ঋতুপর্ণর গৃহসজ্জা তাঁর মতোই জমকালো। প্রতিটি ঘরের কোণেই সেখানে রয়েছে মিউজিয়ামের চমক। তটস্থ হয়ে হাঁটতে হয়, এই বুঝি টাল খেয়ে পড়ে গেল কিছু। একটা লোকের বেঁচে থাকতে এত বাহারি আয়োজন লাগে?
৩.
ক্যাসেট, বুকলেট বগলদাবা করে ঋতুপর্ণর বাড়ি পৌঁছলাম। তখন মনের কোণে আশা ঘাই মারছে, মঞ্চে আমাদের হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন কেউ একটা কেউকেটা। প্রথমবার ঋতুপর্ণর বাড়ি ঢুকে বেশ ভড়কেই গিয়েছিলাম। রকমসকম অদ্ভুত! একটা দেওয়াল কালো রং করা। দেওয়ালের আধখানা মাদুর দিয়ে বাঁধানো, মাটিতে একটা লম্বাটে, বাহারি শতরঞ্চি। পুরনো বাড়ি, কিন্তু ভিতরটা খুবই স্টাইলিশ। দরজাটা ফ্রেমে বাঁধানো, ভিতরে যুবক বয়সের রবীন্দ্রনাথ। একটা কথা বুঝেছিলাম, ঋতুপর্ণকে দেখতে চাইলে রবীন্দ্রনাথকে ঠেলে প্রবেশ করলে তবেই দেখা মিলবে। আমাদেরকে মিষ্টি খেতে দেওয়া হল, কলাপাতায় মোড়া সন্দেশ। ঋতুদা আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন শৌভিকদার সঙ্গে। আড্ডা চলাকালীন পরের দিকে যোগ দিলেন সুমন্ত মুখোপাধ্যায়। তপন সিন্হা’র ‘আতঙ্ক’ ছবিতে যাঁর গলায় ‘আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই’– এই হাড়হিম করা সংলাপটি ছিল। ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামটা শুনেই এঁরা খুব হাসছিলেন। আর ঋতুপর্ণ বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, আমাদের গানগুলো কতটা উত্তর আধুনিক। সুমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ডাকা হচ্ছিল ‘মন্টুদা’ বলে, পরবর্তীকালে আমিও সেই নামেই ডেকে এসেছি। আপাত গম্ভীর চেহারার ফাঁকে একটা লোকের যে ওইরকম সেন্স অফ হিউমার থাকতে পারে– প্রথমদিন আলাপে তা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারিনি।
যেমন বুঝতে পারিনি এই ‘তাসের ঘর’-এ ভবিষ্যতে আমাকেও আসতে হবে বহুবার। আলাপ হবে নানা কিসিমের মানুষের সঙ্গে। ঋতুপর্ণর গৃহসজ্জা তাঁর মতোই জমকালো। প্রতিটি ঘরের কোণেই সেখানে রয়েছে মিউজিয়ামের চমক। তটস্থ হয়ে হাঁটতে হয়, এই বুঝি টাল খেয়ে পড়ে গেল কিছু। একটা লোকের বেঁচে থাকতে এত বাহারি আয়োজন লাগে? কে জানে বাবা? একটা দেওয়াল মেরুন-লাল তো একটা কুচকুচে কালো– তবে যেখানেই যাই থাক, সব কিছুর ভেতরেই থরে থরে সাজানো অসংখ্য বই। এত পড়ে! সময় পায় কখন? প্রথম দিন ঋতুপর্ণের সঙ্গে খোশগল্প হয়েছিল প্রচুর। প্রথমে গানের লিরিক, পরে বাংলা কবিতা– সিনেমার কথা একেবারেই আলোচনা হয়নি। ঋতুপর্ণর এত সংগ্রহের মধ্যে আমার চোখ টানল একটা ক্যালেন্ডার– কালোর ভেতর বাংলা হরফে লেখা সংখ্যা, মাস-সন কিছু লেখা নেই। মনে পড়ে গেল, ‘উনিশে এপ্রিল’-এ অপর্ণা সেনের বাড়ি। ১৯ তারিখটা এই ক্যালেন্ডারেই দেখেছিলাম পর্দায়।
ঋতুপর্ণ আলাপের উত্তেজনা প্রথম কিছুদিন তুমুল। বাকি বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজন দেখলাম প্রত্যেকের কাছেই বেশ একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে মানুষটার। ফলে কীরকম বাড়ি, সামনে থেকে দেখতে কেমন– এর পর্ব চলল কিছুদিন। তারপর থিতিয়ে এল আলোচনা, যেমন হয়। আমরাও আমাদের জীবনযুদ্ধে লেগে পড়লাম। একটা না-পাওয়া অ্যাওয়ার্ড, ঋতুপর্ণর অমায়িক ব্যবহার– এইটুকুই জেগে রইল খানিক। কাগজে খবর বেরলে আর একটু মন দিয়ে পড়ি। ছবি ছাপলে, সামনে দেখা চেহারাটা মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি, ব্যস। এমন শান্ত, নিস্তরঙ্গ ঝিলে, বুদ্বুদ উঠল হঠাৎ। ফোনের ওপারে ফের ঋতুপর্ণ।
–চন্দ্রিল আর তুমি একবার আসতে পারবে? খুব দরকার।
–গান নিয়ে কিছু?
–এলে বলছি।
আবার আমি আর চন্দ্রিল মেট্রো, বাস বদলিয়ে ইন্দ্রাণী পার্ক। দেখা যাক কী নাচছে কপালে! “তোমরা একটা টক শো করতে পারবে ‘তারা টিভি’তে?” সে সময় তারা টিভি একবারে হইচই ফেলা ব্যাপার! শুধু নন-ফিকশন দিয়ে যে একটা এমন বুদ্ধিদীপ্ত চ্যানেল হতে পারে, দেখিয়ে দিয়েছে তারা। অমিতাভ বচ্চন-মল্লিকা সারাভাই এসে লঞ্চ করেছেন সে চ্যানেল। নামজাদা আমলা রতিকান্ত বসুর এক নতুন ভেঞ্চার। খবর মারফত এ-ও জেনেছি, ঋতুপর্ণ সে চ্যানেলের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। এমন হ্যাপেনিং চ্যানেলে কী টক শো করব আমরা? ঋতুপর্ণ বলে চললেন, ‘তারার নিজের যে অনুষ্ঠান সেই নিয়ে তোমাদের কথা বলতে হবে, সমালোচনা করতে হবে। আমি চাই তোমাদের ইউথ ফোরাম থেকে একটা মেসেজ যাক চ্যানেলের কাছে।’ মিটিং-এ হাজির ছিলেন চ্যানেলের মার্কেটিং হেড সুমন্ত্র মিত্র। আমাদের চেহারাপত্তর দেখে তিনি খুব ইমপ্রেসড ছিলেন না। “শুধু ওরা দু’জন?” ঋতুপর্ণ বললেন, “তা কেন, দু’জন মহিলাও থাকবেন।”
দুই রোগা দেড়েল ছাড়াও যে আরও দু’জন থাকবে, জেনে একটু আশ্বস্ত হলেন সুমন্ত্র মিত্র। কিন্তু তারা কারা? ঋতুপর্ণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের বান্ধবীরা কেউ পারবে?’
চন্দ্রিল সঞ্চারীর কথা বলেছিল। ‘বেশ ওকে নিয়ে এসো। তুমি কাউকে চেনো?’ আমি মাথা নাড়ালাম। তেমন কারও কথা মনে পড়ছে না। ঋতুপর্ণ বললেন, ‘কিছুদিন আগে যাদবপুর থেকে ফিল্ম স্টাডিজ-এর একটি মেয়ে এসছিল। তুমি তাকে একটু জোগাড় করতে পারবে?’ আমার মুখের রিঅ্যাকশন দেখে হেসে ফেললেন ঋতুপর্ণ। ‘তোমার যা বয়স, এই অ্যাসাইনমেন্টায় তো খুশি হওয়ার কথা।’ দেখলাম, সুমন্ত্র মিত্রও হাসি চাপার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ খুব রাগ হতে শুরু করল ঋতুপর্ণর ওপর। কোথায় একটা অ্যাওয়ার্ড দেবে, তা না একটা মেয়ে খোঁজার কাজ দিচ্ছে বেকার। ‘নামটা কী?’ আমার গলার স্বরে হালকা বিরক্তি। “‘মেহুলি’ বলল মনে হচ্ছে।” “আচ্ছা, আর দেখতে কীর’ম?” ‘সে তো খুঁজে পেলেই দেখতে পাবে, তাই না?’ আবার চাপা হাসির আওয়াজ।
ঋতুপর্ণ কি মজা করছেন আমার সঙ্গে? কোথায় খুঁজি মেয়েটাকে?