পুরোহিতদের সঙ্গে ঝগড়া করলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শালগ্রাম শিলার বদলে সদ্যজাত সন্তানের নামকরণ করলেন ভিন্ন পদ্ধতিতে। একটি কাঠের পিঁড়িতে আলপনা দেওয়া হল। পিঁড়িটি ঘিরে জ্বালানো হল প্রদীপের সারি। প্রদীপের শিখার আগুন ও তাপ কাঁপছে পিঁড়ির ওপর। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চোদ্দোতম সন্তানের নাম রক্তচন্দনের অক্ষরে লিখলেন সেই প্রদীপ শিখার হল্কার মধ্যে: ‘রবীন্দ্রনাথ’।
৩.
ইতিমধ্যে দু’টি বলার মতো কাণ্ড ঘটেছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। এক, জ্ঞানদা রজস্বলা হয়েছে। তার বয়স ১২ পেরিয়েছে। অন্য ঘটনাটিও কম জরুরি নয়। জ্ঞানদার শ্বশুরমশাই, যাঁকে সে এ-বাড়ির দস্তুর অনুসারে ‘বাবামশায়’ ডাকে, তাঁর আরও একটি সন্তান হয়েছে। ‘বাবামশায়ের আরও একটি হল তাহলে’– একথা জ্ঞানদাকে রাত্তিরবেলা বুকে জড়িয়ে বললেন তার বর। জ্ঞানদার এই পুঁচকে দেওরটি বাবামশায়ের ১৪ নম্বর সন্তান। ‘বাবামশায় এখানেই থামবেন বলে মনে হয় না’– জ্ঞানদাকে চুমু খেয়ে এ-কথাও বলেছিলেন তার ৮ বছরের বড় বর সত্যেন্দ্র। কেন যে বরের বয়সটা আরও কম হল না! এক বছরের ছোট দেওর জ্যোতিঠাকুরপোর কথা মনে পড়ে জ্ঞানদার। সব্বার থেকে আলাদা জ্যোতিঠাকুরপো। কী মিষ্টি, মিহি, সুন্দর– জ্ঞানদা জ্যোতিঠাকুরপোকে খুব ভালবাসে। এই ভালবাসাটা সে নিজের মধ্যে রেখে দিয়েছে। ভোরবেলার স্বপ্নের মতো। কাউকে কোনও দিন সে বলবে না, এই ভালবাসার কথা।
আরও একটা ঘটনা, গল্পও বলা যায়, জ্ঞানদা চেপে রেখেছে মনের মধ্যে। সেই গল্পটা তার পুঁচকে ফুলের মতো সুন্দর দেওরের অন্নপ্রাশন ও নামকরণ অনুষ্ঠানের গল্প। বাবামশায় কী কাণ্ডটাই করেছিলেন সেদিন! পুরোহিতদের সঙ্গে ঝগড়া করলেন। বললেন, প্রয়োজন নেই শালগ্রাম শিলার। নামকরণ হবে ভিন্ন পদ্ধতিতে। এবং আমিই দেখাব সেই ভিন্ন পদ্ধতি। বাবামশায়ের হুকুমে এল একটি কাঠের পিঁড়ি। আলপনা দেওয়া হল সেই পিঁড়িতে। পিঁড়িটি ঘিরে জ্বালানো হল প্রদীপের সারি। প্রদীপের শিখার আগুন ও তাপ কাঁপছে পিঁড়ির ওপর। বাবামশায় তাঁর চোদ্দোতম সন্তানের নাম রক্তচন্দনের অক্ষরে লিখলেন সেই প্রদীপ শিখার হল্কার মধ্যে: ‘রবীন্দ্রনাথ’। বললেন সূর্যের মতো দীপ্যমান হবে আমার এই সন্তান। সব মনে আছে জ্ঞানদার।
আরও একটি কথা মনে আছে জ্ঞানদার। এই ঘটনাটি দেখতে দেখতে কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে পড়ল তার বছর আঠেরোর কিশোর ডাকাবুকো দেওর হেমেন্দ্র। সে জ্ঞানদার পিঠে সজোরে ধাক্কা দিয়ে অনুষ্ঠানের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এর পরের ঘটনা ঘটছে হেমেন্দ্রর ঘরে।
–ওইভাবে রেগে বেরিয়ে চলে এলে কেন? জ্ঞানদা হেমেন্দ্রর ঘরে ঝড়ের মতো ঢুকে জানতে চায়।
–বাবামশায় ভুল করলেন, মস্ত বড় ভুল। বলল হেমেন্দ্র।
–পুরোহিত আর হিন্দুপণ্ডিতরা রেগে গিয়েছেন, তাঁরা বাবামশায়ের বিরোধিতা করবেন নারায়ণ শিলা বর্জনের জন্য, তাই তো?
–না, তা নয়। বাবামশায় তাঁর স্নেহের ছোট্ট রবিকে ভুল আশীর্বাদ করলেন।
–ভুল আশীর্বাদ? সূর্যের মতো দীপ্যমান হও, ভুল আশীর্বাদ?
–বউঠান, সূর্যের শুধু দীপ্তিটাই দেখো তোমরা, তার প্রতি মুহূর্তের দহনটা দেখতে পাও না? জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছে সূর্য। এবং সেই দহন যন্ত্রণার ধারে-কাছে কেউ নেই। সূর্য একা। আমার এই ভাইটার জীবন সুখের হবে না বউঠান। যদি বাবামশায়ের আশীর্বাদ সত্যি হয়ে ওঠে, রবি নিজে পুড়বে, অনেককে পোড়াবে। জ্বলবে সারা জীবন। আমার ভাবতে ভয় করছে।
সেই মুহূর্তে ঘরে ঢোকে বছর এগারোর জ্যোতিরিন্দ্র। বলে, বাবামশায় সব্বাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। যা করলেন, তুলনাহীন। এবং আমাদের বাবামশায় মহর্ষি। তাঁর কথা ফলবে। রবি মানে তো সূর্য। আর রবীন্দ্র তাহলে সূর্যের সূর্য। ওর তেজ সারা জগতে ছড়িয়ে পড়বে।
–জ্যোতি, তুই এখনও ছেলেমানুষ। আমি এতক্ষণ যে-কথাটা মেজবউঠানকে বললুম, তোকেও বলছি, বাবামশায়ের আশীর্বাদ যদি সত্য হয়ে ওঠে, তাহলে রবীন্দ্রের জীবন জ্বলেপুড়ে খাক হবে। সূর্যের দীপ্তির পিছনে সূর্যের দহনটা ভুলে গেলে চলবে না ভাই। ১১ বছরের জ্যোতি তাকায় তার সেজদাদা হেমেন্দ্রর দিকে। বলে, আমি সবে শেষ করেছি কবি লর্ড বায়রন আর শেলির জীবনী। দু’জনের জীবনই জ্বালাযন্ত্রণাময়। বাড়ি, সংসার, সমাজ, দেশ– সব কিছু থেকে তারা বিতাড়িত। কিন্তু তারা দারুণ দুঃখ না পেলে অমন কবিতা লিখতেই পারত না। বিদ্রোহী হয়ে জ্বলে উঠতেও পারত না। ১১ বছরের জ্যোতির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে হেমেন্দ্র গম্ভীর গলায় বলে, তুই এখন থেকে মেজবউঠানের লেখাপড়ার দায়িত্ব নে। আমি চললাম।
–তুমি কোথাও যাবে না ঠাকুরপো। আমি যেতে দিলে তো যাবে, বলে জ্ঞানদা।
ঠিক এই সময়ে ফোড়ন কাটে জ্যোতিরিন্দ্র, মিষ্টি মিহি গলায়– আমার কাছে খবর আছে। বাবামশায় নাকি ব্রাহ্মসমাজের উপাচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশীকে অনুরোধ করেছেন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরের মেয়েদের পড়াশোনার জন্য।
জ্যোতিরিন্দ্রর এই মিহি ঘোষণা বজ্রপাতের মতো শোনায়।
তথ্যসূত্র: ‘রবিজীবনী’: প্রশান্তকুমার পাল (প্রথম খণ্ড)
আমরা তো এদিকে হোম-ডেলিভারিকে বিদায় দিয়ে ততদিনে ভাতের হোটেলে বেঞ্চি বুক করে ফেলেছি। যে কোনও মেসতীর্থেই ধীরে জেগে ওঠে এই সব হোটেল। তাদের হোটেল বললে বড় পাঁচ-সাত তারা-রা কুপিত হতে পারে। না বললে, আমাদের সম্মানে লাগে।