তাহলে মোদ্দা কথা দাঁড়াল এই, একদিকে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মেধাবী ও কম মেধাবী ছেলেমেয়েদের নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, মেধা দিয়ে সম্ভব না হলে অর্থ দিয়ে নিজের ছেলেমেয়েদের জীবন মসৃণ করে ফেলা। স্পষ্টতই দাঁড়িপাল্লায় মাপলে দু’দিকে কোনও ভারসাম্য নেই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক ইস্তাহারে পরিবেশ কেন ব্রাত্য?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অবশ্যই বাংলা মাধ্যমের অভাবী পরিবারের অতি মেধাবীর পাশে কেউ না কেউ দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু তারপরের স্তরের মেধাবীরা আর সে সুযোগ পাচ্ছে না। ক্যাপিটেশন ফি, ম্যানেজমেন্ট কোটা এখন প্রকাশ্য। নেতা ও প্রভাবশালীদের ছেলে-মেয়ে নিকটাত্মীয়ের ভালো জায়গায় সুযোগ পাওয়া নিয়ে আর কোনও লুকোছাপা নেই। সেখানে সামান্য অর্থ উপার্জনকারী পরিবারের ছেলেপুলেরা লড়বে কীভাবে? আমি রাজ্য হিসেবে খানিকটা লিখলেও সর্বভারতীয় স্তরে এই সমস্যাটি প্রবলভাবে শুরু হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কেভিপিআই নামে পরীক্ষাটির কথা বলতে পারি। সর্বভারতীয় এই পরীক্ষাটি দিয়ে স্কলারশিপ পেয়ে ফিজিক্স নিয়ে পড়া যেত। গত দু’বছর সেটিও বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। চালু থাকবে হয়তো অন্য পথে, যেখানে এই স্কলারশিপটা উঠে যাবে। বিজ্ঞান গবেষণায় কেন্দ্রীয় অনুদান যে কমছে, তা আমরা অল্পবিস্তার জানি। শিক্ষা ক্রমশ প্রয়োজনের মান বিচারে অগ্রাধিকারের স্তরে থাকছে না, নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এই যে বিপুল পরিমাণে বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের ভালো রেজাল্ট করে পাশ করে আসা কথাটায় বার বার আমি এই ‘ভালো’ শব্দটার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি, সেটা এই কারণে যে, আমাদের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে নম্বর পাওয়াটাই মূলত জ্ঞানের মাপকাঠি। একটা সময় অবধি স্কুল সার্ভিস, কলেজ সার্ভিসে বাংলা মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীদের বড় অংশ যোগ্যতা ও মেধার মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারত। ২০০৯-’১০-এ শুনেছি বাংলার চাকরি বেশি বলে কোথাও সিট খালি থাকত না। এমনকী, বিহার ঝাড়খণ্ডের কিছু কিছু কলেজেও বাংলা অনার্সে ভিড় উপচে পড়ত। চাকরির একটা প্রবহমানতা, না হোক সে উচ্চ গৌরবের ইউপিএসসি বা গেজেটেড অফিসার– হাজারে হাজারে বাংলা মাধ্যম স্কুলের চাকরি সাধারণ ঘরের মেধাবীদের জীবন বদলে দিচ্ছিল।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় দুর্নীতি নেমে এল, যা আমাদের চোখের চামড়াটুকু অবধি তুলে নিল। টাকার বিনিময়ে সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়ে গেল হাজারে হাজারে ভুয়া ও অযোগ্য শিক্ষক। জল গড়াল অনেক। ২২ এপ্রিল কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে স্কুলে বাতিল হয়ে গেল ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি। এর আগে নিয়োগ দুর্নীতি মামলা চলাকালীন এসএসসি ৫২৫০ জন অযোগ্যের একটা তালিকা আদালতের কাছে জমা দিয়েছিল। অর্থাৎ, তাদের কাছে একটা তালিকা ছিল। যদি সেটা মেনে নিতেন তারা তাহলে ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের পুরো প্যানেল বাতিলের প্রয়োজন হত না। এখন আবার এর মধ্যে বিরুদ্ধ দল ঢুকে পড়ায় তড়িঘড়ি এসএসসি-র চেয়ারম্যান বলছেন, যোগ্য-অযোগ্যদের বিভাজন সম্ভব। এই যে একটা বিচিত্র হ-য-ব-র ল অবস্থা তৈরি হয়েছে, কে আসল কে নকল– পুরোটা গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, এর ভিতরে যোগ্যতাসম্পন্ন ,পরীক্ষায় পাস করা বিপুলসংখ্যক শিক্ষকরা পড়বেন কেন? পড়লেন এই কারণে যে বেশ কিছুদিন ধরেই শিক্ষাক্ষেত্রে একটা ভয়ানক অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছে। আর অরাজক অবস্থার জন্য অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র আমরা সাধারণ নাগরিকরাও খানিকটা দায়ী। বেশ কিছুকাল ধরেই টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার কথাটা আমরা শুনেছি। আমরাও আমাদের অযোগ্য ছেলেপুলের জন্য দালাল খোঁজার চেষ্টা করেছি। জমি বিক্রি করে, ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে ঘুষের টাকা জোগাড় করেছি আমরাই। প্রতিবেশীরা দেখেছেন, বুঝেছেন, চুপ থেকেছেন। যাঁরা টাকা জোগাড় করতে পারেননি চাকরির অপেক্ষায় বসে না থেকে তাঁতের শাড়ি বিক্রি করছেন বলে তাঁদের বাহবা দিয়েছি। এই প্রশ্নটা আমাদের মনের ভিতর আসেনি তিনি বাংলায় বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান– যা নিয়েই স্নাতকোত্তর করুন, সেটা শাড়ি বা ফুল বিক্রির জন্য নয়। যেখানে সরকারি কর্তা-ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের লজ্জা হওয়ার কথা, সেখানে তারা এমএ ফুচকাওয়ালি, এমবিএ চায়েওয়ালাদের পিঠ চাপড়েছেন। এই পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যেখানে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। চারদিক নিভে আসা পঙ্গুত্ব নিয়ে কফির টেবিলে তুফান তুললেও আমরাও সদর্থে মাথা ঘামাইনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ভোটে যারা পরিযায়ী
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এমত অবস্থায় কর্মসংস্থানের দেশজোড়া যে গল্প আমরা শুনছি, তার ফাঁকফোকর এত বেশি যে সাধারণ মানুষের চোখেও তা পড়ে যাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের পাস করা যে ঝলমলে মুখগুলো দেখছি আর ভাবছি এই ডিগ্রিগুলো নিয়ে যে আরও বড় পরীক্ষার মুখে তাদের পড়তে হবে সেখানে যে অন্ধকার তা হাজার আলোর রোশনাই দিয়েও মেটানো যাবে না। পাস করা কাগজের দাম সেখানে কানাকড়ি। সরকারি চাকরির পরীক্ষার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ক্রমশ রণক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। কারণ যে কোনও সরকারি অফিসে অবসর নিলে সেখানে আর আগের মতো দ্রুত নিয়োগ হচ্ছে না। কর্মী সংকোচন সরকারি ক্ষেত্রে বাড়ছে কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে যেখানে আর্থিক নিরাপত্তা বলে কিছু নেই, নিত্য অপমানের ক্রীতদাসত্ব যেখানে অবসাদের দিকে নিয়ে যায়, সেখানে নিয়োগ থেমে নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের উজ্জ্বল মুখ ম্লান করে দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার নয়। কিন্তু দীর্ঘকাল শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থেকে এই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে কিছুতেই চোখ এড়াতে পারি না। অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকে না।