গৌতম গম্ভীরকে ক’বেই বা বুঝল ভারতীয় ক্রিকেট, আসমুদ্রহিমাচলের ক্রিকেটপ্রিয় জনতা! কখনওই না। দিল্লির বাঁ-হাতির ভারতীয় ক্রিকেটের সেই নীরব সাধক, যাঁকে চিনতে বারবার ভুল করেছে শতকোটি দেশবাসী। ভুল বুঝেছে তার চেয়েও শতগুণ। ক্রিকেটের মায়াসভ্যতায় ‘গোতি’ প্রকৃতই মেঘে ঢাকা তারা, যাঁর কাছে ভারতীয় ক্রিকেটের ঋণ অপরিমিত, অপরিশোধতুল্য।
জয়ের স্পর্শমাখা রানটা ভেঙ্কটেশ আইয়ারের ব্যাট ছুঁয়ে বেরিয়ে আসতেই ২২ গজের দিকে ছুটতে শুরু করেছিলেন রিঙ্কু সিংরা। বাংলার মাটি স্পর্শ করা দামাল ‘রেমাল’-এর গতি কি তাঁদের চেয়ে বেশি ছিল? জানা নেই।
ট্রফি জয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে ভিআইপি বক্সে তখন মুখের সাদা মাক্সটা খুলে ফেলেছেন বাদশা শাহরুখ। চেনা হাসির মধ্যে দিয়ে কি বাড়তি তৃপ্তি ঝরে পড়ছিল ‘কিং খান’-এর শরীরীভাষায়? জানা নেই।
এক স্বপ্ন আবেশে ভাসছে তখন ‘পাঠান’-এর পরিপার্শ্ব। সুখী হাতগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তৃপ্ত ‘জওয়ান’কে। বাজিগর-ঘরণী গৌরী খান হাসছেন। অম্লান হাসি। চিপকের গ্যালারিতে আনন্দের ঝর্ণাধারার মতো ঝরে পড়ছে আবেগের বহ্নিশিখা। একটা বদলে যাওয়া দল, বদলে যাওয়া ড্রেসিংরুম, বদলে যাওয়া আবহ– যেন সব সম্ভব হয়ে উঠেছে আচমকা, কোনও এক জিয়নকাঠির স্পর্শে। সেই আশ্চর্য সৃষ্টিসুখের কুশলী জাদুকর কে হতে পারেন গৌতম গম্ভীর ছাড়া!
হ্যাঁ, গৌতম গম্ভীর। ভারতীয় ক্রিকেটের সেই যুগপুরুষ, যাঁর কাছে ব্যক্তির আগে দল। ব্যক্তিগত প্রাপ্তির চেয়ে ঢের গ্রহণযোগ্য দলের সাফল্য। সেই গম্ভীর-সাধনায় কোনও রাখঢাক নেই। নেই কোনও মুখ-মুখোশের দ্বন্দ্ব। সবচেয়ে বড় কথা, নেই বিন্দুমাত্র আপোষ। তাই অবলীলায় গৌতম কঠোর হতে পারেন, নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, ‘আমার হাসি দেখার জন্য ক্রিকেট অনুরাগীরা মাঠে আসেন না, আসেন আমাকে চ্যাম্পিয়ন দেখতে।’ যাঁর কাছে জয়টাই দিনের শেষে মুখ্য, বাকি সব গৌণ। এমন ক্রিকেট-দ্রষ্টার হাত ধরে সাফল্যের শিখরে পৌঁছনোটা তাই কেকেআরের নিয়তি নির্ধারিত ছিল। আক্ষেপ শুধু একটাই, দেরী হল। বড্ড দেরী হল সেটা বুঝতে। গম্ভীরের ক্রিকেট-দর্শন, তাঁর প্রাজ্ঞতাকে বুঝতে দশ বছর লেগে গেল কেকেআর ম্যানেজমেন্টের!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আইপিএল নিলামে প্রায় ২৫ কোটি দিয়ে মিচেল স্টার্ককে নাইট শিবিরে নিয়ে আসা কোনও চমক ছিল না। ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল, সেটা গম্ভীর বুঝিয়েছেন। শুরুর ঝড়ঝাপ্টা সামলে ক্রমশ নাইট শিবিরের নির্ভরতার ‘আয়রনম্যান’ হয়েছেন স্টার্ক, ফাইনালে তাঁর আস্তিন থেকে ছিটকে বের হওয়া আউটসুইংয়ের বিষাক্ত ছোবলে সেই গৌতম-দর্শন সফলভাবে প্রতিফলিত। যেমনটা প্রতিফলন ঘটেছে সুনীল নারিন নামক মৃতপ্রায় জ্যোতিষ্ককে ভরসার সার-জলে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার অভিপ্রায়ে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কিং খান, কিংবা তাঁর ম্যানেজমেন্টকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। গৌতম গম্ভীরকে ক’বেই বা বুঝল ভারতীয় ক্রিকেট, আসমুদ্রহিমাচলের ক্রিকেটপ্রিয় জনতা! কখনওই না। দিল্লির বাঁ-হাতির ভারতীয় ক্রিকেটের সেই নীরব সাধক, যাঁকে চিনতে বারবার ভুল করেছে শতকোটি দেশবাসী। ভুল বুঝেছে তার চেয়েও শতগুণ। ক্রিকেটের মায়াসভ্যতায় ‘গোতি’ প্রকৃতই মেঘে ঢাকা তারা, যাঁর কাছে ভারতীয় ক্রিকেটের ঋণ অপরিমিত, অপরিশোধতুল্য। ২০০৭-এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হোক কিংবা ২০১১-এর ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জয়– ভারতের সাফল্যের ভিত্তিপ্রস্তর গড়েছেন গম্ভীর। অথচ যথাযোগ্য মর্যাদা যা গম্ভীরের পাওয়া উচিত ছিল, তা জোটেনি তাঁর কপালে। বদলে চোখের সামনে দেখেছেন, মহেন্দ্র সিং ধোনি নামক সতীর্থকে ঘিরে উন্মত্ত ক্রিকেট অনুরাগীদের ব্যক্তিপূজা, সাফল্য উদযাপনের সেই পন্থার তীব্র বিরোধী গম্ভীর, তাই যত ‘মাহি’বন্দনায় আকাশ বাতাস ভারী হয়েছে, ততই সেই স্তাবক-বৃত্ত থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছেন ‘গোতি’। নির্মম ব্যাটিংয়ের মতো কোনও রাখঢাক না রেখে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছেন এই বীরপূজার বিরুদ্ধে।
জনতার চক্ষুশূল হতে দেরি হয়নি গম্ভীরের। ব্যক্তিপূজায় মজে থাকা ভারতীয় ক্রিকেটের ভক্ত-প্রহ্লাদরা বুঝেছেন, গম্ভীর ঈর্ষাকাতর। দাম্ভিক। ঔদ্ধত্যের ভরপুর এক বিস্মৃত তারকা। আসলে কালের যাত্রাধ্বনি তাঁরা শুনতে পায়নি। পেলে তাঁরা টের পেতেন, গম্ভীর অবিবেচক নন, দূরদর্শী। সেই দূরদর্শিতা কতটা সুদূরপ্রসারী, তা এবারের আইপিএলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ডবল জি’। আইপিএল নিলামে প্রায় ২৫ কোটি দিয়ে মিচেল স্টার্ককে নাইট শিবিরে নিয়ে আসা কোনও চমক ছিল না। ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল, সেটা গম্ভীর বুঝিয়েছেন। শুরুর ঝড়ঝাপ্টা সামলে ক্রমশ নাইট শিবিরের নির্ভরতার ‘আয়রনম্যান’ হয়েছেন স্টার্ক, ফাইনালে তাঁর আস্তিন থেকে ছিটকে বের হওয়া আউটসুইংয়ের বিষাক্ত ছোবলে সেই গৌতম-দর্শন সফলভাবে প্রতিফলিত। যেমনটা প্রতিফলন ঘটেছে সুনীল নারিন নামক মৃতপ্রায় জ্যোতিষ্ককে ভরসার সার-জলে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার অভিপ্রায়ে। নারিনের মধ্যে ক্রিকেট বেঁচে, বুঝতে ভুল হয়নি গম্ভীরের। ফাইনালের পর আলিঙ্গনবদ্ধ গম্ভীর-নারিনের হাসিমুখের সহাবস্থান বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তাঁদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার তাৎপর্যটুকু। যেমন করে সেরাটা নিংড়ে নিয়েছে আন্দ্রে রাসেলের ভিতর থেকে। এককের বদলে একাধিক মুখ নিয়ে বিনি সুতোয় মালা গেঁথেছেন গম্ভীর। সেটাই নাইটদের সাফল্যের চাবিকাঠি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর লেখা: বিরাটের আইপিএল জয়ে বুঝি অভিসম্পাত আছে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আসলে রাজা হওয়ার বাসনা নিয়ে কখনও ধরাধামে অবতীর্ণ হন না গম্ভীরের মতো ব্যক্তিত্বরা। ২০১২-তে হননি, ২০১৪-তেও নয়। দশ বছর পেরিয়ে ২০২৪-এও না। বাজপাখির মতো গম্ভীরদের দৃষ্টি থাকে আরও উঁচু তারে বাঁধা। সেই সাধনায় অভীষ্ট ফল আসলে দলগত সাফল্য। যা আসে সংহতির মধ্যে দিয়ে, শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে, জয়ের তৃষ্ণার মধ্য দিয়ে। সেই বীজমন্ত্র নাইট ড্রেসিংরুমে ছড়িয়ে দিয়েছেন গম্ভীর। যা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন ফিল সল্টের মতো বিদেশি। অসুস্থ মায়ের শয্যা ছেড়ে দলের হয়ে লড়তে নেমে পড়েছেন গুরবাজের মতো আফগান যোদ্ধা। ট্রফি জয়ের পর রিঙ্কু সিংয়ের মতো নতুন তারকা আনত হয়েছেন গৌতম-সম্মুখে। শ্রদ্ধায়, সম্ভ্রমে। আসলে গৌতম-গাম্ভীর্যে এক একাগ্রতা ছিল, যা তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন শ্রেয়স আইয়ারদের মধ্যে। তাই সংশয়কে সংহার করে একচ্ছত্র আধিপত্যের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে নাইটদের পারফরম্যান্সে। অতীতে যা কখনও প্রতিভাত হতে দেখা যায়নি কেকেআরের খেলায়।
মেন্টর হিসেবে গম্ভীরের এই উত্তোরণ কাকতালীয় নয়। প্লেয়ার হিসেবেও নিজের এই মতাদর্শকে অতীতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন তিনি। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-পরবর্তী অধ্যায়ে নাইটের নেতৃত্ব ব্যাটন যখন হাতে নিয়েছেন, তখনও প্রশ্ন উঠেছিল তাঁকে ঘিরে। সেই সংশয়কে ক্রিকেটের প্রতি নিঃস্বার্থ নিবেদনে জয় করেছিলেন গোতি। একবার নয়, দু’-দু’বার। কেকেআরের সেই সাফল্যের ভিত পোক্ত হয়েছিল দলগত প্রয়াসে। দল মানে পরিবার, সেই একাত্মবোধের সুরটা বেঁধে দিয়েছিলেন গম্ভীর।
দশবছর পর কেকেআরে মেন্টর হিসেবে তাঁর প্রত্যাবর্তনও সাফল্যসুধায় ভরা হয়ে থাকল, সেই গম্ভীর-দর্শনে। ট্রফি খরা কাটাতে নাইটদের দরকার ছিল তাঁর মতোই পথপ্রদর্শকের। মেন্টরের রাজবেশে গৌতম সেই চ্যালেঞ্জটুকু শুধু গ্রহণই করলেন না, আসলেন-দেখলেন এবং জয় করলেন!