‘লাপতা লেডিস’ নিজে পরিচালনা করবেন বলেই লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্র বিপ্লব গোস্বামী। কিন্তু আমির খানের স্ক্রিপ্টটা পছন্দ হয়ে গেছিল। বলেছিলেন, ‘কিরণের এটা খুব পছন্দ হয়েছে, আমারও হয়েছে। আমি এটা প্রোডিউস করতে চাই।’ রাজি হয়ে গেছিলেন বিপ্লব, কিন্তু পাশাপাশি আরেকটা স্ক্রিপ্ট রেডি করেছিলেন। তার বিষয়বস্তু ‘লাপতা লেডিস’-এর মতোই অন্যরকম। খুব শিগগির পরিচালনায় আসতে চলেছেন বিপ্লব গোস্বামী তাঁর প্রথম সিনেমা নিয়ে। রোববার.ইন-এ তাঁর একান্ত সাক্ষাৎকার নিলেন শম্পালী মৌলিক।
‘লাপতা লেডিস’ যখন মুক্তি পায় প্রেক্ষাগৃহে, অনেক মানুষ দেখেছিলেন। পরে নেটফ্লিক্সে আসার পরে আলোড়ন তোলে আরও। এখনও পর্যন্ত হিসাব বলছে, সতেরো মিলিয়নের বেশি মানুষ ছবিটা দেখেছেন। ‘অ্যানিম্যাল’-এর ভিউ-কে ছাপিয়ে গিয়েছে। ছবির গল্পকার হিসাবে এটা কীভাবে দেখছেন?
এর উত্তর দিতে গেলে আমাকে একটু পিছনে ফিরতে হবে। প্রায় বছর দশেক আগে সিনেমার আইডিয়াটা মাথায় আসার পরে আমি সিনোপসিস লিখি। প্রায় ২০-২২টা সিন লিখে ফেলার পরে মনে হয়েছিল, এই সিনেমাটা মারাত্মক আলোড়ন তুলতে চলেছে। এটা আমার তখনই মনে হয়েছিল।
এত আগে লিখেছিলেন?
হ্যাঁ, সিনোপসিস লেখা দশ বছর আগে। তারপর কিছুটা এগিয়ে আমি রিসার্চ করতে শুরু করি। এই বিষয়টাকে বিশ্বাসযোগ্য এবং সিনেমাটিকালি সমৃদ্ধ করতে আমাকে হোমওয়ার্ক করতে হয়েছে। ওই গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা, পোশাক, কথাবার্তা, ভাবনা সবটা বুঝতে হয়েছে। সেই সময়টা নিই আর পাশাপাশি অন্য কাজও করতে থাকি। ২০১৮-র শেষ দিকে একটা চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতা হয়েছিল। ভারতের সবচেয়ে বড় স্ক্রিপ্ট কনটেস্ট। সেখানে প্রায় চার হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে আমার স্ক্রিপ্ট দ্বিতীয় হয়েছিল। জুরি মেম্বারদের মধ্যে আমির খান, জুহি চতুর্বেদী, অঞ্জুম রাজাবলি, রাজকুমার হিরানি ছিলেন। সকলেই আমার স্ক্রিপ্টের প্রশংসা করেছিলেন। বিষয়বস্তুটা নিয়ে তক্ষুনি আলোচনা শুরু হয়ে যায়।
যখন স্ক্রিপ্ট কনটেস্ট অ্যানাউন্স করে, আগে যা সিন লিখেছিলাম, আর বাকিটা তার দেড় মাসের মধ্যে লিখে ফেলি। যখন জমা করেছিলাম আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এটা সিলেক্ট হবে। কিন্তু প্রতিযোগী যে চার হাজার হবে, সেটা আমি জানতাম না। আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে মানুষের ভালো লাগবে। এখন সবাই জানতে পারছে। ২০১৮ থেকে ২০২৪, প্রায় পাঁচ বছরের ওপর হয়ে গেল। এই সিনেমাটা আমি পরিচালনা করব বলেই প্রথমে লিখেছিলাম। পেশাগতভাবে আমি পরিচালক এবং রাইটার। পড়াশোনা করেছি কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে। অনেকেরই স্ক্রিপ্টটা পছন্দ হয়েছিল। বম্বের বড় বড় প্রোডাকশন হাউস থেকে আমাকে ডাকে।
তারপর?
সবার আগে আমাকে ডাকেন আমির খান। উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘কিরণের এটা খুব পছন্দ হয়েছে, আমারও পছন্দ হয়েছে। আমি এটা প্রোডিউস করতে চাই।’ তারপর আমি বছর দেড়েক সময় নিয়েছিলাম। মনে হল, ঠিক আছে কিরণজি ডিরেক্ট করুন, আমির খান প্রযোজনা আর আমি রাইটার হিসাবে থাকি। পাশাপাশি আমি তখন আরেকটা স্ক্রিপ্ট রেডি করে ফেলেছি। তার বিষয়বস্তু আমার মনে হয়েছে ‘লাপতা লেডিস’-এর মতোই অন্যরকম। যেটা আমার কাছে আছে। এটা আমি খুব শিগগির বানাব সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে। যাই হোক, তার পর জার্নিটা শুরু হয়। খুব ভালো শেষও হল। প্রতিক্রিয়া যেটা জানতে চাইলেন, সেখানে বলি– প্রতিক্রিয়ার পিছনে আমার অলরেডি একটা প্রেডিকশন ছিল। এতদিন ধরে আমি এরকমই হবে ভেবে রেখেছিলাম। সেজন্য ম্যাজিক্যাল কিছু বা অবিশ্বাস্য মনে হয়নি।
‘অ্যানিম্যাল’-এর তো সাংঘাতিক ভিউ নেটফ্লিক্সে। সেখানে ‘লাপতা লেডিস’ তাকে ছাপিয়ে যাওয়া মানে, উগ্র পৌরুষের আস্ফালনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একটি আপাত নরম ছবি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সজোরে আঘাত করেছে। স্পষ্ট কথা বলেছে নারীর সাম্যের জন্য। সেটা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
একদম তাই। এটা ভীষণ ভালো লাগছে। নারী-পুরুষ হিসেবে দৃষ্টিভঙ্গির একটা ফারাক থাকেই। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব সচেতন ছিলাম। দেখেছি, নারীর এগিয়ে চলার পথে বৈষম্য, প্রতিবন্ধকতা বেশি থাকে, ছেলেদের তুলনায়। এই বিষয়টা যেন খুব সহজ, যেন বলার দরকার নেই, এমনটা দেখেছি। কিন্তু ঘটনাগুলো আজও সত্যি। এগুলোর অস্তিত্ব আছে বলেই গ্রামেগঞ্জে, শহরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে– অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে পিছিয়ে থাকতে হয়। শহরে হয়তো কিছুটা সমানাধিকার দেখি। কিন্তু এই বৈষম্য আমাকে ভাবাত। পুরুষ হিসেবে, নিজেকে নিউট্রাল জায়গায় রেখে ভাবার চেষ্টা করতাম, তাই এই সিনেমাটা লিখতে পেরেছি। তার একটা ভালো লাগা আছে। ‘অ্যানিম্যাল’-এর উগ্র পৌরুষ ছাপিয়ে যাচ্ছে সাধারণ, সাদামাঠা মনের সত্যিকারের একজন পুরুষ। ‘দীপক’-এর চরিত্র আমি এভাবেই তৈরি করেছি। বউ হারিয়ে গেছে বলে সে কাঁদবে, সেটাই আমার স্বাভাবিক মনে হয়। পাগলের মতো ছুটেই বেড়াবে। কিন্তু সে এমন কিছু করছে না– চারতলা বিল্ডিং থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না বা হাতে তলোয়ারও নিচ্ছে না। আমরা যেমন করি, সেটাকে সিনেমাটিকালি স্ট্রাকচার করেছি আমি। যাতে সিনেমার শৈল্পিক গুণ থাকে, আবার এন্টারটেনমেন্ট ভ্যালুও থাকে।
এখন অনেকেই জানেন ‘লাপাতা লেডিস’-এর সাফল্যের পিছনে একজন বাঙালির অবদান আছে। আদতে তো আপনি আগরতলার মানুষ?
আমার ছোটবেলা কেটেছে আগরতলায়। স্বপ্নটা ওখান থেকেই দেখতে শুরু করেছি। কলকাতায় ইন্ডিয়ান আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছি। তার পর এসআরএফটিআই-এ এডিটিং নিয়ে পড়াশোনা। স্থির করেই রেখেছিলাম যে, লেখাপড়া করে ফিল্ম ডিরেক্টর হব। ফলে মানসিক প্রস্তুতি অনেকদিন আগেই শুরু হয়। ফিল্ম ইনস্টিটিউটে এসে মনে হয়, এডিটিং পড়লে টেকনিকাল পার্টগুলো ভালো করে বুঝতে পারব। মাঝখানে অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে অ্যানাউন্সার হিসেবে কাজ করতে গিয়েও আমাকে লিখতে হত। তারপর এসআরএফটিআই-এ পরীক্ষা দিই, পাব কি পাব না চিন্তা ছিল। তার পরে হয়ে যায়। পড়াশোনা আনন্দেই করেছি। বেরিয়ে দেখি বিপদ, স্বপ্ন আর বাস্তবে অনেক তফাত। ততদিনে স্বপ্ন দেখে ফেলেছি অন্যরকম ছবি বানাব। কমার্শিয়াল সিনেমার ধরন বা আর্ট ফিল্ম ঘরানা, সবটাই কিন্তু ‘লাপতা লেডিস’-এর মধ্যে আছে। আবার এটা বাণিজ্যিক ভাবেও সফল ছবি। এই ব্লেন্ডিংটা করতে পেরে আমার ভালো লেগেছে। এসআরএফটিআই থেকে বেরিয়ে কিছুদিন কলকাতায় কাজ করেছি। ন্যাশনালি কাজ করার স্বপ্ন ছিল। বাংলা থেকেও কাজ করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেরকম প্রযোজক পাইনি। স্ক্রিপ্ট রেডি এদিকে। তখন বম্বে চলে যাই। প্রচুর ছবির এডিটিং করেছি তখন। ডকুমেন্টারি, টেলিফিল্ম-ও ডিরেক্ট করি। একটা সময় ভেতরের স্বপ্ন সফল না হওয়ার অস্বস্তি কাজ করতে শুরু করে। সেই কারণে মুম্বইয়ে এডিটিংয়ে অনেকটা এগিয়েও আমি কলকাতায় ফিরে আসি। তুলনায় কঠিন জীবনযাপন করছিলাম। আর লেখাগুলো শেষ করতে শুরু করি। বছর দশেক আগে বম্বেতে যে সিনোপসিস লিখেছিলাম, তা আবার শুরু করলাম কলকাতায়। ‘লাপতা লেডিস’ পুরোটা কলকাতায় বসে লিখেছি। পাশাপাশি আরও কিছু ফিকশন তৈরি করে রেখেছি। অত্যন্ত কঠিন জার্নি ছিল। এখনও কলকাতা-মুম্বই আসা-যাওয়া করছি। কাজের ওপর নির্ভর করে সেটা, দু’-জায়গায় কাজ করতে ভালো লাগে আমার।
সাম্প্রতিককালে কান-এ অনসূয়া সেনগুপ্ত এবং পায়েল কাপাডিয়া ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। অনসূয়ার সাফল্য কিন্তু এসেছে বাংলা থেকে বেরিয়ে গিয়ে। আপনি কলকাতায় সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা এবং কাজও করেছন। কিন্তু ‘লাপতা লেডিস’ হল বম্বে গিয়ে।
ওঁদের সাফল্যে আনন্দের কোনও ভাষা নেই আমার। আমি হিন্দিতে ‘লাপতা লেডিস’ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাংলা থেকে একজন কো-প্রোডিউসার দরকার ছিল। পাইনি। কত মানুষের কাছে ঘুরেছি। তখন একজনও যদি এগিয়ে আসতেন, হত। যাই হোক আমির খান প্রযোজনা করেন শেষ পর্যন্ত।
মার্চের শুরুতে যখন কিরণ রাওকে নিয়ে কলকাতায় আসেন, ছবিটার স্ক্রিনিং হয়। ফিরে গিয়ে ওঁর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
খুবই ভালো। ফিরে গিয়ে আমাকে ‘রিল’ করেও পাঠায়। শি ওয়াজ ভেরি হ্যাপি, খুব জাঁকজমকপূর্ণ হয়েছিল অনুষ্ঠানটা। এসআরএফটি-তে যেহেতু আমি পড়াশোনা করেছি। স্ক্রিনিংয়ে হল একদম ভর্তি ছিল। আমার সমস্ত শিক্ষকরা এসেছিলেন ছবিটা দেখতে। সবার ভালোলাগা নিয়ে আত্মবিশ্বাস থাকলেও, সেই সময় একটু সংশয় কাজ করছিল। কারণ, শিক্ষকদের ইন্টেলেকচুয়াল মাত্রাটা তো অনেক উঁচু। তাঁরা তো আমাদের পড়াতেন। প্রত্যেকে দেখে আমাকে আলাদা করে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, যে খুব ভালো সিনেমা হয়েছে। কিরণজি ওই ভালোলাগা বুঝতে পেরেছিলেন।
আমির-কিরণের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাজ করলেন, স্বাধীনতা কতটা পেয়েছিলেন? আপনি তো গল্পটা দিয়েছিলেন, তারপর নিশ্চয়ই সিনেমাটিক বদল হয়েছিল?
কাহিনি পুরোটাই আমার। সামান্য কয়েকটা জায়গায় কিছুটা যোগ হয়েছে আর অল্পস্বল্প বদল হয়েছে। যখন আমির খানের সঙ্গে আমার এগ্রিমেন্ট হয়ে যায়, কিরণ রাও পরিচালনা করবেন সেটাও ঠিক, সেই সময় সামান্য বদল হয়েছে, প্রতিবার আমাকে ওঁরা জানাতেন। এমনকী বাড়িতে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন যে আমার কেমন লাগছে। খুব সুষ্ঠুভাবে কাজটা হয়েছে।
‘লাপতা লেডিস’ ওটিটি-তে আসার পর সমাজ মাধ্যমে একাংশের মানুষ প্রশ্ন তোলে যে, আপনার গল্পের মূল ধরতাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৌকাডুবি’ থেকে নেওয়া। যেহেতু ঘোমটার জন্য বউ বদলের ঘটনাটি আছে। কী বলবেন?
প্রথম কথা, আমার এই লেখার সঙ্গে ‘নৌকাডুবি’-র কোনও সম্পর্ক নেই। সবার তো সবকিছু পড়া হয়ে ওঠে না। আজ থেকে দশ বছর আগে আমি ‘নৌকাডুবি’ পড়িওনি। এটা হয়তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। যারা এই কথা বলছে, মনে হয় চমক তৈরির জন্য। এটা একেবারে আলাদা ঘটনা নিয়ে লেখা এই ছবিটা। আমাদের দেশে তো ঘোমটা প্রথা আছে। তা নিয়ে বিব্রত হয়ে যাওয়ার মতো এমন ঘটনা স্বাভাবিক ওই দিকটায়, যে অঞ্চলকে ধরে আমি গল্পটা লিখেছি। আর দ্বিতীয় কথা, আমরা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে রাইটিং এথিকস-মোরালিটি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। অন্যের লেখা নকল করতে নেই, আমরা জানি। শিল্পী হিসাবে আমার একটা নীতিবোধ আছে, এটুকুই বলব।
এখন কী নিয়ে ব্যস্ত?
একটা হিন্দি আর কয়েকটা বাংলা লিখেছি এই ধরনের। বাংলাতে সিনেমা পরিচালনা করতে চাই। আলাদা করে কোনও পরিচালক-প্রযোজকের জন্যও লিখতে পারি। একটা হয়তো খুব শীঘ্র লিখব। আর খুব তাড়াতাড়ি একটা বাংলা ছবি পরিচালনা করতে চাই, কথাবার্তা চলছে। হিন্দিরও একটা কথা চলছে।
তাসনিয়া ফারিন আর অর্জুন চক্রবর্তীকে নিয়ে তো একটা ছবির কথা চলছিল?
হ্যাঁ, এই ছবিটা একজন প্রযোজক করবেন ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এমনকী, কাস্টিংও ফাইনাল ছিল। কিন্তু প্রযোজকের দিক থেকে ফান্ড সংক্রান্ত সমস্যার জন্য এটা হয়নি। অন্য প্রযোজকের সঙ্গে করার অনেক চেষ্টা করেছিলাম তাও হয়নি। তবে যখন হিন্দিতে শোনাই, ‘লাপতা লেডিস’ মুক্তির পর, তাঁরা হাইলি এক্সাইটেড। সিনেমাটা হবে। কিন্তু বাংলায় হল না। এবার এটা হিন্দিতে হবে।