প্রতিদিন যত বকবক করা হয় এআই নিয়ে, বাস্তব চিত্রের সঙ্গে তার মস্ত ফারাক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নাচানাচি করা মানুষদের বয়স মূলত ১৮ থেকে ২৪ বছর। আর, আনন্দের থেকেও লোকের মনে বেশি ঢুকে গিয়েছে ভয়। নিঃস্ব হওয়ার ভয়।
প্রচ্ছদ: সোমোশ্রী দাস। ঋণ: সুকুমার রায়
ফেসবুকে যা দেখলাম, বিশ্বাস হল না মোটে। চোখজোড়া কতটা ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল, তা আমার সেলফি ক্যামেরা জানে। একটি পোস্টে দেখলাম রবীন্দ্র-লাইনের এক আশ্চর্য অনুবাদ। নিজের আঙুলে ও চোখে ঝালিয়ে নিতে শখ হল বড়। গুগল ট্রান্সলেটরে গিয়ে বললাম, অনুবাদ করো দেখি, ‘তটিনী হিল্লোল তুলি কল্লোলে চলিয়া যায়।’
অনুবাদকের তো তর সয় না। বাংলায় একটি শব্দ টাইপ করলেই তার ইংরিজি অনুবাদ হয়ে যেতে থাকে ঝটিতি। শেষপর্যন্ত যা এল, তা হল, ‘তটিনী পিকড্ আপ হিল্লোল অ্যান্ড ওয়েন্ট টু কল্লোল।’ আবার পড়লাম। আবার। হজম হচ্ছিল না মোটে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জামা পরা অনুবাদককে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। এ পৃথিবীতে মাটি নেই, সার্কিট রয়েছে। কোথাকার সার্কিট কোথায় রেখেছে। জানার কোনও শেষ নেই। বাইনারি ছাই ঘেঁটে দেখে নিলাম আমার ইচ্ছেতে পাপ ছিল কি না। ফের টাইপ করলাম। লিখলাম, ‘কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট।’ কর অনুবাদ! স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘ব্রেক দ্যাট আয়রন কাবার্ড অফ দ্য প্রিজন, লোপাট।’ অনুবাদকের ভাবনা ছিল একেবারে যথার্থ। ফের পড়ে দেখলাম। এসি ঘরে বসে আমার কপালে শিশিরফোঁটার মতো উদয় হচ্ছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমার সেলফি ক্যামেরা জানে। লিখলাম, ‘ধর্মতলার মোড়ে লেন দেন লেন দেন লেলিইইইন।’ পর্দার দৃপ্ত উত্তর তৃপ্ত করার আকাঙ্ক্ষায় জানিয়ে দিল, ‘অ্যাট দ্য ইন্টারসেকশন অফ ধর্মতলা, লেলিন গেভ দ্য লেন।’ ঠিকই তো। ধর্মতলার মোড়ে লেলিন রাস্তা দিয়ে দিলেন!
কপালের ঘাম মুছে সিক্ত হল টিস্যু পেপার। জেদ চেপে গিয়েছিল। ফের লিখলাম। ‘ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।’ বাইনারি শরীরের অণু-পরমাণু উজাড় করে দিয়ে অনুবাদক লিখে দিলেন, ‘চিল দ্য স্মেল অফ দ্য সান অন দ্য উইংস।’ ঢকঢক করে জল খেয়ে নিলাম এক গ্লাস। জাস্ট চিল চিল, জাস্ট চিল। মনের মাঝে যে গান বাজছে আপনাদের, যে পংক্তি হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসছে সদ্য ছিপি খোলা ঠান্ডা পানীয়র বুড়বুড়ির মতো, লিখে ফেলুন ঝটপট এআই-এর খোলা খাতায়। তার পরে জপতে থাকুন– প্রলয় কবে আসবে, সুপর্ণা?
‘আজি যত তারা তব আকাশ’-এর থেকেও বেশি হয়ে চলেছে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে সমীক্ষা, বিশ্বজুড়ে। সমীক্ষার ফলাফলের কথা জানতে চাইলে আন্তর্জাল থেকে রেজাল্ট উথলে আসে প্রজ্জ্বলিত তুবড়ির ফুলকিকণার মতো। তবে মুশকিল হল, এমন সমীক্ষার বিষয়ে পড়ি যত, এআইমাখা আগামী দিনের ছবি স্পষ্ট হওয়ার বদলে আরও ঝাপসা হয়ে আসে। লোহার তারজালি দিয়ে কেউ যেন ঘষে দেয় আমার নতুন চশমার কাচ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বিশেষজ্ঞদের করা এক সমীক্ষা বলে, এআইয়ের এই আগ্রাসনে আগামী দিনে কাজ হারাতে চলেছেন প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষ। কিন্তু, এর ফলে কাজ তৈরিও হবে প্রায় দশ কোটি লোকের। মানে, আখেরে নতুন কর্মসংস্থান হবে দুনিয়াজুড়ে দেড় কোটি মানুষের। এই দাবির বিপক্ষে জোরে কণ্ঠ ছাড়ছে আরও হাজারও পরিসংখ্যান। তাদের দাবি, কাজ হারানোর প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আগে যেমন কালো হয়ে আসে আকাশ, ঠিকই একইরকম ভাবে আঁধার মাখতে শুরু করে দিয়েছে বাহারি অফিসের অন্তরমহল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
একটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, বিশ্বের নামজাদা সংস্থাগুলির ৭৬ শতাংশই তাদের নিত্যদিনের ব্যবসার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এদের মধ্যে আবার ৮০ শতাংশ সংস্থার আহ্লাদিত দাবি, আগামী দিনের স্বপ্ন মেশানো প্রায়োরিটি তালিকায় যা কিছু আছে, তার সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান করে নিয়েছে এআই নিয়ে গবেষণা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মার্কেট সাইজ অর্থাৎ ব্যবসার পরিধি নাকি প্রতি বছর বাড়তে থাকবে ১২৫ শতাংশ হারে, আগামী বেশ কয়েক বছরের জন্য। অন্য একটি সমীক্ষা বলছে, এআইয়ের কল্যাণে কর্মচারীদের প্রোডাক্টিভিটি অর্থাৎ উৎপাদনশীলতা বাড়বে অন্তত ৩৮ শতাংশ। অন্য কোনও সংস্থার অন্য কোনও গবেষণা আবার এমন তথ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলতে চায়, একজন মানুষের উৎপাদনশীলতা সার্বিকভাবে নির্ভর করে তার মেধা এবং একই সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছের ওপরে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ যত বাড়বে, আমাদের মেধা ক্রমশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়বে। শেষপর্যন্ত তার আর নড়াচড়া করার ক্ষমতা থাকবে না। সোজা কথায় বলতে গেলে, বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যাবে ক্রমশ।
আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। আমরা তো বাংলা মিডিয়াম! স্কুলজীবনের ওই বন্ধু একটি গুঁড়ো মশলা সংস্থার সেলস ম্যানেজার। প্রতি সোমবার অধস্তন কর্মচারীদের সাপ্তাহিক টার্গেট দিয়ে লিখত, ‘প্লিজ, ড্রাইভ দ্য সেলস’। ওর বস জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে একই বাণী?’ ও বলেছিল, ‘দৌড় ওইটুকুই স্যর। মানে বোঝাতে পারলেই হল।’ ওর স্বপ্নে দেখা দিয়েছিল কোনও এআই পরি। বলেছিল, ‘ভোগ করো আমায়, উপভোগ করো।’ চ্যাটজিপিটিকে লিখেছিল, ‘প্লিজ ড্রাইভ সেলস কথাটাকে আরও একটু স্টাইলিশ করে লিখে দাও না গো।’ বন্ধুটিকে ভরিয়ে দিয়েছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওই প্ল্যাটফর্ম। পর্দায় ফুটে এসেছিল, ‘ইনডালজ্ ইন ওপুলেন্ট এলিগ্যান্স উইথ আওয়ার কিউরেটেড কালেকশন।’ প্রতি সপ্তাহে টিমমেম্বারদের হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপে যেতে শুরু করল নতুন নতুন লাইন, জরির ঝালর পরে। সপ্তাহ তিনেক পরে বন্ধুটিকে তলব করেছিলেন ওর বস-সাহেব। ডায়রির মধ্যে লিখে রেখেছিলেন গত তিনটি সোমবারের বন্ধুপ্রদত্ত লাইন। শুধিয়েছিলেন, ‘লিখেছ তো বেশ। কিন্তু এই শব্দের মানেটা কি বল তো?’ বন্ধুর ঠোঁটের উপরে সেলোটেপ আটকে দিয়েছিল কোনও অশরীরী। দশটা শব্দের মানে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ওকে। একটাও বলতে পারেনি। বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হয়, পাকাপাকিভাবে। বলেছিল, ‘স্বপ্নে আসা যে পরিকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম আমি, সেই পরিই আমায় অন্নহারা করল।’ প্রবল ক্রোধে চ্যাটজিপিটির পর্দায় শাবল মারার মতো টাইপ করেছিল ও। লিখেছিল, ‘ইফ আই ডোন্ট গেট রাইস, আমি কী করব? ভাত না পেলে খাব কী?’ উত্তর এসেছিল মুহূর্তে। লেখা ছিল, ‘চাল না পেলে আপনি কুইনোয়া কিংবা মুসেলির মতো বিকল্প খাদ্যের সন্ধান করতে পারেন।’
বিশেষজ্ঞদের করা এক সমীক্ষা বলে, এআইয়ের এই আগ্রাসনে আগামী দিনে কাজ হারাতে চলেছেন প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষ। কিন্তু, এর ফলে কাজ তৈরিও হবে প্রায় দশ কোটি লোকের। মানে, আখেরে নতুন কর্মসংস্থান হবে দুনিয়াজুড়ে দেড় কোটি মানুষের। এই দাবির বিপক্ষে জোরে কণ্ঠ ছাড়ছে আরও হাজারও পরিসংখ্যান। তাদের দাবি, কাজ হারানোর প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আগে যেমন কালো হয়ে আসে আকাশ, ঠিকই একইরকম ভাবে আঁধার মাখতে শুরু করে দিয়েছে বাহারি অফিসের অন্তরমহল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………আরও পড়ুন সেখ সাহেবুল হক-এর লেখা: বিড়াল সর্বত্রগামী, চাঁদে গেলেই বা আপত্তি কী!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এক পরিসংখ্যান ‘দ্যাখো আমি বাড়ছি মাম্মি’ বললেই অন্য সংখ্যাতত্ত্ব কলার তুলে বলে, ‘থাম, থাম, থাম, থেমে থাক’। লড়াই জারি থাকে, অলিম্পিকের মশালের মতো।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানে তো শুধু এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ নয়। জীবনের প্রতিটি স্তরে, আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে জায়গা করে নিচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। অনেক বিশেষজ্ঞই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন, ‘গঠনমূলকভাবে এর ব্যবহার করার জন্য কতটা তৈরি হতে পেরেছি আমরা? বাইনারি সিধুজ্যাঠার কাছে ঠিকঠাক প্রশ্ন করতে হলেও নিজেকে শিক্ষিত করার প্রয়োজন সবার আগে। সেই শিক্ষা আমাদের আছে কি? থাকলেও, তা কি যথেষ্ট? প্রশ্নগুলো সহজ।’ আর উত্তরও তো জানা।
আন্তর্জালে বেশ কয়েক ঘণ্টা বৈঠা চালানোর পরে মনে হল, পরিসংখ্যানের মধ্যেই রয়েছে বিরাট এক গলদ। একটি ট্যাব বলল, এআই ধর্ম, এআই কর্ম, এআই আরাধনা। একে ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই। বলল, বিশ্বের ৩৮ শতাংশ মানুষ নাকি এআইতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন প্রতিদিন। অন্য ট্যাব যেন চোখ মারল পাশে খুলে রাখা উইন্ডোকে। সেখানে হ্যালোজেন আলোয় ফুটে উঠেছিল রয়টার্স ইনস্টিটিউট আর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করা একটি যৌথ সমীক্ষার সারমর্ম। জানা গিয়েছে, প্রতিদিন যত বকবক করা হয় এআই নিয়ে, বাস্তব চিত্রের সঙ্গে তার মস্ত ফারাক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নাচানাচি করা মানুষদের বয়স মূলত ১৮ থেকে ২৪ বছর। আর, আনন্দের থেকেও লোকের মনে বেশি ঢুকে গিয়েছে ভয়। নিঃস্ব হওয়ার ভয়।
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………
বিখ্যাত ফার্মেসি চেইনে কাজ করা আমার এক টেক স্যাভি বন্ধু বলছিল, ‘দিনকাল যা পড়ছে, টোটাল ব্লাড কাউন্ট রিপোর্টে আর কয়েক বছর পরে ঢুকে যাবে একটা নতুন প্যারামিটার। এআইপিআর।’ খোলসা করে দিল নিজেই। বলল, ‘আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স প্রেসিপিটেশন রেট! রক্তে এআই ঢুকে গিয়েছে তো ভাই। কতটা শরীর নিতে পারছে জানতে হবে না!’ ফ্যাচফ্যাচ করে হাসছিল ও।
একটু আগে উল্লেখ করা ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ সমীক্ষাই আবার জানান দিয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গর্ভগৃহ যে মহাদেশ, সেই উত্তর আমেরিকারই ৩০ শতাংশ মানুষ নাকি চ্যাটজিপিটির নামই শোনেননি এখনও।
কী কাণ্ড! রেডিওতে হঠাৎ একটা গান দিল। ওখানেও কি এআই?
‘কী করি আমি,কী করি
বল রে সুবল, বল দাদা
কী করি আমি,কী করি।’
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।