Robbar

‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 10, 2024 6:02 pm
  • Updated:May 11, 2024 5:27 pm  

‘জঞ্জির’ দেখে পাড়ায় ফিরেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই রাতে তার বাড়িতে যারা হানা দিয়েছিল, তাদের একহাত নেবে। মাথা ফেটেছিল মারপিটে, কিন্তু অন‍্যপক্ষও অক্ষত থাকেনি। এই অবস্থায় ছেলেকে পথে ফেরাতে স্কুলের এক মাস্টারের শরণাপন্ন হল পরিবার, যে মাস্টারমশাই ওকে নিয়ে যেতে শুরু করল পার্টি ক্লাসে। ছেলে শান্ত হল, ভাবল, দাদার পথে না হলেও অন‍্য কোনও সমান্তরাল পথে সে সমাজ নিশ্চয়ই বদলাবে সে। কেবল ওই অমিতাভ বচ্চনের ভূত মাথা থেকে নামল না। 

প্রিয়ক মিত্র

১৩.

‘শোলে’ মুক্তি পেয়েছিল স্বাধীনতা দিবসের দিন। ‘দিওয়ার’ মুক্তি পেয়েছিল জানুয়ারি মাসের শেষভাগে। সালটা একই, ১৯৭৫। নকশাল আন্দোলনের আগুন ততদিনে স্তিমিত, হিপি আন্দোলনের চোরাগোপ্তা প্রসার চলছেই, কিন্তু তা হয়তো আর আগের মতো বিস্ময় জাগায় না, মাঝে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গিয়েছে, আর এই বছরই শেষ হচ্ছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। দেশ জুড়ে, বিশেষত এপার বাংলা জুড়ে চলতে থাকা এক দীর্ঘ অশান্ত সময়রেখার শেষ পর্যায়টা এই বছরেই শুরু হয়েছিল, ২৫ জুন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্য দিয়ে।

‘জঞ্জির’, ‘দিওয়ার’-এর প্রতিনায়ক যে ‘অ্যাংরি ইয়ং ম‍্যান’ জমানার সূত্রপাত ঘটাল, তার মধ্যে পরবর্তীতে ব‍্যাটম‍্যান বা ডার্ক নাইটের সূত্র খুঁজে পাওয়াটা খুব আশ্চর্যও ছিল না। ‘জঞ্জির’-এ চোখের সামনে পিতামাতার হত্যা দেখা বিজয় প্রথমে পুলিশ ও ক্রমে আইনের চৌষট্টি খোপের বাইরের নায়ক হয়ে উঠছে যখন, তখন দেশজুড়ে আসলে অরাজকতার, নৈরাজ্যের এক নতুন ব‍্যাকরণ নির্মিত হয়েছে। প্রশাসনের নিয়মতান্ত্রিকতায় পচন ধরছে। এমন এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ এসে উপস্থিত হচ্ছে, যখন যা রাষ্ট্রীয়, তাকেই প্রত‍্যাখ‍্যান করতে চাইছে মানুষ। তার মধ্যেই বিজয় নামের দু’টি চরিত্র অমিতাভ বচ্চনকে করে তুলেছিল সমষ্টিগত দ্রোহমনের অবধারিত প্রতিনিধি। এ সেই দেশ, যেখানে পুলিশ, প্রশাসন, শাসক শ্রেণির প্রতিভূদের অনায়াসে খলচরিত্র হিসেবে দেখানো যেত। নায়ক হয়ে উঠতে পারত সে, ক্ষমতার বিরুদ্ধে যার স্বর তীব্র। নৈরাজ্য উদযাপিত হত সেই পৃথিবীতে। সেই দেশ গথাম হয়ে উঠেছিল, ডার্ক নাইটরাই তাই  সেলুলয়েডে গরিমান্বিত হত। তখনও দেশের মধ্যেই ‘দুশমন’ খুঁজে বের করা যেত, শত্রুর খোঁজে সীমান্ত পার করতে হত না।

Zanjeer - Amitabh Bachchan - Hindi Movie Poster Collage - Tallenge Bollywood Poster Collection - Framed Prints by Tallenge Store | Buy Posters, Frames, Canvas & Digital Art Prints | Small, Compact, Medium and Large Variants

ভেবে দেখলে, ‘জঞ্জির’-এও উর্দি শেষত রক্ষাকবচ হয়ে ওঠেনি সমাজের, কিন্তু শেষত বিজয় ভরসা করতে চেয়েছিল পুলিশের উর্দিকেই। আবার ‘দিওয়ার’-এ উর্দিপরা শশী কাপুরের হাতে প্রাণ দেওয়া অমিতাভ বচ্চন অভিনীত বিজয়ও আইনকে, রাষ্ট্রকেই নিবেদন করে তার যাবতীয় প্রতিহিংসার দলিল। বহু পরে বলিউডে নির্মিত, মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত ‘শূল’,  সংলাপ লিখেছিলেন অনুরাগ কাশ‍্যপ, সঞ্জয় দত্ত অভিনীত ‘কুরুক্ষেত্র’, বা বিবেক ওবেরয় অভিনীত ‘দম’-এর কথাও মনে পড়ে যেতে পারে, যেখানে আসলেই উর্দি পরে সমাজ বদলানোর আকাঙ্ক্ষা চোট খাচ্ছে। আবার ‘জঞ্জির’ বা ‘দিওয়ার’-এর দশ বছরের মাথায়, রোহিত শেট্টির কপ ব্রহ্মাণ্ডের বহু আগেই, উত্তমকুমার-পরবর্তী বাংলায় তৈরি হবে অঞ্জন চৌধুরীর কপ ইউনিভার্স। রঞ্জিত মল্লিক অভিনীত ‘শত্রু’, ‘নবাব’, ‘ইন্দ্রজিৎ’ প্রগতিশীল বাম সংস্কৃতির মধ‍্যে জনসংস্কৃতির স্বর হয়ে উঠতে পেরেছিল।

এইসব ময়নাতদন্তের মাঝেই মনে পড়ে এমন একজনের গল্প, যে এই দ্রোহকালবৃত্তে আশ্চর্যভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। নকশাল আমলে দাদা নিখোঁজ হয়েছিল তার। মা, বাবা, দিদিকে চোখের সামনে হেনস্তা করে যায় পাড়ার গুন্ডারা, কারণ অমন ‘বেজন্মা’ নকশালের খোঁজ তারা কেউ-ই জানত না, শুধু পরিবারকেই পেয়েছিল নাগালে। দাদার মতো বিপ্লবী মন তার ছিল না, সে নাকি সত্যিই চেয়েছিল দিদির সঙ্গে লুকিয়ে হলে গিয়ে ‘থানা থেকে আসছি’-তে দেখা উত্তমকুমারের মতো হতে। এমন কামনার বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার মাঝেই হয়ে গেল বিপর্যয়। পলাতক দাদার জন্য় পরিবারের যাবতীয় নিগ্রহের সাক্ষী হওয়া বারো বছরের ছেলেটি এবার ধীরে ধীরে স্কুল পালাতে শুরু করল, বদ সঙ্গে পড়ল। নেশাখোর হয়ে উঠল প্রায়। এমনই এক অস্থির বয়ঃসন্ধি-তে ‘জঞ্জির’ দেখে ফেলেছিল সে, পাড়ার দাদাদের থেকে শুনেছিল, রাজেশ খান্নার চেয়েও বড় হিরো পাওয়া গেছে, অমিতাভ। যেমন গলা, তেমনই অ্যাকশন।

…………………………………………………………………………………………………………………………………………..

ছেলে শান্ত হল, ভাবল, দাদার পথে না হলেও অন‍্য কোনও সমান্তরাল পথে সে সমাজ নিশ্চয়ই বদলাবে সে। কেবল ওই অমিতাভ বচ্চনের ভূত মাথা থেকে নামল না। ‘দিওয়ার’, ‘নমক হারাম’; স্কুল পালিয়ে পঁচাত্তর পয়সার টিকিটেই সে পেয়ে যেত তার স্বপ্নের নায়ককে, যে ভরসা দেয়, দাদা হয়তো একদিন ফিরবে, যে ভরসা দেয়, বাবা-মা নিশ্চয়ই একদিন স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে, দিদি আর কুঁকড়ে থাকবে না।

……………………………………………………………………………………………………………………………………………

‘জঞ্জির’ দেখে পাড়ায় ফিরেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই রাতে তার বাড়িতে যারা হানা দিয়েছিল, তাদের একহাত নেবে। মাথা ফেটেছিল মারপিটে, কিন্তু অন‍্যপক্ষও অক্ষত থাকেনি। এই অবস্থায় ছেলেকে পথে ফেরাতে স্কুলের এক মাস্টারের শরণাপন্ন হল পরিবার, যে মাস্টারমশাই ওকে নিয়ে যেতে শুরু করল পার্টি ক্লাসে। ছেলে শান্ত হল, ভাবল, দাদার পথে না হলেও অন‍্য কোনও সমান্তরাল পথে সে সমাজ নিশ্চয়ই বদলাবে সে। কেবল ওই অমিতাভ বচ্চনের ভূত মাথা থেকে নামল না। ‘দিওয়ার’, ‘নমক হারাম’; স্কুল পালিয়ে পঁচাত্তর পয়সার টিকিটেই সে পেয়ে যেত তার স্বপ্নের নায়ককে, যে ভরসা দেয়, দাদা হয়তো একদিন ফিরবে, যে ভরসা দেয়, বাবা-মা নিশ্চয়ই একদিন স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে, দিদি আর কুঁকড়ে থাকবে না।

এমারজেন্সি জারি হয়ে গেছে তখন। ম‍্যাটিনি শো-এ ‘শোলে’ দেখে এক বিকেলে সবান্ধব বাড়ি ফিরছিল সে। পথ আটকাল পুলিশ জিপ। টিকিট দেখিয়েও রক্ষে নেই। ‘কারফিউর মধ্যে রাস্তায় কী করছিস?’ অথচ কারফিউ যে জারি হয়েই, তাই তো সে জানত না! পুলিশ শুনল না কিছুই। জিপে উঠিয়ে নিল। থানায় যেতে হবে। বন্ধুরা দৌড়ে এসে খবর দিল বাড়িতে। অসহায় মা-বাবা মাস্টারের শরণাপন্ন হল। তারপর পার্টির লোক থানায় গিয়ে ছাড়িয়ে আনল। হুমকি ছিল পুলিশের, ‘দাদার মতো পরিণতি যেন না হয়, নজর রাখিস।’ পার্টির ছেলে হিসেবে মার্কামারা পরিচয় হয়ে গেল তার সেদিন থেকে, কিন্তু কেউই জানত না, ‘শোলে’-তে জয়ের মৃত্যু নিয়েই তার মন বিষণ্ণ ছিল সেদিন, সারাদিন।

मुंबई के पुराने सिनेमा हॉल कैसे होते थे || Cinema Hall - Indian Theatre || OLD Talkies - #Multiplex - YouTube

সাতাত্তর এল। পার্টির হয়ে ছাপ্পাও দিল ছেলেটি। জিতল পার্টি। সেই তার শেষ রাজনীতির সঙ্গে সংস্রব।

এর বেশ কয়েক বছর পর, চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের ছেলেটি তখন চাকুরিজীবী। সদ‍্য বিবাহিত। স্ত্রীর সঙ্গে সেই তার প্রথম সিনেমা হল সফর। তার প্রিয় নায়কেরা ছবি অবশ্য নয়। রাজ বব্বর অভিনীত ‘আজ কি আওয়াজ’। সেই ছবিতেও ছিল পুলিশ ও মাফিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামী এক নায়কের আখ‍্যান। নায়ক দুমদাম মেরে ফেলছে প্রভাবশালীদের। ম‍্যাটিনি শো-এ তখন জনাকয়েক দর্শক, উত্তর-শারদীয়া কলকাতার খাঁ খাঁ এলিট সিনেমা হলে।

ছবি তুঙ্গ মাঝপথে। হঠাৎই পর্দা সাদা হয়ে গেল। আচম্বিত। খবর ভেসে উঠল সেই পর্দায়।

আজ সকালেই নিহত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। কারফিউ জারি হয়েছে। দর্শকদের তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরতে বলা হচ্ছে।

সিনেমাফেরত কারফিউ যে আবার তার জীবনে এভাবে ফিরবে, ছেলেটি কি জানত?

…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী? 

পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল

পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ‍্যানের স্মৃতি

পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে

পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না

পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা

পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?

পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প

পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা

পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!

পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?

পর্ব ‌১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল