১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৯২, দীর্ঘ কর্মজীবনে সত্যজিতের অজস্র সাক্ষাৎকার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে সদ্য। তবে অকারণ নিবন্ধর অন্তর্ভুক্তিতে বইয়ের সুরতাল কেটেছে। লিখছেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমার ক্ষণিকের যৌন দৃশ্যটি নিয়ে এ দেশের তাবত ভক্তকুল আকুল। এ দৃশ্য কেমন করে সেন্সর বোর্ডে অনুমোদন পেয়ে গেল– তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলেছেন খোদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও। সেই আবহে ‘সত্যজিৎ রায়: সুবর্ণ সাক্ষাৎ সংগ্রহ’ বইটি ওলটাতে গিয়ে কৌতূহল জাগছিল, ভারতীয় সিনেজগতের ছুঁতমার্গ তো নতুন কিছু নয়। তাহলে এই সেন্সরের কাঁচি কি রায়সাহেবকেও ব্যতিব্যস্ত করেছিল কখনও? দেখা গেল, ১৯৭৬ সালে সত্যজিতের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে ‘ফিল্মের এনটারটেনমেন্ট ভ্যালুকে অস্বীকার করা যায় না’ শীর্ষক যে নিবন্ধটি লিখেছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, তাতে সত্যজিৎ স্পষ্টই জানাচ্ছেন, সেই সময় পর্যন্ত কখনওই সেন্সরের কথা ভেবে নিজেকে আড়ষ্ট হয়ে যেতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি বলছেন, সেন্সর নয়, দর্শকের কথা ভেবেই তাঁর যা কিছু সতর্কতা। বলছেন, “আমার ‘দেবী’-তে চুম্বনের দৃশ্য ছিল। তীব্র নাটকীয় মুহূর্তে তার প্রয়োজন ছিল, সুতরাং, কেউ তা নিয়ে কোনও প্রতিবাদ করেননি। আমি অবশ্য ইঙ্গিতে, আভাসে বোঝাতে বেশি ভালবাসি।” বোঝা যাচ্ছে, আসলে তাঁর নিজের মনোভঙ্গিটিও চিৎকৃত নিরাবরণ বাচনের পরিপন্থীই। ‘আমার ছবিতে মাঝে মাঝে রাজনীতি এসে পড়ে’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া তাঁর এই সাক্ষাৎকারে উঠে আসে যে, কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কই নয়, রাজনৈতিক প্রসঙ্গেও তিনি পরোক্ষ বাচনের পক্ষে। আর এইভাবেই এক-একটি সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যক্তিক যাপন থেকে কাজের দুনিয়া, সাংস্কৃতিক অনুশীলন থেকে সাহিত্যিক চর্চা, সামাজিক বীক্ষণ থেকে নৈতিক অনুভব, নিজস্ব সমগ্রতার একাধিক রংকে ছুঁয়ে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়।
আরও পড়ুন: শান্তিনিকেতনের সেকাল: স্মৃতির ভাষ্যে অতীতের জলছবি
আসলে সত্যজিৎ রায়ের মতো অনেকান্ত প্রতিভা ঘিরে থাকে যে মানুষকে, তাঁদের নিয়ে কথা ফুরয় না। কোনও এক ধাঁচের, এক শৈলীর, এক বিষয়ের লেখায় তাঁকে সম্পূর্ণত ধরাও যায় না। সেই ব্যাপ্তিকে ছোঁয়ার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক হয়ে উঠতে পারে তাঁর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার। কারণ কথোপকথনের সূত্রেই মানুষের আঁতের কথাটি ধরা পড়ে। আর সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়ের সম্পাদনায় সেই কাজটিই করতে চেয়েছে এ বই। তাই কোনও সাক্ষাৎকারে যেমন চলচ্চিত্রের ভাষার ক্রমবিবর্তন নিয়ে সত্যজিতের ভাবনাচিন্তা ধরা পড়েছে, তেমনই আবার কখনও একান্ত বৈঠকি মেজাজে পাওয়া গিয়েছে এই মানুষটিকে। এইসব টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সত্যজিতের এক অন্য মুখ।
আরও পড়ুন: জীবন থেকে হারানো জীবিকার অণুকথা
এই সংকলনের নাম ‘সুবর্ণ সাক্ষাৎ সংগ্রহ’। মুখবন্ধেও সম্পাদক জানিয়েছেন, ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯২ পর্যন্ত দীর্ঘ কর্মজীবনে সত্যজিৎ যে অজস্র সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, বিভিন্ন বিষয় আর বিভিন্ন মেজাজের সেইসব কথোপকথনের অনেকগুলিকে একটি সংকলনের সুতোয় বাঁধতে চেয়েছিলেন তাঁরা। তবে পঞ্চাশটি সাক্ষাৎকারের যে সুবর্ণ সংগ্রহ বলে এই বইকে তাঁরা চিহ্নিত করছেন, সেখানে প্রথাগত সাক্ষাৎকার ছাড়াও সত্যজিতের বেশ কিছু বক্তব্য স্থান পেয়েছে, সে কথাও জানাচ্ছেন তিনি। চলচ্চিত্র উৎসব, পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান, সংবর্ধনা সভা– এমন নানা উপলক্ষে স্বাভাবিকভাবেই সত্যজিৎ রায়কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল অথবা বক্তব্য রাখতে হয়েছিল। ফিচারধর্মী সেইসব লেখার কিয়দংশও জুড়ে গিয়েছে এই সংকলনে। আর প্রশ্ন সেখানেই। সাক্ষাৎকার এবং ফিচার– শৈলীগতভাবেই পরস্পর পৃথক। সাক্ষাৎকারে প্রশ্নোত্তরের সূত্র ধরে ব্যক্তির নিজস্ব মনোভঙ্গিটি ধরা দেয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে অন্য কেউ নিবন্ধ লিখলে লেখকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে জুড়ে যেতে বাধ্য।
আর শুধু সত্যজিতের সঙ্গে কথোপকথনের ওপর নির্ভর করে লিখিত নিবন্ধই যে এই সংকলনে স্থান পেয়েছে, তেমনটাও নয়। এমন একাধিক নিবন্ধ রয়েছে, যা বস্তুত সত্যজিৎ রায়ের জীবনের কোনও মুহূর্তকে আধারিত করে লেখা মাত্র, সত্যজিৎ সেখানে প্রধান বক্তা বা প্রধান চরিত্রও নন। যেমন ‘এস এফ সিনে ক্লাবের উদ্বোধন উৎসব’। অদ্রীশ বর্ধন সম্পাদিত কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’-এর সূত্র ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব। প্রোফেসর শঙ্কু-র জনক সত্যজিৎ রায় ছিলেন তার উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক, ক্লাবের লোগো থেকে স্যুভেনিরের কভার ডিজাইন– প্রতিটিই তাঁর হাতে তৈরি হয়ে উঠেছিল। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যার ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ক্লাবের প্রতিষ্ঠার দিনটির বিবরণ। সেই উৎসবের অন্যতম মুখ ছিলেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সত্যজিৎ রায়, সভাপতির ভাষণে এ জাতীয় ক্লাব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনের দিকটিও তিনি তুলে ধরেন। কিন্তু প্রায় গল্পের ছলে লেখা সভার এই কার্যবিবরণীতে প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে পাহাড়ী সান্যাল, তুষারকান্তি ঘোষ থেকে কাফী খাঁ প্রত্যেকেরই সগৌরব উপস্থিত। আবার ‘আলাপ’ শীর্ষক লেখাটি পালাম বিমানবন্দরে দুই অপেক্ষমাণ যাত্রী– সত্যজিৎ রায় এবং ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ-এর সাক্ষাৎকে কেন্দ্র করে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত প্রতিবেদন, যেখানে সংগীত প্রসঙ্গে বিলায়েৎ খাঁ সাহেবের বক্তব্যই মূলত উঠে এসেছে। ‘ক্লাইভ থেকে কিশোরগঞ্জ’ লেখাটিতেও মূল চরিত্র হয়ে উঠেছেন নীরদ সি চৌধুরী। গ্রন্থনাম এবং সম্পাদকের বক্তব্যের সঙ্গে এই বিষয়টিকে খানিক কম সাযুজ্যপূর্ণ বলেই মনে হয়।
সুবর্ণ সাক্ষাৎ সংগ্রহ
সম্পাদনা: সন্দীপ রায়
প্রকাশক: বিচিত্রা গ্রন্থন বিভাগ
মূল্য: ৬০০ টাকা