১৯০৪ সালে তাঁর জন্মের ঠিক মাসখানেকের মধ্যেই নেরুদা হারান তাঁর মাকে। নেরুদার নাম তখন নেফ্তালি। বাবা জোস্ অ্যাঞ্জেল রিসের সঙ্গে সম্পর্ক বিশেষ সুখের নয় কোনওদিন। ছেলে কবি হবে, এই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা ভেবে ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন নেফ্তালির অল্পবয়সে লেখা কবিতার খাতাগুলো! বাবার প্রতি ক্ষোভে নিজের নাম পালটে ফেলেন নেফ্তালি। নিজের নাম নিজেই দেন– পাবলো নেরুদা।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে– জুন, ১৯২৪-এ প্রকাশিত হয় পাবলো নেরুদার বিখ্যাত ‘Twenty Love Poems and a Song of Despair.’ সেই বইয়ের কথা ‘Tonight I can write the saddest lines’ বা ‘Love is so short, forgetting is so long’, কিংবা ‘I like for you to be still’, ১৯২৪ থেকে আজ অবধি ঘুরে বেড়ায় মানুষের মুখে মুখে, ছাত্রছাত্রীর খাতায় খাতায়। প্রেমের কবিতার এমন এক বই, যার প্রায় প্রতিটি ভাষায় তরজমা রয়েছে। যে কবিতা মুখস্থ করে অধ্যবসায়ী সদ্য প্রেমে পড়া মানুষ, এখনও।
তবে শুধুই কি ভালোবাসার আবেগ এই কবিতাগুলিতে? অ্যালফ্রেড হিচককের চলচ্চিত্র সম্পর্কে বিখ্যাত ফরাসি চিত্রপরিচালক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো বলতেন, ভালোবাসার দৃশ্যে হিংস্রতা ও হিংস্রতার দৃশ্যে ভালোবাসা সহজেই দেখাতে পারেন হিচকক। তাঁর ছবিতে দুটোর মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই আসলে। দুই ক্রিয়া প্রায়শই এক। পাবলো নেরুদার কবিতা পড়লে এই কথাটাই বারবার মনে হয় যেন।
হিচককের প্রেমের দৃশ্যের মতোই প্রায় সবকটি কবিতা তীক্ষ্ণ ভালবাসার সঙ্গে সহিংসতার পৃথিবী এনে হাজির করে পাঠকের সামনে:
Body of a woman, white hills, white thighs,
You look like a world, lying in surrender.
My rough peasant’s body digs into you…
কোমল, স্নিগ্ধ শরীরকে রুক্ষ শুকনো শরীরের খুঁড়ে ফেলার প্রবল চিত্র দিয়ে শুরু হয় এই ২০টি ভালবাসার কবিতার বই। নেরুদা বলতেন, বহু প্রেমিকার শরীর-মন জড়িয়ে এই ভালোবাসা আর বিষণ্ণতার বই। বন্ধুদের বলতেন, তাঁর অনুপ্রেরণা এখানে ‘মারিসল’ আর ‘মারিসোমব্রা’। ‘মারিসল’ মানে তাঁর বাসস্থান ও তাঁর প্রদেশ, সেখানকার প্রকৃতি, রোদ আর বৃষ্টি। আর ‘মারিসোমব্রা’ মানে তাঁর প্রেমিকা– ‘the woman in the grey beret.’ কখনও বা নেরুদা জানাতেন, সেই ছাই-রঙা টুপি পরা মহিলা আসলে দক্ষিণ চিলির পরিত্যক্ত ঘাট ও তার শঙ্খচিল। আবার কখনও সান্তিয়াগো শহরের ভবঘুরে রাত:
I remember you as you were in the last autumn.
You were the grey beret and the still heart.
In your eyes the flames of the twilight fought on.
And the leaves fell in the water of your soul.
নেরুদা বিশারদদের মতে, আমালিয়া আলভিসো, টেরেসা ভাসকেস, অ্যালবার্টিনা রোসা বা লরা আরু ‘Twenty Love Poems and a Song of Despair’-এর প্রেরণা। তবে এই কবিতা ও গানের প্রেরণা শুধুই কয়েকজন মহিলা চরিত্র বোধহয় নয়। নেরুদার জীবনের প্রথম ২০ বছরের নানা অভিজ্ঞতার ছাপ নিয়ে চলে এই বই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নেরুদা বলেন, তাঁর প্রথম যৌন হেনস্তার অভিজ্ঞতা দুরন্ত দুই প্রতিবেশী মেয়েদের দ্বারা। আর তাঁর প্রথম শারীরিক সম্পর্ক ঘটে অন্ধকার রাতে এক খামারে। প্রায় ঘুমিয়ে পড়া নেরুদা হঠাৎ টের পায় তার শরীরে এক মহিলার হাতের চলাফেরা। সেই মহিলার মুখ বা শরীর কোনওটাই নেরুদা দেখতে পায় না। সকালে নেরুদার পাশে পড়ে থাকে– এক উষ্ণ অবিদ্যমানতা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নিজের ‘মেমোয়ার্স’-এ নেরুদা লেখেন, ১৯০৪ সালে তাঁর জন্মের ঠিক মাসখানেকের মধ্যেই নেরুদা হারান তাঁর মাকে। নেরুদার নাম তখন নেফ্তালি। বাবা জোস্ অ্যাঞ্জেল রিসের সঙ্গে সম্পর্ক বিশেষ সুখের নয় কোনও দিন। ছেলে কবি হবে, এই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা ভেবে ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন নেফ্তালির অল্পবয়সে লেখা কবিতার খাতাগুলো! বাবার প্রতি ক্ষোভে নিজের নাম পালটে ফেলেন নেফ্তালি। নিজের নাম নিজেই দেন– পাবলো নেরুদা।
নেরুদা বলেন, তাঁর প্রথম যৌন হেনস্তার অভিজ্ঞতা দুরন্ত দুই প্রতিবেশী মেয়েদের দ্বারা। আর তাঁর প্রথম শারীরিক সম্পর্ক ঘটে অন্ধকার রাতে এক খামারে। প্রায় ঘুমিয়ে পড়া নেরুদা হঠাৎ টের পায় তার শরীরে এক মহিলার হাতের চলাফেরা। সেই মহিলার মুখ বা শরীর কোনওটাই নেরুদা দেখতে পায় না। সকালে নেরুদার পাশে পড়ে থাকে– এক উষ্ণ অবিদ্যমানতা।
I was alone like a tunnel. The birds fled from me,
And night swamped me with its crushing invasion.
To survive myself I forged you like a weapon,
Like an arrow in my bow, a stone in my sling.
এই বইয়ে কত রকমের ভালোবাসা আর বিক্ষোভ। কত ধরনের চাওয়া আর না-চাওয়া। প্রেমের ২০টি কবিতা আর একটি হতাশার গানে আমরা পাই– ‘dark lair’, ‘cruel sport’, ‘coast of dread’, ‘frightened statue’, ‘bitter mouth’, ‘hungering teeth’-এর আধিক্য। এই কবিতাগুলি প্রেমের সঙ্গে গেঁথে চলে এক ধরনের ভায়োলেন্সের গল্প। সেই জন্যই হয়তো একই স্তবকে বা কখনও একই পঙ্ক্তি-তে ‘dark pines’ আর ‘silver gull’-এর সঙ্গে ‘cold things’ আর ‘heavy vessels’-এর বিরোধালঙ্কারের প্রাচুর্য নেরুদার কবিতায়। ভালবাসার তীব্রতা জন্ম দিতে পারে ভয়াবহ তীক্ষ্ণ সহিংসতা। যৌন সম্পর্কের হাত ধরে নেমে আসতে পারে একাকিত্বের অনিবার্যতা।
দেশের রাজনীতির কি তাহলে কোন প্রভাবই নেই এই প্রেমের বইয়ে? বিশ শতকের প্রথম দিকে, (বিশেষত ১৯২০ থেকে) চিলির ইতিহাস সুখকর নয়। নেরুদার জন্ম সেন্ট্রাল চিলির পারাল শহরে। কয়েক বছর পর কর্মসূত্রে তাঁর বাবা পরিবার সমেত চলে যায় দক্ষিণ চিলির টেমুকো শহরে। ১৯২০ অবধি নেরুদা টেমুকো শহরেই থাকেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ খুব একটা ছাপ না ফেললেও, বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধ-পরবর্তী ডিপ্রেসনের প্রভাবে চিলির খনিজ সম্পদের চাহিদায় ভাটা পড়ে। শ্রমিকরা দক্ষিণ চিলির দিকে ধেয়ে যায় জীবিকার আশায়। বাড়ে দারিদ্র, অসহিষ্ণুতা। তার সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলন, হরতালের রেশ। মৃত্যু হয় ১৫ জন শ্রমিকের। ১৯২২-এর আগে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বিশেষ নেই চিলির রাজনৈতিক মহলে। আরেক দিকে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো শহরে ছাত্র-বিক্ষোভ তুঙ্গে ওঠে। রাষ্ট্রপতি জুয়ান লুই সানফুয়েন্তেসের নেতৃত্বে ধূলিসাৎ করা হয় স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সদর দপ্তর। রাষ্ট্রের প্রতিহিংসায় মৃত্যু হয় ২৪ বছরের ছাত্র-কবি জোস ডমিঙ্গো গোমেস রোজাসের।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন আব্দুল কাফি-র লেখা: বিমলকৃষ্ণ মতিলাল: নিরন্তর সংলাপে আস্থা
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নেরুদা টেমুকোতে থাকাকালীনই ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। লেখেন তাঁর প্রথম রাজনৈতিক লেখা। এই মৃত্যু ও চারিদিকের অসহিষ্ণুতা থেকে যায় নেরুদার সঙ্গে। ‘Twenty Love Poems’-এর ভালোবাসা ও সেই ভালোবাসার ব্যথার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে এই পারিপার্শ্বিক দৈন্য ও সংকীর্ণতার প্রতি নেরুদার বিতৃষ্ণা, ‘like a language full of wars and songs.’ নেরুদার বইয়ের শেষ ‘Song of Despair’-এ নিমজ্জিত হওয়ার মুগ্ধতা ও ত্রাস একইসঙ্গে সুস্পষ্ট। সেটা যতটা ব্যক্তিগত, ততটাই সামাজিক:
Pilot’s dread, fury of a blind driver,
Turbulent drunkenness of love, in you everything sank.
১৯২১-এ নেরুদা টেমুকো ছেড়ে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো পৌঁছন। তাঁর বর্ণনায় সান্তিয়াগো ধোঁয়া ও কফির গন্ধের শহর। এই শহরে তাঁর রাত-জেগে আড্ডা, তাঁর দারিদ্র, আর পুশকিন, বোদলেয়ার, জয়েস ও প্রুস্ত নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা। অতীতের টেমুকোর বৃষ্টি, পুয়ের্তো সাভেদ্রার সূর্যাস্ত, বাগানের পাখির নীল রঙের ডিম ও পোকামাকড়, আর তাঁর ২০টি ভালবাসার কবিতার বই লেখার শহর সান্তিয়াগো– এই সব কিছু নিয়েই ‘Twenty Love Poems and a Song of Despair’.
নেরুদার ২০ বছর বয়সে লেখা তাঁর বিভিন্ন প্রেমের ও বিষাদের ইতিহাস এখনও প্রাসঙ্গিক। কারণ নেরুদার এই বইয়ে প্রেম আছে, যৌনতা আছে, মহিলার শরীরের বস্তুরূপ আছে, একাকিত্ব আছে, বিষণ্ণতা আছে। আর? ভয় আছে।
তথ্যঋণ:
অ্যাডাম ফিনস্টিনের ‘পাবলো নেরুদা: এ প্যাশন ফর লাইফ’ (২০০৪)
পাবলো নেরুদার ‘মেমোয়ার্স’, তরজমা হার্ডি সেন্ট মার্টিন (১৯৭৪)
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।