নায়িকা রামপাট চড় মারে। তেড়ে মারে। সে ঠাসকাবারিতে দক্ষ। দরকারে নায়ক, ভিলেন, নায়কের ভাই, নিজের বোন, বেয়াদপ পুলিশ, পাশের বাড়ির অত্যুৎসাহী ছোকরা, বেস্টফ্রেন্ড, কারখানার বিত্তশালী মালিক, মিলিওনেয়ার বাপের ছেলে কলারতোলা সহপাঠী, হাত-পা বাঁধা নিজের এক্সপেরিমেন্টাল বয়ফ্রেন্ড– যাকে-তাকে সে নির্দ্বিধায় থাবড়ে দিতে পারে।
লাথি-ঘুসি-গাট্টা-চড়ের মধ্যে সবথেকে দীর্ঘজীবী হল চড়। যে খেয়েছে, তার স্মৃতিতে এখনও নির্ঘাত চড়বড় করছে।
আন্দোলন কখনও ইস্যুভিত্তিক, কখনও টিস্যুভিত্তিক। আবার কখনও ইস্যু ও টিস্যু মিলেমিশে গিয়ে সমাজে একখানা রইরই ফেলে দেয়। এমন ক্ষমতা ওই বাকি তিনের নেই। গাট্টায় বড়জোর মাথায় আব হতে পারে, ঘুসির চোটে চোখের তলায় কালি পড়তে পারে, কিন্তু সে তো বরফ ঘষে চালিয়ে নেওয়া যাবে। লাথির চোটে পড়েটড়ে ছড়েটড়ে গেলে বাঙালির সেই বোরোলিন রয়েছেই, আর ‘গায়ের ব্যথা দূর হটো’ বলে প্যারাসিটামলও জিন্দাবাদ। কিন্তু চড়ের এমন কোনও মহৌষধি নেই যা একড্রপে মুখগহ্বরে সাপ্লাই করে, জল নিয়ে গিলে ফেললেই মেমরি থেকে ডিলিট হয়ে যাবে।
চড় হয়তো যতদিন না মরি, ততদিন মেমরি। ৬০-১২০-১৮০ এমএল গিলে ফেললেও তা রিসাইকেল বিনে আদৌ পৌঁছবে কি না, কেউ জানে না। আর জানেনই তো ‘রিসাইকেল’ বিন এনিটাইম ফিরে আসতে পারে। কোভিডের মতোই। এখনও এই ’২৪ সালের তাতাপোড়া রোদেও এ-খবর মাঝে মাঝেই ভেসে ওঠে কাগজে, ডিজিটালে। পৃথিবীর মারা চড়, মাঝে মাঝে বড় জোরে এসে লাগে।
………………………………………………………………………
নায়িকা রামপাট চড় মারে। তেড়ে মারে। সে ঠাসকাবারিতে দক্ষ। দরকারে নায়ক, ভিলেন, নায়কের ভাই, নিজের বোন, বেয়াদপ পুলিশ, পাশের বাড়ির অত্যুৎসাহী ছোকরা, বেস্টফ্রেন্ড, কারখানার বিত্তশালী মালিক, মিলিওনেয়ার বাপের ছেলে কলারতোলা সহপাঠী, হাত-পা বাঁধা নিজের এক্সপেরিমেন্টাল বয়ফ্রেন্ড– যাকে-তাকে সে নির্দ্বিধায় থাবড়ে দিতে পারে। দজ্জাল শাশুড়ি, নিজের বাবা, টক্সিক বয়ফ্রেন্ড অবশ্য কালবিশেষে নায়িকাকেও দু’-এক ঘা দেয়। তারপর কী করে যেন ৮০ ভাগ সময়ে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ বলে দিব্যি সিনেমা ফুরিয়ে যায়।
………………………………………………………………………
নায়ক বা ভিলেন চড় প্রায় মারেই না। তারা এত জিম-টিম-ঘোড়ার ডিম করে ইয়াত্তোবড়ো মাসল বানাল, সে কি না মৃদুমন্দ চড় মারতে! তারা দোকান ভাঙচুর করে, ঠেলাওলার ফলের ওপর পড়ে গিয়ে আনোখা অনাস্বাদিত ফ্রুট জুস বানায়, পাঁচ আঙুলের বদলে সিক্স প্যাক দেখায়, ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে, লাট্টুর মতো ঘুরে ঘুরে আন্ডারওয়ার্ল্ডকে বেদম কেলায়! বেসিক ব্যাপার হল– প্রেমের আকর্ষণ আর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ– এই দুই নিয়ে তাদের কাজ। নায়িকাকে কাঁধে তুলে দৌড় দেয় ভিলেন! কেন? তার মূল কারণ হল, পৃথিবী আর নায়িকার এই যে টান, তার সহ্য হচ্ছে না! নায়ককে মুশকো হাতে মুক্কা মারে, কারণ প্রেমিক-প্রেমিকার টান দেখলে তার গা জ্বলে যায়– দেখা যায়, নায়ক গাছের গায়ে কাগজছেঁড়া ঘুড়ির মতো দুলছে। উল্টোদিকে, নায়কও সে জিনিস যখন করে, তখন আবার ভিলেন ওই গাছে দোলে না, ডাল-সহ ভেঙে পড়ে। কী আর করা যাবে, ভিলেন তো আর ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’ জানে না। আর কী ভাগ্যিস, নিউটন এই গাছের তলাতেই বসে থাকেননি। আপেলের বদলে যদি আস্ত একটা ভিলেন এসে মাথায় পড়ত, মাধ্যাকর্ষণ ছেড়ে চলে যেতে হত একেবারে।
নায়িকা রামপাট চড় মারে। তেড়ে মারে। সে ঠাসকাবারিতে দক্ষ। দরকারে নায়ক, ভিলেন, নায়কের ভাই, নিজের বোন, বেয়াদপ পুলিশ, পাশের বাড়ির অত্যুৎসাহী ছোকরা, বেস্টফ্রেন্ড, কারখানার বিত্তশালী মালিক, মিলিওনেয়ার বাপের ছেলে কলারতোলা সহপাঠী, হাত-পা বাঁধা নিজের এক্সপেরিমেন্টাল বয়ফ্রেন্ড– যাকে-তাকে সে নির্দ্বিধায় থাবড়ে দিতে পারে। দজ্জাল শাশুড়ি, নিজের বাবা, টক্সিক বয়ফ্রেন্ড অবশ্য কালবিশেষে নায়িকাকেও দু’-এক ঘা দেয়। তারপর কী করে যেন ৮০ ভাগ সময়ে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ বলে দিব্যি সিনেমা ফুরিয়ে যায়। গার্হস্থ্য হিংসা দীর্ঘদিন ধরে লিখে যখন বিখ্যাত হচ্ছেটচ্ছে না, তখন ‘প্রেম’ ছদ্মনাম নিয়ে বিখ্যাত হয়ে গেল– এ কী ধরনের স্ল্যাপস্টিক কমেডি রে ভাই!
চড় মারতেন বটে ইশকুলের স্যরেরা। শোনাও যে একধরনের কথা বলা, জানা যায় ইশকুলেই। পাশের বন্ধুটির গ্যাজরগ্যাজরে কান দিলে, সে তো কথা বলার দরুন থাবড়া খাবেই, এদিকে যে শ্রোতা সে-ও তো দোষী। সে শুনছিল বলেই না এত কাণ্ড! অতএব চুপ করে আছি মানেই অংশগ্রহণ করছি না, তা নয়। যে চড় মারবে, সে লক্ষ রাখছে সবই। ইদানীং, ইশকুল-কলেজে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা-ফটনা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যে, পড়ুয়াদের সামনে, ও পড়ুয়াদের সঙ্গে এই হিংসা-টিংসা চলবে না। শুধু পড়ুয়াদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেই চলতে পারে। যেমন ধরুন, ভোট। দিব্যি পাঠশালায় আপনি কিছুই দেখেননি স্যর চলল, চলবেও।
তবু, মানতেই হবে, চড় যে কোনও আঁচড়ের থেকেই দীর্ঘায়ু। অপমান জিনিসটাই আসলে এমন ঝকঝকে এইচডি। মনের জাদুঘরে সে পড়ে থাকে। খোলা, আলাদা করে কোনও সংরক্ষণ নেই। তুলো, ন্যাপথলিন লাগে না। (কেউ আবার বলে বসবেন না বাঙালির এই জন্যই কোনও ইতিহাস নেই।) তবু, এই যে বহু কালের বহু সম্পাদিত সম্পদখানা, কেউ কখনও তুলে নিয়ে যায় না।
কোথায় সেই চোর যে মানুষের অপমানটুকু চুরি করে নিয়ে চলে যাবে? যাওয়ার পথে তার ঝুলিতে জোর করে ঢুকিয়ে দেব সমস্ত জমিয়ে রাখা পাপ, গ্লানি, আত্মগর্ব। সেই জাদুঘরের বাইরে তার জন্য বিষাদকালিতে লেখা রয়েছে ‘স্বাগত’। আপাতত অপেক্ষা। এ আরও এক ধরনের ‘ওয়েটিং ফর গোডো’।